Image description

বাংলাদেশের রফতানি ও প্রবাসী আয় বেড়েছে, তেমনি বাড়ছে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত। ডলারের দামও কমতে শুরু করেছে। প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের জন্য প্রতিযোগিতা শুরু হওয়ার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। চীন-জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার শীর্ষ ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা মুখিয়ে আছে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে। জাতীয় নির্বাচন হয়ে গেলেই তারা বড় ধরনের বিনিয়োগে ঝাঁপিয়ে পড়বে। তবে এখন পর্যন্ত বিনিয়োগে বড় কোনো খবর নেই। কর্মসংস্থানও থেমে আছে, বাড়ছে না খুব একটা। এডিবি ও আইএমএফও বাংলাদেশে আরো বিনিয়োগ করবে বলে লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। 

রিজার্ভ বেড়ে ২৭ বিলিয়ন ডলারের কাছে :

দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পুনরুদ্ধারে ধীরে ধীরে ফিরছে স্থিতিশীলতা। রেমিট্যান্স প্রবাহের ধারা ইতিবাচক থাকায় রিজার্ভের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের কাছাকাছি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্যে দেখা গেছে, ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত দেশের মোট রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৬ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ অনুযায়ী রিজার্ভের পরিমাণ ২১ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার।তবে বাস্তবে যে রিজার্ভ ব্যবহারযোগ্য, সেই ‘নিট রিজার্ভ’ এর হিসাব আরো ভিন্ন। আইএমএফকে জানানো হিসাবে- এসডিআর খাত, ব্যাংকগুলোর ফরেক্স ক্লিয়ারিং ব্যালেন্স এবং আকুর পাওনা বাদ দিয়ে বাংলাদেশের প্রকৃত ব্যয়যোগ্য রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, রিজার্ভে এ ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার পেছনে মূল অবদান রাখছে প্রবাসী আয়। চলতি এপ্রিলের প্রথম ২৬ দিনেই রেমিট্যান্স এসেছে ২২৭ কোটি ১০ লাখ ডলার। শুধু গত মার্চ মাসেই রেমিট্যান্সের ইতিহাসে নতুন রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ। এ মাসে এসেছে ৩ দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলার, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স। ধারাবাহিকভাবে টানা সাত মাস দুই বিলিয়নের বেশি রেমিট্যান্স প্রবাহ অব্যাহত থাকার ফলেই রিজার্ভে এসেছে গতি।সাধারণত একটি দেশের রিজার্ভ অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় নির্বাহের জন্য পর্যাপ্ত হওয়া প্রয়োজন। বর্তমান রিজার্ভ দিয়ে বাংলাদেশের তিন মাসের বেশি সময়ের আমদানি দায় মেটানো সম্ভব, যা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য ইতিবাচক বার্তা দেয়।

রেমিট্যান্স প্রবাহে কিছুটা কমেছে ডলারের দাম :

কয়েক মাস ধরে দুই বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স আসছে দেশে। এর সঙ্গে রফতানিতে বড় প্রবৃদ্ধি দেখা দিয়েছে। এসব কারণে ব্যাংকগুলোর ওপর বকেয়া আমদানি বিল পরিশোধের চাপ ও ডলারের চাহিদা কমেছে। এতে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম কিছুটা কমেছে।

রেমিট্যান্সের ডলার কিনতে ব্যাংকগুলো ১২২ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ১২২ টাকা ৬০ পয়সা রেট দিচ্ছে। এটা চলতি মাস এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহেও রেমিট্যান্সের ডলার সংগ্রহে ১২৩ টাকা থেকে ১২৩ টাকা ২০ পয়সা পর্যন্ত রেট দিতে হতো। সে হিসাবে দুই সপ্তাহের ব্যবধানে ডলারের দাম কমেছে ৫০ পয়সা থেকে ৭০ পয়সা পর্যন্ত।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংকগুলোর ওভারডিউ পেমেন্টের পরিমাণ কমে এসেছে। এ কারণে এক্সচেঞ্জ রেটের ওপর আগে যে চাপটা ছিল, সেটাও কমে এসেছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রাবাজার আগের তুলনায় এখন বেশি সহজ হয়েছে। আগামীতে ডলারের দাম আরো কমার সম্ভাবনা রয়েছে। বিনিয়োগকারীদের একটা অংশ নতুন বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আগামী নির্বাচনের অপেক্ষা করছেন। বিনিয়োগ সংক্রান্ত আমদানিও বাড়ার সম্ভাবনা নেই। কয়েক মাসে ডলারের চাহিদা বাড়ার সম্ভাবনাও নেই।


