Image description

সব ধরনের ওষুধের মধ্যে দেশে পরিপাকতন্ত্রের জটিলতাবিষয়ক ওষুধ বিক্রিতে রয়েছে তৃতীয় সর্বোচ্চ স্থানে । সরকারি গবেষণায় উঠে এসেছে , এসব ওষুধ বিক্রির অঙ্ক বছরে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা । এই পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট , জনসংখ্যার একটা বিশাল অংশ পরিপাকতন্ত্রের সমস্যায় ভুগছে । জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন , ভেজাল খাবার গ্রহণ ও সার্বিক খাদ্যাভ্যাস , অস্বাস্থ্যকর জীবনাচার ও অসংক্রামক রোগের বিস্তার বাড়ার কারণে পরিপাকতন্ত্রের রোগের ঘটনা বেড়েছে । নিজে নিজে ওষুধ সেবনের প্রবণতা বাড়াও এই রোগের ওষুধের বিক্রি বেড়ে চলার একটি কারণ ।

সরকারের তথ্য বলছে , বছরে দেশের ওষুধের বাজারের আকার ৩৮ হাজার কোটি টাকার বেশি । এর ৯৪ শতাংশই ব্যয় হয় ব্যক্তি উদ্যোগ বা পরিবারের মাধ্যমে । সরকারি ব্যয় মাত্র ৫ দশমিক ৬ শতাংশ । একটি জরিপের অংশ হিসেবে সরকারের এই পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট । ‘ বাংলাদেশ ফার্মাসিউটিক্যাল এক্সপেন্ডিচার ট্র্যাকিং বাই ডিজিজেস ২০২০ ' নামের জরিপটি ২০২৩ সালের শেষে এসে প্রকাশ করা হয় । এটাই এ - বিষয়ক সর্বশেষ জরিপ । আর ওষুধের মোট ব্যয় নিয়ে এমন বড় জরিপ বাংলাদেশে প্রথম । এতে খুচরা পর্যায়ে ওষুধের দোকান , স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত ওষুধের ব্যয়ের বিবরণ উঠে এসেছে । গবেষণাটিতে রোগভেদে ওষুধের বিভাজনও দেখানো হয়েছে । প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী , সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় হচ্ছে পেশিতন্ত্র ও সংযোগকারী টিস্যুর রোগের ওষুধে । এসব রোগসংক্রান্ত ওষুধের বাজার ৬ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকার । দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে সংবহনতন্ত্র অর্থাৎ হৃৎপিণ্ড , রক্তনালির যাবতীয় রোগের ওষুধের বাজার । এর আকার ৬ হাজার ১৩৬ কোটি টাকা । তৃতীয় স্থানে থাকা পরিপাকতন্ত্রের রোগের ওষুধের পেছনে ব্যয় হয় ৫ হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা , যা মোট ওষুধের বাজারের ১৪ শতাংশ । ২১ এপ্রিল বাংলাদেশ ঔষধ শিল্প সমিতির এক কর্মশালায় বলা হয় , দেশের ওষুধের বাজারের সবচেয়ে বড় অংশ খাদ্যনালি ও বিপাকীয় নিরাময়ের ওষুধ নিয়ে । এর আকার মোট বাজারের ৩৫ শতাংশ । সরকারের তথ্য অনুযায়ী , দেশের মোট স্বাস্থ্য ব্যয় ৭৭ হাজার ৭৩৫ কোটি টাকা । এর ৫০ শতাংশই চলে যাচ্ছে ওষুধের বাজারে ।

স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের গবেষণায় পরিপাকতন্ত্রের যেসব রোগব্যাধি ও সমস্যার উল্লেখ করা হয়েছে , সেগুলোর মধ্যে রয়েছে বমি সিনড্রোম , ডায়রিয়া , খাদ্যে বিষক্রিয়া , পিত্তথলিতে পাথর , গ্যাস , ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ , খারাপ খাদ্যাভ্যাস , ভুল খাদ্যাভ্যাস , ব্যায়ামের অভাব এবং মানসিক চাপের মতো রোগ । নিজের উদ্যোগেই ওষুধ কেনা , তাৎক্ষণিক প্রতিকারের সন্ধান খোঁজা , নৈমিত্তিক অ্যাসিড ও পেট ফাঁপা এবং আলসার নিরাময়ের ওষুধের উচ্চ ব্যবহারের মতো কয়েকটি কারণে পরিপাকতন্ত্রের ওষুধের বাজারের আকার এত বড় হয়েছে । দরকারে - অদরকারে ওষুধ কেনায় অপচয় ও সাধারণ স্বাস্থ্যগত বিপত্তি হওয়া ছাড়াও উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের কারণে ওষুধের বিরুদ্ধে জীবাণুর প্রতিরোধ সৃষ্টি হচ্ছে । কমছে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের কার্যকারিতা ।

