
পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে চোরাচালানের মাধ্যমে অবৈধভাবে ব্যান্ডউইথ আনছে একটি সংগঠিত চক্র, যার নেতৃত্বে রয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের কয়েকটি আইটিসি ও আইআইজি অপারেটর। সরকারের অনুমতি ছাড়াই বিপুল ব্যান্ডউইথ সীমান্ত দিয়ে এনে বিক্রি করা হচ্ছে আইআইজি ও আইএসপিদের কাছে। বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) দুর্বল নজরদারির সুযোগে গড়ে উঠেছে এই চোরাচালান নেটওয়ার্ক। বছরে শত শত কোটি টাকার অবৈধ বাণিজ্য হলেও সরকার পাচ্ছে না কোনো রাজস্ব। বিশ্লেষকরা বলছেন, রাষ্ট্রীয় স্বার্থ ও নিরাপত্তার জন্য অপ্রদর্শিত ব্যান্ডউইথ বাজার এখন বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যেভাবে দেশে আনা হচ্ছে অবৈধ ব্যান্ডউইথ: ২০১২ সালে ব্যান্ডউইথ আমদানিতে সাবমেরিন কেবলের বিকল্প বা ব্যাকআপ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে বেসরকারি ছয়টি প্রতিষ্ঠানকে আইটিসি (ইন্টারন্যাশনাল টেরেস্ট্রিয়াল কেবল) লাইসেন্স দেয় বাংলাদেশ সরকার। এই তালিকায় রয়েছে সামিট কমিউনিকেশন, ফাইবার অ্যাট হোম, ম্যাংগো টেলিসার্ভিস, ওয়ান এশিয়া অ্যালায়েন্স, বিডিলিংক কমিউনিকেশন এবং নভোকম লিমিটেড। লাইসেন্স প্রাপ্তির পর প্রতিষ্ঠানগুলো সীমান্ত এলাকায় স্থাপন করে নিজস্ব অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্ক ও টার্মিনাল ইক্যুইপমেন্ট। সীমান্ত এলাকার ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’ অংশে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের হ্যান্ডহোল ও রাউটার রয়েছে, যেখানে ভারতের ডাটা সেন্টার থেকে আসা অপটিক্যাল ফাইবার লাইন যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ অংশে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব ফাইবার লাইনের সঙ্গে।
নিয়ম অনুযায়ী, আইটিসি অপারেটরদের আমদানিকৃত ব্যান্ডউইথ এনটিটিএন ব্যবস্থার মাধ্যমে আইআইজি অপারেটরদের কাছে পৌঁছানোর কথা। বিটিআরসির গাইডলাইন অনুযায়ী, আইটিসি অপারেটর ছাড়া অন্য কোনো লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানের ব্যান্ডউইথ আমদানির সুযোগ নেই। কিন্তু বেনাপোলে ডিভাইস স্থাপনের অনুমতি না থাকা সত্ত্বেও আইটিসি অপারেটরদের স্থাপনায় ডিভাইস বসিয়ে অবৈধভাবে ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্যারিয়ার’ থেকে ব্যান্ডউইথ আমদানি করা হচ্ছে। এই কাজে তাদের সহায়তা করছে আইটিসি অপারেটররা, যা বিটিআরসির গাইডলাইনের পুরোপুরি ব্যত্যয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিদিন ঠিক কত পরিমাণ ব্যান্ডউইথ দেশে ঢুকছে, তা মনিটরিংয়ের কোনো প্রযুক্তিগত সক্ষমতা নেই বিটিআরসির। ফলে সীমান্ত পেরিয়ে অবাধে নিয়ে আসা ব্যান্ডউইথের একটি বড় অংশ বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে সরকারি রাজস্বের বাইরে থেকে। দেশে সাবমেরিন কেবল বা বৈধ রুটে আসা ব্যান্ডউইথের চেয়ে তুলনামূলক কম দামে এই অবৈধ ব্যান্ডউইথ বিভিন্ন অপারেটর ও করপোরেট ব্যবহারকারীদের কাছে বিক্রি করে চোরাচালান চক্রের হোতা প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তুলেছে শতকোটি টাকার অবৈধ ব্যান্ডউইথ বাজার।
তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, অবৈধভাবে ব্যান্ডউইথ আমদানি চক্রে জড়িত রয়েছে আইটিসি ও আইআইজি (ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে) প্রতিষ্ঠানগুলো। বিশেষ করে সামিট, ফাইবার অ্যাট হোম, নভোকম ও বিডি লিংকের পাশাপাশি উইন্ডস্ট্রিম, স্টারট্রেক, আর্থ, লেভেল থ্রি—এসব প্রভাবশালী আইটিসি ও আইআইজি প্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরি জড়িত রয়েছে অবৈধ ব্যান্ডউইথ আমদানিতে।
বিটিআরসির গোপন অভিযান, বেনাপোলে আইটিসি স্থাপনায় অবৈধ ব্যান্ডউইথের সন্ধান: সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি বিটিআরসির এনফোর্সমেন্ট অ্যান্ড ইনস্পেকশন ডিরেক্টরেট ডিভিশনের তিন সদস্যের একটি দল গোপনে অভিযান চালায় সীমান্ত এলাকায় অবস্থিত কয়েকটি আইটিসি প্রতিষ্ঠানের স্থাপনায়। অভিযানে অবৈধভাবে ব্যান্ডউইথ আমদানির প্রমাণ পেয়ে বিডিলিংক, আর্থ ও লেভেল থ্রি—এই তিনটি প্রতিষ্ঠানের মোট ৩০০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইথ বিচ্ছিন্ন করা হয়।
অভিযান সূত্রে জানা যায়, বিডিলিংকের স্থাপনায় ব্যবহার হচ্ছে লেভেল থ্রির অবৈধ ডিভাইস। বিডিলিংকের আইটিসি লাইসেন্স ট্রান্সমিশন সুবিধা ব্যবহার করে আইআইজি প্রতিষ্ঠান লেভেল থ্রি বিটিআরসির অনুমোদন ছাড়া সরাসরি ইন্টারন্যাশনাল ক্যারিয়ার থেকে ব্যান্ডউইথ ক্রয় করছে, যা আইআইজি গাইডলাইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এ ছাড়া বিডিলিংকের নিজস্ব আইআইজি লাইসেন্সেরও ডিভাইস ব্যবহারের প্রমাণ পায় বিটিআরসি, এমনকি লেভেল থ্রিকে দেওয়া ৫০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইথেরও তথ্য গোপন করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
বিটিআরসির অনুমোদন ছাড়াই নভোকম লিমিটেড নামক আইটিসির র্যাকও ব্যবহার করছে আইআইজি লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান লেভেল থ্রি। অভিযানে নভোকমের র্যাকে ১২০ জিবিপিএসের সুইচ পাওয়া যায়, যার অ্যাকসেস শুধু লেভেল থ্রির কাছে রয়েছে। অথচ নভোকমের সঙ্গে লেভেল থ্রির অবকাঠামো ভাগাভাগির কোনো চুক্তি নেই। শুধু লেভেল থ্রি ক্যারিয়ার নয়, নভোকমের র্যাকে বিভিন্ন লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানেরও সুইচ রয়েছে।
অনিয়মের তথ্য পাওয়া গেছে ফাইবার অ্যাট হোমের স্থাপনায়ও। বিটিআরসির অভিযানে জানা গেছে, ফাইবার অ্যাট হোমের স্থাপনায় আর্থ টেলিকমিউনিকেশনের চারটি এবং লেভেল থ্রির দুটি রাউটার রয়েছে। তাদের মধ্যে ইনফ্রাস্ট্রকাচার শেয়ারিং চুক্তি না থাকা সত্ত্বেও আইআইজি লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান দুটিকে এই অবৈধ সুবিধা দিচ্ছে আইটিসি অপারেটর ফাইবার অ্যাট হোম।
আইটিসি লাইসেন্সধারী সামিট কমিউনিকেশন এবং ম্যাংগো টেলি সার্ভিসের অবকাঠামো ভাগাভাগির ক্ষেত্রে ব্যত্যয় না পেলেও তাদের ইন্টারন্যাশনাল ব্যান্ডউইথ সংক্রান্ত তথ্যে অসংগতি পেয়েছে বিটিআরসি।
বিটিআরসি সূত্রে জানা গেছে, শুধু এই প্রতিষ্ঠানগুলো নয়, অবৈধভাবে ব্যান্ডউইথ আমদানির সঙ্গে জড়িত রয়েছে বেশিরভাগ আইটিসি, আইআইজি, আইএসপি ও এনটিটিএন লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান। অবৈধভাবে আমদানিকৃত ব্যান্ডউইথ আইটিসিগুলোর স্থাপনা থেকে যশোর হাইটেক পার্কে নেওয়া হয়। পরে সেখান থেকে বিভিন্ন লাইসেন্সধারী অপারেটরের কাছে সরবরাহ করা হয়।
