
পুলিশ সদস্যরা বাইরের হস্তক্ষেপ ছাড়া রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে চান। নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনের জন্য একটি স্বায়ত্তশাসিত বাহিনী গড়ে তুলতে তারা একটি স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনেরও দাবি জানিয়েছেন। গতকাল মঙ্গলবার পুলিশ সপ্তাহ-২০২৫ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে কাছে পেয়ে এসব দাবি জানান পুলিশ সদস্যরা।
গতকাল সকালে রাজধানীর রাজারবাগে পুলিশ অডিটোরিয়ামে পুলিশ সপ্তাহ-২০২৫-এর উদ্বোধন করেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের উদ্দেশে ভাষণ দেন এবং মতবিনিময় পর্বে সদস্যদের কথা শোনেন। পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার মতবিনিময় পর্বটি রুদ্ধদ্বার ছিল।
ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত পুলিশ সূত্র জানায়, বাহিনীর পক্ষ থেকে পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মোহাম্মদ আল আসাদ ও ঢাকা জেলার পুলিশ কনস্টেবল সামিয়া স্বর্ণা নিজেদের দাবি তুলে ধরেন। প্রধান উপদেষ্টাকে সামনে পেয়ে এএসপি মোহাম্মদ আল আসাদ বলেন, ‘পুলিশ প্রায়ই রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষে কাজ করতে বাধ্য হয়। গত ফ্যাসিবাদী সরকারের সময়েও পুলিশকে এভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল।’ রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে দায়িত্ব পালনের জন্য স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনের বিষয়ে কথা বলেন এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘পুলিশ সংস্কার কমিশন একটি স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনের প্রস্তাব করেছে। কমিশন প্রস্তাবটি নিয়ে কাজ করছে, তবে তারা বিশ্বাস করে যে বিষয়টি নিয়ে আরও আলোচনার প্রয়োজন। তবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এখনো বিষয়টির সমাধান করেনি।’
ঢাকা জেলায় দায়িত্বরত পুলিশ কনস্টেবল সামিয়া স্বর্ণা পুলিশ সদস্যদের এক মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ ক্ষতিপূরণ ভাতা দাবি করেন। ওই বৈঠকে উপস্থিত পুলিশের সূত্র বলছে, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস পুলিশ সদস্যদের বক্তব্য ধৈর্যসহকারে শোনেন এবং সমস্যাগুলো সমাধানে শিগগির বসবেন বলে জানান।
সভায় পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেন, পুলিশ সপ্তাহের উদ্দেশ্য হলো নীতিনির্ধারকদের তৃণমূল পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা, যাতে পুলিশ কার্যক্রম আধুনিকীকরণ করা যায়। তিনি বলেন, ‘আমরা ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ একটি মানবিক, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক পুলিশ বাহিনী হতে চাই।’
আইজিপি ঝুঁকি ভাতার সীমা উত্তোলন, অপ্রয়োজনীয় ক্রয় স্থগিতকরণ, মোটরসাইকেলের জন্য ঋণ প্রদানের প্রস্তাবসহ সহায়ক পদক্ষেপের জন্য প্রধান উপদেষ্টাকে ধন্যবাদ জানান।
পুলিশের যেসব দাবি পূরণ হচ্ছে: পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, এবারের পুলিশ সপ্তাহে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ দাবি পূরণ হচ্ছে। পাশাপাশি সরকারের আন্তরিকতা ও ইচ্ছায় পুলিশের কল্যাণে বেশকিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে মোটরসাইকেল কেনার জন্য ঋণ পাচ্ছেন পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) এবং সহকারী উপপরিদর্শকরা (এএসআই)। কনস্টেবল থেকে এসআইদের ঝুঁকি ভাতা প্রদানের ক্ষেত্রে উচ্চ সীমা (সিলিং) বন্ধ করার পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে। এর ফলে নিচের স্তরের পুলিশ কর্মকর্তারা আগের চেয়ে অধিক হারে ঝুঁকি ভাতা পাবেন। পাশাপাশি অধস্তন পুলিশ সদস্যদের নিজেদের বৃহত্তর জেলার মধ্যে পদায়নের চিন্তাভাবনার কথাও জানিয়েছেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা। একইভাবে স্বামী-স্ত্রী দুজনে পুলিশ সদস্য হলে তাদের একই জেলায় পদায়নে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে বলেও চিন্তাভাবনা চলছে।
পুলিশ সূত্র জানায়, পুলিশের জনবল সংকটের বিষয়টিও ছিল আলোচনায়। এটা সমাধানে পুলিশের সাংগঠনিক কাঠামোতে (টিওঅ্যান্ডই) জনবল বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্যও বলা হয়েছে।
