Image description

উত্তরাঞ্চলে বোরো ধান কাটাই-মাড়াই শুরু হতে এখনও ১০-১২ দিন বাকি। তবে দেশের দক্ষিণাঞ্চল, পূর্বাঞ্চলসহ অন্যান্য এলাকায় ইতোমধ্যেই ধান কাটা ও মাড়াই শুরু হয়ে গেছে। তাই উত্তরাঞ্চলের কৃষিশ্রমিকেরা ছুটছেন ওইসব অঞ্চলে কাজের সন্ধানে।

বুধবার (৩০ এপ্রিল) নীলফামারী, সৈয়দপুরসহ বিভিন্ন রেলস্টেশনে দেখা যায়—দল বেঁধে কৃষিশ্রমিকেরা ট্রেনে করে ধান কাটতে যাচ্ছেন। কারও হাতে ভারভাংকুয়া, কারও কাস্তে, সঙ্গে রয়েছে চাদর ও ব্যবহারের কাপড়চোপড়।

এই প্রতিবেদক জানতে চেয়েছিলেন—মে দিবস উপলক্ষে যখন সব সরকারি, আধা-সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে, তখনও কেন কাজে বের হতে হয়? উত্তরে একাধিক শ্রমিক বলেন, “একবেলা কাজ না করলে পরিবারকে অনাহারে থাকতে হয়। তাই মে দিবস পালন করা আমাদের মতো কৃষিশ্রমিকদের কাছে বিলাসিতার মতো।”

ডিমলার চরখড়িবাড়ির মেট্রিক পাস করা কায়িক শ্রমিক রমিজ খান (২৬) বলেন, “আমি পহেলা মে নিয়ে সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতা পড়েছিলাম। কবিতার দশম লাইনটা সবচেয়ে মনে পড়ে: ‘মাথায় মৃদু চাপড় আর পিঠে হাতের স্পর্শে/কতক্ষণ ভুলে থাকবে পেটের ক্ষুধা আর গলার শিকলকে?’ আহ্লাদি হাতের স্পর্শে আমাদের পেটের ক্ষুধা মরে না। ঘরে স্ত্রী-সন্তান আছে। তাদের মুখে হাসি ফুটাতে প্রতিদিন শ্রম দিতে হয়।”

তিনি আরও বলেন, “মে দিবস বা আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস জানি। আগে দিবসটি পালন করতে গিয়ে উল্টো পকেট থেকে টাকা খরচ হয়েছে। শ্রমিক নেতারা চাঁদা তোলেন, সেই টাকায় পোলাও রান্না হয়, রঙ খেলা হয়, রাতে গানের শিল্পী এনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। প্রশ্ন হলো—এই কি মে দিবসের তাৎপর্য? তাই এসব বাদ দিয়েছি। নিজের সংসার, নিজের পেটের ভাত আমাকেই জোগাড় করতে হয়। কারণ, মে দিবসের দাবি কেউ পূরণ করে না, শুধু আনন্দ-উল্লাস করি আমরা।”

কয়েকজন কৃষিশ্রমিক জানান, বোরো মৌসুমে এবারও ধান চাষিদের জন্য শ্রমিক সংকট দেখা দিয়েছে। জয়পুরহাট, পাঁচবিবি, আক্কেলপুর, সান্তাহার, আদমদীঘি, আত্রাই, নওগাঁ, নাটোর, যশোর, খুলনাসহ বিভিন্ন জেলায় এই সংকট বেশি। ফলে উত্তরের শত শত কৃষিশ্রমিক ট্রেন, বাস ও খোলা পিকআপে করে এসব এলাকায় ছুটছেন।

প্রতিদিন সকালেই নীলফামারী, পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ, দিনাজপুরের পার্বতীপুর, খানসামা ও চিরিরবন্দর, রংপুরের তারাগঞ্জ ও বদরগঞ্জ উপজেলার দিনমজুরেরা ভিড় করছেন উত্তরের রেলস্টেশনগুলোতে। বিশেষ করে চিলাহাটি, ডোমার, নীলফামারী ও সৈয়দপুর স্টেশনে দেখা গেছে উপচে পড়া ভিড়।

নীলফামারী সদর উপজেলার চড়াইখোলা ইউনিয়নের বটতলী এলাকার কৃষিশ্রমিক সর্দার আশরাফুল হক জানান, গ্রামের ১০ জনের একটি দল নিয়ে তাঁরা সান্তাহারে ধান কাটতে যাচ্ছেন। ওখানকার গৃহস্থদের সঙ্গে তাঁর আগেই যোগাযোগ রয়েছে। তিনি বলেন, “মাঠে ধান পাকলে মোবাইলে আমাদের ডেকে নেয়। আগে মে দিবস পালন করতে গিয়ে পকেটের টাকা খরচ হয়েছে, তাই এখন আর করি না।”

কৃষিশ্রমিক জগদীশ চন্দ্র রায়, খানসামার রামকলা গ্রামের বাসিন্দা, বলেন, “কাজ না থাকায় প্রায় এক মাস বসে আছি। সামান্য পুঁজি ছিল, তা শেষ হয়ে গেছে। এবারে আমার মেয়ে এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। দাদন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে টাকা নিয়ে মেয়ের জামাকাপড়, জুতা ও যাতায়াতের খরচ চালাতে হয়েছে। তাই এখন অন্য শ্রমিকদের সঙ্গে নাটোরে ধান কাটতে যাচ্ছি।”

তিনি আরও জানান, “গত বছর নওগাঁর আত্রাইয়ে গিয়েছিলাম। প্রতিদিন গড়ে ৯০০-১০০০ টাকা মজুরি পাওয়া যায়, আর থাকা-খাওয়ার দায়িত্ব নেয় গৃহস্থরাই। তাই ভালো আয় হয়।”

অনেকে জানান, টিকিট সংগ্রহ করার পরও যাত্রীদের ভিড়ে ট্রেনে উঠতে পারছেন না। ফলে বাড়তি টাকা খরচ করে বিকল্প পথে যেতে হচ্ছে।

রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার আলমপুরের কৃষিশ্রমিক মেহের আলী ও আবু তালেব বলেন, “টিকিট কাটতে আইডি কার্ড লাগে, জানতাম না। তবে আসনবিহীন টিকিট পেয়ে গিয়েছিলাম খুলনাগামী রূপসা এক্সপ্রেসে। কিন্তু ভিড়ের কারণে ট্রেনে উঠতে পারিনি। স্টেশন কর্তৃপক্ষ মানবিক বিবেচনায় আমাদের পরবর্তী ট্রেনে উঠার ব্যবস্থা করেছে।”