বিটিআরসির উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের যোগসাজশের অভিযোগ: অবৈধভাবে ব্যান্ডউইথ আমদানি চক্রের সঙ্গে বিটিআরসির উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের যোগসাজশ রয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। সূত্র জানায়, অবৈধ ব্যান্ডউইথ চিহ্নিত হওয়ার পর বিটিআরসির অভিযানকারী দল যশোর হাইটেক পার্কে যাচ্ছিল ব্যবহারকারী ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের তথ্য সংগ্রহে। কিন্তু বিটিআরসির উচ্চপর্যায়ের এক কর্মকর্তার নির্দেশে অভিযান মাঝপথেই স্থগিত করা হয়। ওই কর্মকর্তার নির্দেশেই আর্থ ও লেভেল থ্রির বিচ্ছিন্ন করা অবৈধ ব্যান্ডউইথ ফের চালুর অনুমতি দেওয়া হয়।
এমনকি অবৈধভাবে ব্যান্ডউইথ আমদানির বিষয়টি জানা থাকলেও কখনো ব্যবস্থা নেয়নি বিটিআরসি। এ বিষয়ে বিটিআরসির অবস্থান সম্পর্কে একটি আইটিসির পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হলেও তাকে কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি অভিযুক্ত ওইসব কর্মকর্তা। এ ধরনের পদক্ষেপ টেলিযোগাযোগ খাতে শৃঙ্খলা রক্ষায় কমিশনের ভূমিকা নিয়ে উঠেছে গুরুতর অভিযোগ।
দুই টেরাবাইটের অধিক জিবিপিএস অবৈধ ব্যান্ডউইথের বাজার: বিটিআরসির একটি সূত্রে জানা গেছে, অবৈধ ব্যান্ডউইথ সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতা সামিট কমিউনেকশন এবং ফাইবার অ্যাট হোম। এ দুই প্রতিষ্ঠানের একই সঙ্গে রয়েছে আইটিসি, আইআইজি ও এনটিটিএন লাইসেন্স। ফলে নিজস্ব ডার্ক ফাইবারের মাধ্যমে ব্যান্ডউইথ নিয়ে এসে নিজেরই আইআইজিকে সংযোগ দিচ্ছে এবং বিভিন্ন আইএসপিকে সরবরাহ করছে। বর্তমানে শুধু সামিটের কমপক্ষে ৬০০ জিবিপিএস অবৈধ সংযোগ চালু আছে। পাশাপাশি ফাইবার অ্যাট হোম, নভোকম, লেভেল থ্রি ও আর্থের পাশাপাশি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেরও বিপুল পরিমাণ অবৈধ সংযোগ চালু রয়েছে। সব মিলিয়ে এই অবৈধ ব্যান্ডউইথের বাজার ২ টেরাবাইটেরও অধিক বলে নিশ্চিত করেছে সূত্র।
আইন লঙ্ঘন করায় আইটিসিগুলোকে জরিমানা: বিটিআরসি সূত্রে জানা গেছে, এই অভিযানের মাধ্যমে উঠে আসে একটি সুসংগঠিত অবৈধ ব্যান্ডউইথ সরবরাহ চক্রের প্রমাণ, যার পরিপ্রেক্ষিতে আইটিসি অপারেটরগুলোকে বিভিন্ন পরিমাণে জরিমানা করেছে বিটিআরসি। জানা গেছে, গত ২১ এপ্রিল বিটিআরসির ২৯৪তম কমিশন সভায় আইটিসি লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো পরিদর্শনে প্রাপ্ত অনিয়মের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। সেই সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বিটিআরসির আইন অমান্য করায় জড়িত আইটিসি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে জরিমানা করা হয়। জরিমানার অর্থ ১০ কার্যদিবসের মধ্যে পরিশোধের জন্য চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
