Image description

ঢাকার আদালতে প্রসিকিউশন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কয়েকজনের বিরুদ্ধে ঘুস গ্রহণ, বদলি বাণিজ্য ও বন্দিদের অবৈধ সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রসিকিউশন বিভাগের ওই কর্মকর্তারা আদালতের জিআর (সাধারণ নিবন্ধন) শাখার নথি আটকে বিচারপ্রার্থীদের কাছ থেকে গোপনে টাকা আদায় ছাড়াও হাজতখানায় বন্দিদের সাক্ষাৎ ও খাবারের সুযোগ দেওয়ার জন্যও ঘুস নেন। আদালতে কর্মরত পুলিশের একজন সাব-ইনস্পেকটরের (এসআই) নেতৃত্বে চলছে এই ঘুস বাণিজ্য।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকার পতনের পর ডিএমপির বিভিন্ন শাখায় আমূল রদবদল হলেও গুরুত্বপূর্ণ প্রসিকিউশন বিভাগ রয়েছে আগের মতোই। সাবেক সরকারের সুবিধাভোগী কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সংশ্লিষ্টদের অনেকেই এখনো বহাল। ফলে বিচারপ্রার্থীদের কাছ থেকে নিয়মিত ঘুস ও অর্থ আদায়ের পুরোনো পদ্ধতি রয়েছে সর্বত্র। অভিযোগ পাওয়া গেছে, এসব কাজে ডিসি প্রসিকিউশনের নাম ভাঙিয়ে ওই বিভাগে কর্মরত রিজার্ভ অফিসার (আরও) এসআই সাইদুর এসব অনিয়মকে জিইয়ে রেখেছেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রসিকিউশন বিভাগের প্রতিটি দপ্তর থেকে নিয়মিতভাবে অর্থ সংগ্রহ করেন এসআই সাইদুর। এই অর্থ উত্তোলনের পর একটা অংশ নিজের কাছে রেখে বাকিটা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে পৌঁছে যায়। পুরো প্রক্রিয়াটি নিয়মিত এবং সংঘবদ্ধ। এটি এখন প্রতিষ্ঠিত অনিয়মে রূপ নিয়েছে। জিআর শাখাগুলোর মধ্যে প্রতিবছর একজন করে সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা (জিআরও) নিয়োগ দেওয়া হয়। এসব নিয়োগের ক্ষেত্রে যেসব জিআরে মামলার সংখ্যা বেশি, সেসব জিআরে আদায়কৃত ঘুসের পরিমাণও বেশি। নিয়োগের ক্ষেত্রে জিআর-ও কাছ থেকে বড় অঙ্কের অর্থ আদায় করা হয়, যা ২ থেকে ৩ লাখ টাকায় রফাদফা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। একইভাবে প্রতিটি জিআর শাখায় এক বছরের জন্য একজন করে কনস্টেবল নিয়োগ দেওয়া হয়। এই নিয়োগপ্রাপ্ত কনস্টেবলদের কাছ থেকেও ১ লাখ থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়। ক্ষেত্র বিশেষে এই টাকার পরিমাণ কমবেশি হয়।

জিআর শাখায় কর্মরত ছিলেন খোদ পুলিশেরই এক কর্মকর্তার কাছ থেকেও এই শাখার দুর্নীতি ও ঘুস লেনদেনের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলেছে। জানা গেছে, কনস্টেবল জিয়া, কনস্টেবল বাবুল, কনস্টেবল সুরুজ রিজার্ভ অফিসার সাইদুরের ব্যাচমেট। সূত্র জানায়, তারা আদালতসংলগ্ন স্টার হোটেলে বসে ঠিক করেন কাকে কোন জিআর দেওয়া হবে, কার বদলি আটকানো হবে, কার কাছ থেকে কত টাকা নেওয়া হবে।

ওই সূত্র আরও জানায়, ৫ আগস্টের পর যাদের ঢাকার বাইরে বদলি করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে অনেকেই বদলি বাতিলের জন্য আবেদন করে। এ ব্যাপারে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের নির্দেশনা ছিল, যারা বদলি বাতিলের আবেদন দিয়েছে, সে আবেদন নিষ্পত্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের বদলি করা যাবে না। তারপরও সাইদুরের সঙ্গে যাদের মিল হয়নি বা অর্থ দিতে গড়িমসি করেছে অথবা কম দিয়েছে তাদের মধ্যে কনস্টেবল ও এসআইসহ ৩৩ জনকে একদিনের মধ্যে টিআইএমএস (প্রস্থান) আউট দিয়ে দিয়েছিলেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কনস্টেবল যুগান্তরকে বলেন, আমার বদলির আদেশ আটকানোর জন্য সাইদুর সাহেব আমার কাছে টাকা চেয়েছিলেন। আমি টাকা দিতে রাজি হইনি বলে সঙ্গে সঙ্গেই আমাকে টিআইএমএস (প্রস্থান) আউট দিয়ে দেন।

