Image description

সাজ্জাদ হোসেন খান (বড় সাজ্জাদ), সাজ্জাদ হোসেন (ছোট সাজ্জাদ) ও সরোয়ার হোসেন বাবলাএই তিন শীর্ষ সন্ত্রাসীর নির্দেশে তাদের অনুসারীরা চট্টগ্রামের অপরাধজগতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বায়েজিদ বোস্তামী, চান্দগাঁও, পাঁচলাইশসহ পুরো চট্টগ্রাম নগরবাসীর কাছে এই নামগুলো একেকটি আতঙ্ক। তিন অপরাধীর আশ্রয়-প্রশ্রয়ে চলছে দখল, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাস। তবে ভুক্তভোগীরা ভয়ে তাদের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করার সাহস করেনি। ডবল মার্ডারসহ পাঁচজনকে খুনের অপরাধে তাদের সম্পৃক্ততা বের হয়ে আসে। জানা গেছে, ২০০৪ সালে বিদেশে পালিয়ে যায় বড় সাজ্জাদ। সেখান থেকেই চট্টগ্রামের আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণ করত। তার বিরুদ্ধে হত্যা, অস্ত্র, চাঁদাবাজিসহ এক ডজনের বেশি মামলা রয়েছে।

গত ১৫ মার্চ ছোট সাজ্জাদ গ্রেপ্তার হয়ে চট্টগ্রাম কারাগারে আছে। বাবলা ৫ আগস্টের পর জামিনে কারাগার থেকে বের হয়ে চট্টগ্রামেই অবস্থান করছে। ছোট সাজ্জাদ ও সরোয়ার হোসেন বাবলা একটি রাজনৈতিক দলের দুই নেতার আশ্রয়ে রয়েছে বলে জানা গেছে। 

পুলিশ ও স্থানীয়রা জানায়, ১৯৯৯ সালের ২ জুন পাঁচলাইশ ওয়ার্ড কাউন্সিলর লিয়াকত আলী খানকে বাড়ির সামনে খুন করে ত্রাস হিসেবে আবির্ভূত হয় সাজ্জাদ হোসেন খান বা বড় সাজ্জাদ। খুন, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। ২০০০ সালের ৩ অক্টোবর চট্টগ্রাম মহানগরীর বায়েজিদ বোস্তামী থানার চালিতাতলীতে একে-৪৭ রাইফেলসহ তাকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। পরে ২০০৪ সালে জামিনে বের হয়ে বিদেশে পালিয়ে যায়। কিছুদিন দুবাই থেকে শেষে ভারতে অবস্থান করে এই শীর্ষ সন্ত্রাসী। প্রবাসে অবস্থান করলেও বড় সাজ্জাদের প্রশ্রয়ে ছোট সাজ্জাদ ও তার গ্রুপের সদস্যরা চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামী, চান্দগাঁও এলাকায় চাঁদাবাজি ও ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ করছে।

সম্প্রতি চট্টগ্রামের বাকলিয়ায় ডবল মার্ডারে যে অস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে, সেগুলোও বড় সাজ্জাদ ছোট সাজ্জাদকে দিয়েছিল বলে জানা গেছে। আরেক সন্ত্রাসী সরোয়ার হোসেন বাবলাও বড় সাজ্জাদের সঙ্গে কাজ করত। পরে তাদের মধ্যে বিরোধ তৈরি হলে বাবলা বেরিয়ে একটি সন্ত্রাসী গ্রুপের নেতা বনে যায়। বড় সাজ্জাদের ইশারায় ছোট সাজ্জাদ একটি গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছে। চাঁদাবাজি, অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়, হত্যাকাণ্ড, খুনের চেষ্টাসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে এই গ্রুপের বিরুদ্ধে।

গত সাত মাসে ছোট সাজ্জাদ ও বাবলা গ্রুপের বিরোধে ডবল মার্ডারসহ পাঁচজন খুনের ঘটনা ঘটে। গত ৩০ মার্চ চট্টগ্রামের বাকলিয়ায় সংঘটিত ডবল মার্ডারে সাজ্জাদ আলী খান বা বড় সাজ্জাদের সম্পৃক্ততা উঠে এসেছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। বড় সাজ্জাদের উপহার হিসেবে দেওয়া অস্ত্র দিয়েই সহযোগীরা জোড়া খুনের ঘটনা ঘটিয়েছে বলে তথ্য দিয়েছে ছোট সাজ্জাদ। চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (দক্ষিণ) মো. আলমগীর হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, চট্টগ্রামের বাকলিয়ায় ডবল মার্ডারে যে অস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছিল, তা বড় সাজ্জাদ উপহার দিয়েছে বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে ছোট সাজ্জাদ।