কমিশন সভা সূত্রে জানা গেছে, ইনফ্রাস্ট্রকচার শেয়ারিং গাইডলাইন ভঙ্গ করায় বিটিআরসির ২০০১ ধারা অনুযায়ী আইটিসিগুলোর মধ্যে বিডি লিংক কমিউনিকেশন লিমিটেডকে ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা, নভোকম লিমিটেডকে ৫০ লাখ এবং ফাইবার অ্যাট হোমকে ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। অভিযুক্ত আইআইজিগুলোর বিষয়ে ওই সভায় আলোচনা না হওয়ায় সিদ্ধান্ত হয়নি, পরবর্তী সভায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ক্রয়মূল্যের সঙ্গে বিক্রয়মূল্যের অসামঞ্জস্যতা: কমিশন সভা সূত্রে জানা গেছে, শুধু অবৈধভাবে ব্যান্ডউইথ আমদানি নয়, আইটিসিগুলোর বিরেুদ্ধে ক্রয়মূল্য থেকে বিক্রয়মূল্য কম দেখানোর অভিযোগ উঠেছে। ক্রয়মূল্যের থেকে বিক্রয়মূল্য কম নির্ধারণ করে প্রতিযোগিতা আইন-২০১২ এবং বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন-২০০১ লঙ্ঘন করায় আইটিসিগুলোকে ৭ কোটি ৯৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। সামিট কমিউনিকেশনকে ৩ কোটি, নভোকমকে ২ কোটি ৫০ লাখ, ফাইবার অ্যাট হোমকে ১ কোটি, ম্যাংগো টেলিসার্ভিসকে ৭৫ লাখ এবং বিডি লিংককে ২০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এ ছাড়া সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেডকে (বিটিসিএল) ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
কী বলছে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো: অভিযুক্ত আইটিসি এবং আইআইজি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাদের মধ্যে কিছু প্রতিষ্ঠান বলছে, এখানে কোনো অনিয়ম হচ্ছে না, সবকিছু গাইডলাইন মেনেই কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। আবার কিছু আইটিসি প্রতিষ্ঠান বলছে, এভাবে ব্যান্ডউইথ আনা অবৈধ। অনিয়ম হলেও বিটিআরসির গাফিলতির কারণে দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে ব্যান্ডউইথ আমদানি হচ্ছে।
সামিট কমিউনিকেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিফ আল হাসান কালবেলাকে বলেন, আমাদের কোনো অপ্রদর্শিত ব্যান্ডউইথ নেই, আমরা বৈধপথেই ব্যান্ডউইথ আমদানি করি। বিক্রয়মূল্যের চেয়ে ক্রয়মূল্য বেশি দেখানোর বিষয়ে তিনি বলেন, যেটা নিজেদের কনজাম্পশনের জন্য ব্যবহার করি, সেটার মার্কেট রেটের ওপর রেভিনিউ শেয়ারিং ফি দেয় না। কারণ, যেটা নিজেদের কনজাম্পশনে ব্যবহার করি, সেটাতে খরচ কম। এখন মার্কেট রেটের গ্যাপটা বিটিআরসি বলছে জরিমানা হিসেবে দিতে হবে। বিটিআরসি থেকে আইটিসি অপারেটরের জন্য কোনো ট্যারিফ নির্ধারণ না থাকার কারণে এমন সমস্যা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, যেহেতু ট্যারিফ নির্ধারণ ছিল না, সেখানে জরিমানা করার সঙ্গে আমরা একমত নই।
সবচেয়ে বেশি অনিয়মের সঙ্গে জড়িত আইআইজি প্রতিষ্ঠান লেভেল থ্রি এবং আর্থ বলছে, তাদের সব ধরনের চুক্তি রয়েছে, নিয়ম মেনেই তারা কাজ করছে। লেভেল থ্রির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহমেদ জুনায়েদ কালবেলাকে বলেন, গাইডলাইন মেনেই ব্যান্ডউইথ আমদানি করা হচ্ছে। এখানে গাইডলাইনের কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। অভিযোগ অস্বীকার করে আর্থের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামাল হোসেন বলেন, আমাদের সব ডকুমেন্টস আছে, এ বিষয়ে আমরা বিটিআরসির সঙ্গে কথা বলব।
বিষয়টি অবৈধ স্বীকার করে আইটিসি প্রতিষ্ঠান বিডি লিংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার মো. খুরশিদ আলম কালবেলাকে বলেন, লেভেল থ্রি নামক আইআইজি প্রতিষ্ঠান আমাদের স্থাপনা ব্যবহার করে। এটা অবৈধ জানার পর তাদের সংযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলাম, কিন্তু পরে বিটিআরসি থেকে তাদের সংযোগ চালু করে দিতে বলা হয়, সেই হিসেবে সংযোগ চালু করা হয়।