অভিযোগের বিষয়ে এসআই সাইদুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, এ অভিযোগ কারা করে আমি জানি না। কেউ অভিযোগ দিলে আমি তো কিছু বলতে পারব না। এখন জিআরও নিয়োগ দেওয়া হয় লটারির মাধ্যমে। ডিসি (প্রসিকিউশন) স্যার সম্পূর্ণ ক্লিনভাবে এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে থাকেন। বাকি অভিযোগ মিথ্যা বলে দাবি তার।

এ বিষয়ে ডিসি প্রসিকিউশন তারেক জোবায়ের যুগান্তরকে বলেন, জিআরও নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে লটারি করা হয়। এখানে কোনো অনিয়মের সুযোগ নেই।

বকশিশের নামে ঘুস : দেশের সবচেয়ে বেশি পরিমাণ মামলা বিচারাধীন ঢাকার আদালতে। এখানে মামলার নথি দেখা, হাজিরা দেওয়া, ওকালতনামায় স্বাক্ষর করা, জামিননামা দেওয়া, মামলা লিস্টে আনা, শুনানির সিরিয়াল মেনটেইন করা, জামিনের শুনানি করা, মামলার নকল তোলাসহ মামলা সংক্রান্ত যে কোনো সেবা নিতে গুনতে হয় অর্থ।

এছাড়া ফাইলিং শাখা, সেরেস্তা, জিআর শাখা, আদালতের পেশকার, উমেদার, জিআরও, স্টেনোগ্রাফার (আদেশ লিখতে সংশ্লিষ্ট কম্পিউটার অপারেটর), বিচারকদের আরদালি (যিনি বিচারকের চেয়ার ঠিক করে দেন), আদালতের পিয়ন, সমন জারিকারক, আইটি সেকশন ও ডেসপাস শাখা। এসব জায়গায় বেশির ভাগ কর্মচারী অনিয়মের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

আদালতের উমেদার থেকে কোটি কোটি টাকার মালিক দেলোয়ার : ২০০৪ সালের পর আদালতের জিআর শাখায় উমেদার হিসাবে দৈনিক ৫০০ টাকা মজুরিতে কাজ শুরু করেন দেলোয়ার হোসেন। এরপর ডিসি প্রসিকিউশন হিসাবে যিনিই আসেন তার কাছে ঘেঁষে নিলাম বাণিজ্য, পুলিশ সদস্যদের বদলি, জিআরও ও কনস্টেবল নিয়োগ, হাজতখানায় আসামিদের খাবারের নিলাম বাণিজ্যসহ অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। আদালতের কয়েকজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, অধিকাংশ নিলামই নিয়ন্ত্রণ করে দেলোয়ার সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব যোগসাজশ করে তারা নিলামে অংশ নেয়। সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দেন দেলোয়ারের শ্যালক পল্লব ও তার সহযোগী নূর হোসেন, রনি, জামিল নামের কয়েকজন। এসবের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যান দেলোয়ার। তার গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরের বোয়ালমারীতেও শত শত বিঘা জমি রয়েছে। বর্তমানে পল্লবী জিআর-এ তার বড় ভাই আসাদ চাকরি করছেন উমেদার হিসাবে। অভিযোগ, ভাইয়ের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ ও যাবতীয় কাজ করেন দেলোয়ার।

সূত্র আরও জানায়, ২০২২ সালের ২০ নভেম্বর আদালত প্রাঙ্গণ থেকে পুলিশের ওপর পিপার স্প্রে করে প্রকাশক দীপন হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামিকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়। এই ঘটনার পর তৎকালীন ডিসি প্রসিকিউশন জসিম উদ্দিন দেলোয়ারকে বের করে দেন। তবে এতে তেমন কিছুই হয়নি দেলোয়ারের। প্রসিকিউশন বিভাগের সাবেক ডিসি আনিসুর রহমানের সঙ্গে বিশেষ সখ্য গড়ে নিজের সিন্ডিকেট বহাল রাখেন দেলোয়ার। এমনকি বর্তমান ডিসির (প্রসিকিউশন) সঙ্গেও দেলোয়ার সখ্য গড়ে তুলেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এ বিষয়ে ডিএমপির মিডিয়া বিভাগের ডিসি মুহাম্মদ তারেবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, এ বিষয়ে আমি অবগত নই, আমি খোঁজ নিয়ে আপনাকে জানাচ্ছি। পরে তিনি আর কিছু জানাননি।

সার্বিক বিষয়ে ঢাকা আইনজীবী সমিতির সভাপতি খোরশেদ মিয়া আলম যুগান্তরকে বলেন, আমরা প্রায়ই এসব কথা শুনি। যদি লিখিত কোনো অভিযোগ পাই তাহলে আমরা যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলব।