Image description

নিজের সিদ্ধান্তে ঠিক থাকতে পারছে না সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। অন্তত তিনটি বিসিএসের প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করেও তা পেছাতে হয়েছে।

এই কমিশনের নিয়োগের ক্ষেত্রেও ছিল সিদ্ধান্তহীনতা। কমিশনে ছয়জন সদস্যকে নিয়োগ দিয়ে এক সপ্তাহের মধ্যে সে নিয়োগ বাতিল করেছে। পরে নতুন করে অন্য ছয়জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পিএসসির সদস্য এখন ১৫ জন।

পুনর্গঠিত পিএসসি ৪৬তম বিসিএসের লিখিত ও ৪৭তম বিসিএসের প্রিলিমিনারির তারিখ পিছিয়েছে। এর আগে ৪৪তম বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষার তারিখ দু’দফা পেছান তারা। দফায় দফায় পরীক্ষার তারিখ পেছানোর পেছনে পিএসসির ওপর ‘অদৃশ্য প্রভাব’ কাজ করছে বলে আলোচনা আছে। অভিযোগ উঠেছে, সরকারের দু’জন উপদেষ্টা এবং একটি রাজনৈতিক দলের চাপের কারণে পিএসসি কোনো সিদ্ধান্তে স্থির থাকতে পারছে না।

সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সঙ্গে বিসিএস চাকরিপ্রার্থীদের সম্পর্ক এখন ‘দা-কুমড়া’। এক মাস ধরে পিএসসির বিভিন্ন সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে আন্দোলনে আছে চাকরিপ্রত্যাশীর একটি অংশ। ৪৬তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার সূচি বাতিলের দাবিতে আন্দোলন চললেও পিএসসি অনড় ছিল। কিন্তু গত রোববার রাতে সেই লিখিত পরীক্ষা স্থগিতের সিদ্ধান্ত আসে। কর্ম কমিশনের কর্মকর্তারা মনে করেন, দফায় দফায় লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা স্থগিত হওয়ায় বিসিএসজট আরও তীব্র হবে।
এ পরিস্থিতিতে ক্যাডার ও নন-ক্যাডার নিয়োগে পৃথক দুটি পিএসসি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। অন্তর্বর্তী সরকারের যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া গত রোববার এক ফেসবুক পোস্টে সরকারের এ সিদ্ধান্তের কথা জানান। 

পিএসসির সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৪৪ থেকে ৪৭তম– এ চারটি বিসিএস নিয়ে প্রবল চাপ তৈরি করা হয় পিএসসির ওপর। চাকরিপ্রার্থীদের কথা বিবেচনা করে পিএসসি চেয়েছিল, দ্রুত সব পরীক্ষা শেষ করতে। কারণ, চার বছর ধরে কোনো বিসিএসের চূড়ান্ত ফল না হওয়ায় বিপুলসংখ্যক প্রার্থী এ চারটি বিসিএসেই আবেদন করেছেন। বয়স থাকা অবস্থায় তারা সবকটি পরীক্ষায় অংশ নিতে চান। কিন্তু ৪৪তম বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষা ও ৪৬তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার সূচি একই সময়ে নির্ধারণ করায় বিপত্তি বাধে।

এরপর ৪৬তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা পেছানোসহ আট দফা দাবিতে এপ্রিলজুড়ে নানা কর্মসূচি পালন করেন চাকরিপ্রত্যাশীরা। কর্মসূচি চলাকালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিক্ষোভকারীদের ওপর দু’দিন লাঠিপেটাও করে। কেউ কেউ গ্রেপ্তারও হন। তবে পিএসসি পরীক্ষা পেছানোর প্রশ্নে রাজি ছিল না। এ অবস্থায় চাকরিপ্রার্থীরা খোদ পিএসসিরই সংস্কার দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন।

আবার ৪৬তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ ওঠে। পিএসসি তা আমলে না নেওয়ায় আন্দোলনকারীরা আরও বিক্ষুব্ধ হন। গত বছরের এপ্রিলে এই প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হয়েছিল। ওই পরীক্ষায় ১০ হাজার ৬৩৮ পরীক্ষার্থী উত্তীর্ণ হন। 

এরই মধ্যে গত বছরের ১৩ জুলাই বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল টোয়েন্টিফোরে ‘৪৬তম বিসিএস পরীক্ষায় ১৭ জনকে প্রশ্ন দেন সাজেদুল’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ৪৬তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় ১৭ প্রার্থী ছিলেন পিএসসির অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলামের। প্রশ্ন সরবরাহের জন্য তাদের কাছ থেকে অন্তত ২০ লাখ টাকা নিয়েছেন তিনি। এর মধ্যে ১৩ জন পাস করেছেন।

গত ৭ জুলাই সাজেদুল ইসলামসহ ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। প্রিলিমিনারি পরীক্ষা বাতিলের আন্দোলন শুরু হলে পিএসসি নতুন করে ফল প্রকাশ করে। এতে আগের উত্তীর্ণ ১০ হাজার ৬৩৮ জনের সঙ্গে আরও ১১ হাজার প্রার্থীকে উত্তীর্ণ ঘোষণা করে আপাতত আন্দোলন সামাল দেয় পিএসসি। এই বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা আগামী ৮ মে থেকে শুরু হওয়ার কথা ছিল। তাও গত রোববার স্থগিত হয়ে যায়।

একাধিক চাকরিপ্রার্থী সমকালকে জানান, ৪৫তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশের আগেই ৪৬তমের লিখিত পরীক্ষার সূচি ঘোষণা করায় অনেক প্রার্থীকে বাধ্য হয়ে তিন বিসিএস (৪৪, ৪৫ ও ৪৬তম) দিতে হচ্ছে। এর মধ্যে ৪৭তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষার তারিখও ঘোষণা করে পিএসসি। তিনটি লিখিত পরীক্ষা দিয়ে আবার ৪৭তম প্রিলিমিনারির জন্য প্রস্তুতি নেওয়া এই প্রার্থীদের জন্য কষ্টকর। এ নিয়ে দফায় দফায় পিএসসি চেয়ারম্যান ও সদস্যদের সঙ্গে তারা আলোচনা করলেও সমাধান পাননি।

এ ব্যাপারে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. ফিরোজ মিয়া সমকালকে বলেন, সিদ্ধান্তহীনতা আর বাস্তবায়নে গতি না থাকার কারণে বিসিএসে জট পাকছে। জট হলে চাকরিপ্রার্থীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বেশি। পিএসসির সঙ্গে চাকরিপ্রার্থীদের দূরত্ব কমানোর একমাত্র উপায় পিএসসি থেকে সঠিক কর্মপরিকল্পনা নেওয়া এবং তা পরীক্ষার্থীদের আগেই জানিয়ে দেওয়া।
 
বাইরের চাপের অভিযোগ 
অভিযোগ উঠেছে, পিএসসি দফায় দফায় পরীক্ষা পেছাচ্ছে বাইরের চাপে। সাংবিধানিক এ প্রতিষ্ঠানটির অনেক সদস্যই তা মানতে চাইছেন না বলে আলোচনা আছে। এর পক্ষে যুক্তি হিসেবে আসছে বারবার পরীক্ষার তারিখ বদলসহ নানা সিদ্ধান্তহীতা।

একটি গণমাধ্যম এই চাপের পেছনে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার কথা বলা হয়। এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তিনি। গতকাল মঙ্গলবার এক ফেসবুক পোস্টে উপদেষ্টা বলেন, পিএসসি সংস্কারের দাবিতে প্রায় ৮০ ঘণ্টা অনশন করে চারজন চাকরিপ্রার্থী ঝুঁকিপূর্ণ শারীরিক অবস্থায় পৌঁছলে পিএসসি এবং তাদের মধ্যে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিই। রাজু ভাস্কর্যে বসেও বারবার বলেছি, পিএসসি সাংবিধানিক, স্বাধীন ও স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান। আমি পিএসসি এবং আপনাদের মধ্যে ব্রিজ (সংযোগ) হতে পারি, সিদ্ধান্ত দেওয়ার এখতিয়ার আমার নেই।

প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি সুরাহা না করে লিখিত পরীক্ষা নেওয়ার বিরুদ্ধে ছিলেন আন্দোলনকারীরা। পিএসসি-সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে রাজু ভাস্কর্যে বসেই ফোনে কথা বলেছি। পিএসসির চেয়ারম্যান মোবাশ্বের মোনেম স্যার তিনজন সদস্য পাঠান আলোচনার জন্য। টিএসসিতে সাংবাদিক সমিতির অফিসে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি এবং পিএসসির সদস্যদের মধ্যকার দীর্ঘ আলোচনার পর পিএসসি লিখিত পরীক্ষা আপাত স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নেয়। তা ঘোষণা করেন পিএসসির একজন সদস্য। এই প্রক্রিয়ার কোনো অংশেই পিএসসিকে আমি কোনো প্রকার চাপ প্রয়োগ করিনি। পিএসসি এবং ছাত্রদের মধ্যে ব্রিজ হিসেবে সমস্যার সমাধান করাই ছিল আমার লক্ষ্য।

উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘গণঅভ্যুত্থানের একজন ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে সরকারে দায়িত্ব পালন করছি। ফলে শিক্ষার্থীদের যে কোনো যৌক্তিক দাবি কিংবা সমস্যায় এগিয়ে যাওয়াটা আমার দায়িত্ব। আমি সে দায়িত্ব পালন করছি এবং ভবিষ্যতেও করব।’
 
চাকরিপ্রার্থীদের ৮ দফা
পিএসসি সংস্কার আন্দোলনের ব্যানারে চাকরিপ্রার্থীদের আট দফার মধ্যে রয়েছে– ৪৬তম বিসিএস লিখিত পরীক্ষার আগেই প্রশ্ন ফাঁসে জড়িতদের বরখাস্ত ও শাস্তির ব্যবস্থা করা, ভবিষ্যতে এই বিসিএস বাতিলের কোনো শঙ্কা তৈরি হবে না– এই মর্মে নিশ্চয়তা দেওয়া এবং জুনের মধ্যে ৪৪তমের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ। 

৪৫তম বিসিএস থেকে মৌখিক পরীক্ষার নম্বর ১০০ করা, ৪৫তমের লিখিত ফল জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে প্রকাশ। প্রতিটি বিসিএস পরীক্ষা এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে সম্পন্ন করার সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ দেওয়া, প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার নম্বর প্রকাশ এবং লিখিত পরীক্ষার অন্তত দু’মাস আগে সূচি ঘোষণা। 

দ্রুত অধ্যাদেশ জারি করে পিএসসির সদস্যসংখ্যা ২৫ থেকে ৩০ জনে নেওয়া। লিখিত খাতার মূল্যায়নে গতি, নিরাপত্তা ও নিরপেক্ষতার জন্য কমিশনে বসে খাতা দেখার ব্যবস্থা করা। মৌখিক পরীক্ষার আগে ফের ক্যাডার পছন্দক্রম পছন্দের সুযোগ দেওয়া। ভেরিফিকেশনে হয়রানি বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এবং ‘নন-ক্যাডার বিধি-২০২৩’ বাতিল করে বিসিএস মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ সবার চাকরির ব্যবস্থা করা। 

চাকরিপ্রার্থী আশহাবুল ইসলাম আবীর সমকালকে বলেন, ‘আট দফা ছাড়াও আরও কিছু বিষয়ে আমাদের কথা আছে। চূড়ান্ত ফলের আগে প্রাক-যাচাই প্রক্রিয়ার পরিকল্পনা থেকে পিএসসিকে সরে আসতে হবে। ফৌজদারি মামলা ও রাষ্ট্রদ্রোহের সুস্পষ্ট অভিযোগ ছাড়া চূড়ান্ত সুপারিশ পাওয়া কোনো প্রার্থীর গেজেট আটকানো যাবে না। যদি কোনো প্রার্থীর গেজেট আটকানো হয়, তাহলে তার সুস্পষ্ট কারণ প্রকাশ করতে হবে।

পিএসসি কথা বলছে না 
চাকরিপ্রার্থীদের টানা আন্দোলন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের অনশন, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সড়ক, রেলপথ অবরোধসহ নানা কর্মসূচির মুখে ৪৬তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা পেছানোর সিদ্ধান্ত নেয় পিএসসি।

কিন্তু এসব নিয়ে পিএসসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোবাশ্বের মোনেমসহ কমিশন সদস্য ও কর্মকর্তারা গণমাধ্যমে কথা বলতে রাজি হননি। গতকাল দফায় দফায় চেষ্টা করেও কমিশনের কারও বক্তব্য নিতে পারেনি সমকাল।