পরিপাকতন্ত্রের রোগগুলোকে ১০ টি ভাগ করে ওষুধের ব্যয়ের বিভাজন করেছে স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট । তাদের জরিপ বলছে , পরিপাকনালির রোগের কারণেই বিক্রি হচ্ছে সোয়া দুই হাজার কোটি টাকার ওষুধ । ব্যবহৃত ওষুধের ৪২ শতাংশই অ্যাসিড , গ্যাস ইত্যাদির কারণে । এসব ওষুধের ভোক্তার ৫৭ শতাংশ নারী এবং ৪৩ শতাংশ পুরুষ । যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিনের তথ্য অনুযায়ী , হজমজনিত রোগগুলোই পরিপাকতন্ত্রের সঙ্গে জড়িত । এর সঙ্গে খাদ্যনালি , লিভার , পাকস্থলী , ক্ষুদ্রান্ত্র ও বৃহদন্ত্র , পিত্তথলি এবং অগ্ন্যাশয়ের সম্পর্ক রয়েছে । সাধারণ হজমজনিত ব্যাধির মধ্যে রয়েছে খাদ্যনালি ও পাকস্থলীর মধ্যবর্তী পেশির বিভিন্ন রোগ , ক্যানসার , ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম , ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স (দুধজাতীয় খাদ্য হজমে অক্ষমতা) এবং হাইটাল হার্নিয়া । হজমজনিত অসুখের সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণের মধ্যে রয়েছে রক্তপাত , পেট ফাঁপা , কোষ্ঠকাঠিন্য , ডায়রিয়া , বুক জ্বালা , ব্যথা , বমি বমি ভাব এবং বমি ।

স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টসের ফোকাল পয়েন্ট ডা . সুব্রত পাল আজকের পত্রিকাকে বলেন , “আমরা বিভিন্ন সময় জাতীয় স্বাস্থ্যসেবাবিষয়ক ব্যয়ের তথ্য প্রকাশ করলেও ওষুধজনিত খরচ নিয়ে এমন কাজ প্রথম । ওষুধের ব্যয় কোথায় কত হচ্ছে , তা এই গবেষণায় উঠে এসেছে । এর মানে অবশ্য এই নয় যে সব ওষুধ ভোক্তা নিজেই কিনেছে । এর মধ্যে রপ্তানিও রয়েছে । ওষুধ কেনার কারণে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয়ের অঙ্ক প্রভাবিত হচ্ছে , এটিও গবেষণায় দেখানো হয়েছে । আমরা কিছু সুপারিশও দিয়েছি । ' যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাময়িকী ‘ উইলি’তে প্রকাশিত প্রাপ্তবয়স্ক বাংলাদেশিদের বিপাকীয় সমস্যাবিষয়ক একটি গবেষণায় বলা হয় , বিপাকীয় উপসর্গগুলো হৃদরোগ , স্ট্রোক এবং টাইপ টু ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয় ।

গবেষণায় দেখা গেছে , স্বাস্থ্যসচেতন ব্যক্তিদের মধ্যেও ২০ শতাংশের শরীরে বিপাকীয় উপসর্গ ছিল । এ ছাড়া উচ্চ রক্তচাপে ভোগা ব্যক্তিদের মধ্যে ৭০ শতাংশের এবং ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে ৪৭ শতাংশের বিপাকীয় উপসর্গ ছিল । পুরুষের চেয়ে নারীদের মধ্যে বিপাকীয় জটিলতা বেশি দেখা গেছে । জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা . মো . গোলাম কিবরিয়া আজকের পত্রিকাকে বলেন , ‘ পরিপাকতন্ত্রের যেসব রোগ রয়েছে , সেগুলোর মধ্যে অ্যাসিডিটির ওষুধের সেবন বেশি । এটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মানুষ নিজ ইচ্ছায় খায় । এসব ওষুধ শুধু ওটিসি ( যা ওভার দ্য কাউন্টার অর্থাৎ ব্যবস্থাপত্র ছাড়া কেনা যায় ) বলেই যে মানুষ ইচ্ছেমতো কিনতে পারছে , বিষয়টা এমন নয় । বাংলাদেশে ওষুধের দোকানে ব্যবস্থাপত্র দেখার বিষয়টা তো তেমনভাবে মানাই হয় না ।

এসব ওষুধের এত বেশি সেবন অস্বাভাবিক । ” পরিপাকতন্ত্রের ওষুধের অতিমাত্রায় সেবনের কারণ হিসেবে এসব ওষুধের সহজলভ্যতা এবং লোকের অসচেতনতা ও অজ্ঞতার কথা বলেছেন বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (সাবেক বিএসএমএমইউ) প্রিভেনটিভ অ্যান্ড সোশ্যাল মেডিসিন অনুষদের ডিন ও পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা . মো . আতিকুল হক । আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন , ‘ মানুষ এসব ওষুধ মুড়ির মতো খায় । খাদ্যাভ্যাস , জীবনাচারের কারণে অ্যাসিডিটি , পেটে ব্যথা হলেই তারা এসব ওষুধ খায় । অথচ এসব সমস্যা খুব সহজে রোধ করা যায় । আমাদের খাদ্যাভ্যাস গ্যাসের সৃষ্টি করে । আমরা ডালজাতীয় খাবার বেশি খাই । নিশ্চল জীবনাচার এবং মানসিক চাপ গ্যাসের সৃষ্টি করে । রাতে পেটভরে খেয়ে সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লেও পেটে ব্যথ্যা ও গ্যাস হয় ।

'অতিমাত্রায় গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ সেবনে বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে বলে সতর্ক করে দিয়ে এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, “আমাদের দেশের মানুষ নির্বিচার ওষুধ গ্রহণের ফলাফল জানে না । যেমন রেনিটিডিন নামের ওষুধ এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বাজার থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে । কেননা এতে ক্যানসার ঘটানোর মতো উপাদান পাওয়া গেছে । মানুষ নিত্যনতুন গ্যাসের ওষুধ খাচ্ছে । কোন ওষুধে কী আছে , তা এক দিনে জানা যায় না । ওটিসি হিসেবে ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই এ ধরনের যেসব ওষুধ বিক্রি হচ্ছে , তা বন্ধ হওয়া উচিত ।