তিনি বলেন, আমি নিজের দোষ স্বীকার করে গত নভেম্বর থেকে বারবার বিটিআরসির কাছে জানতে চেয়েছি এটাতে তাদের সম্মতি আছে কি না, কিন্তু আজ পর্যন্ত তারা আমাকে তাদের সিদ্ধান্ত জানায়নি। বিষয়টি নিয়ে বিটিআরসির সিদ্ধান্তহীনতার কারণে এমনটি হয়েছে। তিনি বলেন, আমি যেহেতু বিটিআরসির কাছে আগেই জানিয়েছিলাম আইআইজি প্রতিষ্ঠানকে সহায়তা করা ঠিক হচ্ছে কি না, সে হিসেবে বিষয়টি কমিশন সভায় আলোচনা হওয়া উচিত ছিল।
ফাইবার অ্যাট হোমের আইটিসি ও আইআইজি বিভাগের কর্মকর্তা সজল হাজরা কালবেলাকে বলেন, অভিযানে বিটিআরসি যে অসংগতিগুলো পেয়েছে, সেগুলো আমাদের নয়। এখানে ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে, আমাদের সব নিয়মের মধ্যে হচ্ছে। আর অভিযুক্ত আরেক আইটিসি প্রতিষ্ঠান নভোকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মইনুল হকের সঙ্গে তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনে বারবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। এমনকি তার হোয়াটসঅ্যাপে অভিযোগের বিষয় জানিয়ে মেসেজ দিলেও সাড়া মেলেনি।
বিটিআরসির বক্তব্য: সংস্থাটির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) মো. এমদাদ উল বারী কালবেলাকে বলেন, গাইডলাইন অনুযায়ী কোনো আইআইজি লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের ব্যান্ডউইথ আমদানির কোনো সুযোগ নেই। শুধু আইটিসি লাইসেন্সধারীরা ব্যান্ডউইথ আমদানি করতে পারবে। যদি তারা বলে থাকে আইআইজি লাইসেন্স দিয়ে ব্যান্ডউইথ আমদানি করা যায়, তাহলে তারা সেটা দেখাক। তিনি বলেন, অভিযানে যেসব ব্যত্যয় পাওয়া গেছে, সেগুলোর ভিত্তিতে জরিমানা করা হয়েছে। প্রথমে অনিয়মের সঙ্গে জড়িত আইটিসিগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আইআইজিগুলো বাদ যাবে না, পরবর্তী সময়ে আইআইজিগুলোর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ধাপে ধাপে অনিয়মের সঙ্গে সব প্রতিষ্ঠানকে ধরা হবে।
বিটিআরসির ত্রুটিপূর্ণ মনিটরিং ব্যবস্থা:
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিটিআরসি দেশের ইন্টারনেট অবকাঠামোর তদারকির জন্য যে ডাটা ইনফরমেশন সিস্টেম (ডিআইএস) নামক মনিটরিং সফটওয়্যার ব্যবহার করছে, তা বাস্তবে কোনো স্বয়ংক্রিয় পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা নয়—বরং এটি একটি সাধারণ ডাটা এন্ট্রি ভিত্তিক সফটওয়্যার, যেখানে সংশ্লিষ্ট অপারেটররাই নিজেদের ব্যান্ডউইথ আমদানি ও বিতরণের তথ্য প্রদান করে। অর্থাৎ, ব্যান্ডউইথ আমদানির থেকে গ্রাহক পর্যায়ে পৌঁছানো পর্যন্ত প্রতিটি ধাপেই তাদের নিজের হিসাব, নিজের তথ্য এবং নিজের যাচাই—ফলে নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে যা দেখাতে চায়, শুধু সেটুকুই দেখা যায়। ফলে যদি কোনো আইটিসি অপারেটর অবৈধভাবে ব্যান্ডউইথ আমদানি করে থাকে এবং সেই ব্যান্ডউইথের তথ্য সফটওয়্যারে রিপোর্ট না করে, তাহলে বিটিআরসির পক্ষে তা শনাক্ত করা অসম্ভব। একচেটিয়াভাবে অপারেটরদের ওপর নির্ভরশীল থাকা এই ব্যবস্থায় তথ্য গোপন, ভুয়া হিসাব, এমনকি সম্পূর্ণ ব্যান্ডউইথ ‘চোরাপথে’ ব্যবহারের সুযোগ থেকেই যাচ্ছে।