সাধারণত বছরের শুরুতে সাত দিনব্যাপী জাঁকজমকপূর্ণভাবে পুলিশ সপ্তাহের অনুষ্ঠান হয়। তবে গত বছরের জুলাই-আগস্টে সরকারবিরোধী আন্দোলন দমাতে ছাত্র-জনতার ওপর বেপরোয়া গুলিবর্ষণে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে পুলিশ বাহিনী। এর জেরে গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দিন ৫ আগস্ট জনতার প্রতিরোধের মুখে পড়েন পুলিশ সদস্যরা। এতে বিভিন্ন থানা, স্থাপনা ও গাড়িতে ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগ করা হয়। ওই আন্দোলনে বিভিন্ন থানা থেকে পুলিশের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এমন পরিস্থিতিতে বাহিনীটির মনোবল ভেঙে পড়ে। তবে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর পুলিশ বাহিনীর মনোবল ফেরানোসহ এ বাহিনীকে জনবান্ধব করতে নানা উদ্যোগ নেয়। এমন বাস্তবতায় এবার পুলিশ সপ্তাহের অনুষ্ঠান ছোট করে মোট চার দিনের করা হয়েছে। রেওয়াজ অনুযায়ী, উদ্বোধনী দিনে বার্ষিক পুলিশ প্যারেড হলেও গতকাল তা হয়নি। তবে প্রধান উপদেষ্টা গতকালের অনুষ্ঠানে কর্মক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখায় ৬২ পুলিশ সদস্যকে পদক প্রদান করেন।
নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনের তাগিদ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার: পুলিশ সপ্তাহের উদ্বোধন অনুষ্ঠান শেষে গতকাল পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। পুলিশ অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত ওই মতবিনিময় সভায় তিনি বলেন, পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থেকে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। কারও কাছ থেকে কোনো বিশেষ সুবিধা নেওয়া যাবে না। ঘুষ, দুর্নীতি থেকে নিজেদের দূরে রাখতে হবে।
জনবান্ধব পুলিশ হিসেবে নিজেদের গড়ে তোলার জন্য পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, অপ্রয়োজনে লাঠিচার্জ বা বলপ্রয়োগ করা যাবে না। উপদেষ্টা বলেন, কাজ করতে গিয়ে পুলিশ সদস্যদের অনেক ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যে বিষয়টি সর্বাগ্রে প্রয়োজন, তা হচ্ছে পুলিশ সদস্যদের ধৈর্য ধারণ। ধৈর্য ধারণ করে আলোচনার মাধ্যমে অনেক সমস্যার সমাধান সম্ভব।
পুলিশ সদস্যদের ব্যবহার, সেবার মানসিকতা ও আন্তরিকতা দিয়ে মানুষের মন জয় করার আহ্বান জানিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, এর মাধ্যমে পুলিশের প্রতি জনগণের দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটবে। সাধারণ মানুষ যেন কোনো ধরনের হয়রানি ও ভোগান্তির শিকার না হয়, সে দিকে লক্ষ রাখতে হবে।
পুলিশে সবচেয়ে বড় সমস্যা অধস্তন ফোর্সদের থাকা ও খাওয়ার সমস্যা। বিষয়টি উল্লেখ করে জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, পুলিশের যানবাহন সমস্যা রয়েছে, তা সমাধানে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। থানার জন্য ২০০টি পিকআপভ্যান কেনার প্রক্রিয়া চলছে। সমস্যা সমাধানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কাজ করা হচ্ছে।
সভায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মো. খোদা বখস চৌধুরী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনি, ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী উপস্থিত ছিলেন। মতবিনিময় সভায় স্বাগত বক্তব্য দেন আইজিপি বাহারুল আলম।
জাতীয় নির্বাচনের আগে ৫ বিষয়ে চ্যালেঞ্জ দেখছে মাঠ পুলিশ: এদিকে পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে গতকাল পুলিশের মাঠ প্রসাশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কর্মশালা করেন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা। সেখানে জাতীয় নির্বাচনের আগে অন্তত পাঁচটি চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা হয় বলে পুলিশ সূত্র জানায়।
কর্মশালায় উপস্থিত পুলিশ সূত্র জানায়, সেখানে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জাতীয় নির্বাচনের আগে মাঠ কর্মকর্তাদের সব ধরনের চাপ বা হস্তক্ষেপ মোকাবিলা করে আইন অনুসারে কঠোরভাবে কাজ করার নির্দেশ দেন। তাদের গুজব মোকাবিলা এবং সাধারণ মানুষের কাছে সঠিক তথ্য উপস্থাপন করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
কর্মশালায় উত্থাপিত একটি প্রেজেন্টেশনে আইনশৃঙ্খলার জন্য হুমকি হিসেবে পাঁচটি প্রধান বিষয় তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে অবৈধ অস্ত্র ও লুণ্ঠিত অস্ত্র জাতীয় নির্বাচনে নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকি তৈরি করছে বলে চিহ্নিত করা হয়। এ ছাড়া আন্তঃদলীয় দ্বন্দ্ব, নানা দাবিতে বিক্ষোভ ও সহিংসতা সামাজিক স্থিতিশীলতায় বিঘ্ন ঘটাচ্ছে বলে আলোচনায় উঠে আসে। বন্দি পলায়ন, সন্ত্রাসীদের জামিন, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে চরমপন্থি প্রভাব এবং রোহিঙ্গা ও আরাকান সংকটে সীমান্তের অস্থিতিশীলতাও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
কর্মশালায় নির্বাচনের আগে জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার, বাহিনীর ভাবমূর্তি উন্নত করা এবং জাতীয় পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার পরিকল্পনা প্রণয়নের বিষয়ে আলোচনা করা হয় বলে সূত্র জানায়।