বড় সাজ্জাদের হাত ধরে চট্টগ্রামের শীর্ষ সন্ত্রাসী হয়ে ওঠে সাজ্জাদ হোসেন ওরফে ছোট সাজ্জাদ। ২০১৯ সালে অস্ত্র নিয়ে ধরা পড়ে অপরাধজগতে প্রকাশ ঘটায়। ছয় বছরের ব্যবধানে ডবল মার্ডারসহ সে ছয়টি খুনের মামলার আসামি। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে দুটি অস্ত্র, মারামারি-হত্যাচেষ্টার সাতটি এবং চাঁদাবাজির একাধিক মামলা আছে। পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে ছিল এই সন্ত্রাসী। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর চট্টগ্রাম কারাগার থেকে জামিন মুক্তি পায় সে। কারামুক্তির পর চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামী, চান্দগাঁও ও পাঁচলাইশ এলাকায় নিজের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে নিজে ও তার গ্রুপের সদস্যরা চাঁদাবাজি করত। গত ২৯ আগস্ট চট্টগ্রাম নগরের বায়েজিদ বোস্তামী থানার কুয়াইশ সড়কে সাজ্জাদ ও বাবলা গ্রুপের বিরোধে প্রকাশ্যে গুলি করে মাসুদ কায়সার (৩২) ও মোহাম্মদ আনিস (৩৮) নামের দুজনকে হত্যা করা হয়। ১৮ সেপ্টেম্বর বায়েজিদ বোস্তামী থানার কালারপুল এলাকায় শটগান হাতে সাজ্জাদ হোসেনসহ আরো দুজন গুলি করতে করতে একটি নির্মীয়মাণ ভবনে প্রবেশ করে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। গত ২১ অক্টোবর চট্টগ্রামের চান্দগাঁও থানা এলাকার শমশেরপাড়ায় প্রকাশ্যে গুলি করে আফতাব উদ্দিন তাহসিন (২৬) নামের এক যুবককে হত্যা করা হয়। পুলিশ জানিয়েছে, সন্ত্রাসী সাজ্জাদ হোসেন ও বাবলা গ্রুপের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিরোধের জেরে ওই হত্যাকাণ্ড ঘটে। তাহসিন বাবলা গ্রুপের সদস্য ছিলেন। গত বছরের ৫ ডিসেম্বর নগরের অক্সিজেন মোড়ের সাততলা ভবনের পঞ্চম তলায় ছোট সাজ্জাদকে ধরতে অভিযানে যায় পুলিশ। সেখান থেকে পুলিশকে গুলি করে পালিয়ে যায় সে। গত ২৯ জানুয়ারি লাইভে এসে বায়েজিদ বোস্তামী থানার ওসিকে পেটানোর হুমকি দেয়। এরপর সাজ্জাদকে ধরতে পুরস্কারের ঘোষণা দেন চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনার। গত ১৫ মার্চ ছোট সাজ্জাদকে ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যাওয়ার জন্য আরেক সন্ত্রাসী বাবলাকে দায়ী করে ছোট সাজ্জাদের অনুসারীরা। এরপর গত ৩০ মার্চ রাতে চট্টগ্রামের বাকলিয়ার এক্সেস রোডে প্রাইভেট কারে গুলি করে হত্যা করা হয় বখতিয়ার হোসেন ও আবদুল্লাহ নামের দুই ব্যক্তিকে। তাঁরা বাবলার অনুসারী হিসেবে পরিচিত। একই গাড়িতে বাবলা থাকলেও অল্পের জন্য রক্ষা পায়।

গত বছরের ২৭ জুলাই বাবলাকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। গত ৫ আগস্টের পর জামিনে বের হয়ে আসে। তার বিরুদ্ধে বালুমহাল দখল, নির্মীয়মাণ ভবন, বাসাবাড়ি, এমনকি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, ফুটপাতে চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে।

চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামী থানার ওসি মো. আরিফুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর অনেক সহযোগী সদস্যকে আমরা গ্রেপ্তার করেছি। আগে নতুন ভবন করলেই তাদের চাঁদা দিতে হতো। যেখানে নতুন ভবন হচ্ছে, সেখানে গিয়ে আমরা বলছি সন্ত্রাসীদের চাঁদা না দেওয়ার জন্য। মানুষজনকে ফোন নম্বর দিয়ে এসেছি। বলেছি কেউ চাঁদা চাইলে ফোন দিতে, পাঁচ মিনিটের মধ্যে পুলিশ হাজির হবে।’ তিনি আরো বলেন, বড় সাজ্জাদ আর ছোট সাজ্জাদ একই গ্রুপের। বড় সাজ্জাদই ছোট সাজ্জাদকে চালাচ্ছে।