তাছাড়া বিগত সরকারের সময়ে জ্বালানি খাতের যে ওভারডিউ পেমেন্টের চাপ ছিল সেটাও কমে এসেছে। বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার সময়ে বাংলাদেশের শুধু বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে বকেয়া, এলএনজি ও তেলের পাওনা (বকেয়া) ছিল ৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। গত আট মাসে সেটা কমিয়ে ৬০০ মিলিয়ন ডলারে নিয়ে আসা হয়েছে।

বিনিয়োগে মুখিয়ে চীন-জাপান-কোরিয়া

চীনের বাণিজ্যমন্ত্রী ওয়াং ওয়েনতাও-এর নেতৃত্বে ১০০ সদস্যের ব্যবসায়ী প্রতিনিধি দল ঢাকায় আসছে। এ বিষয়ে ঢাকা সফররত চীনা প্রতিনিধি দলের সঙ্গে এক বৈঠকে পররাষ্ট্র সচিব জসীম উদ্দিনের আলোচনা হয়েছে।

গতকাল সোমবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বার্তায় এ তথ্য জানিয়েছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিক বিভাগের দক্ষিণ-পূর্ব ও দক্ষিণ এশীয় বিষয়ক ব্যুরোর মহাপরিচালক পেং শিউবিন পররাষ্ট্র সচিব জসীম উদ্দিনের সঙ্গে তার কার্যালয়ে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন।

মহাপরিচালক চীনের প্রতি বাংলাদেশের জনগণের উষ্ণ ও বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাবের প্রশংসা করে বলেন, চীন এবং চীনের কমিউনিস্ট পার্টি অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধি অর্জনে বাংলাদেশের জনগণের স্বপ্ন ও প্রত্যাশা পূরণে তাদের পাশে থাকবে।

 



পররাষ্ট্র সচিব বলেন, চীনের বাণিজ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে ১০০ জনেরও বেশি সদস্যের চীনা ব্যবসায়ী প্রতিনিধি দলের আসন্ন সফর দুই দেশের মধ্যে শক্তিশালী অর্থনৈতিক সম্পর্ককে প্রতিফলিত করে।

বাংলাদেশের পরীক্ষিত বন্ধু জাপান মেট্রোরেল, গভীর সমুদ্র বন্দরসহ নানা উন্নয়ন প্রকল্পে আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতা দিয়ে আসছে। একক দেশ হিসেবে সর্বশীর্ষ বিনিয়োগকারী জাপানের এসব সহযোগিতা এসেছে মূলত সরকারি পর্যায়ে। অনেকগুলো বেসরকারি কোম্পানি বিনিয়োগ করলেও তা সরকারি অর্থায়নের চেয়ে বেশ কম। দেশটির শীর্ষ কোম্পানিগুলো অপেক্ষা করছে নির্বাচিত স্থায়ী সরকারের জন্য। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে বড় কোনো বেসরকারি বিনিয়োগ হওয়ার সম্ভাবনা কম। নির্বাচিত সরকারের আসলেই জাপানের শীর্ষ কোম্পানিগুলো থেকে ব্যাপক বিনিয়োগের সম্ভাবনা আছে। সে দেশের শীর্ষ কোম্পানিগুলো মুখিয়ে আছে। 

একই অবস্থায় আছে দক্ষিণ কোরিয়া, দেশটির শীর্ষ কোম্পানিগুলোও অপেক্ষা করছে নির্বাচিত সরকারের জন্য। 

বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাড়াতে আগ্রহী এডিবি :

অর্থনীতিতে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ বাড়াতে আরো বিনিয়োগ করতে চায় এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। এ মুহূর্তে বাংলাদেশে সংস্থাটির ১২ বিলিয়ন ডলারের ৫২টি প্রকল্প চলমান। পাইপলাইনে আছে আরো আড়াই বিলিয়ন ডলার, এডিবির আবাসিক প্রতিনিধি হো ইয়ান জিওং এ কথা জানিয়েছেন।
গতকাল সোমবার রাজধানীতে চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে বিজনেস অপরচুনিটি সেমিনারে তিনি এসব কথা জানান।

এতে বলা হয়, ২০২৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে এলডিসি তালিকা থেকে বের করতে সহায়তা করছে এডিবি। 

আইএমএফের ঋণ নিয়ে চিন্তিত নয় বাংলাদেশ :

আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচির অধীনে ২৩১ কোটি ডলার ইতোমধ্যে ছাড় হয়েছে। আরো ২৩৯ কোটি ডলার পাওয়ার কথা রয়েছে। তবে তা নিয়ে বিশ্ব ঋণদাতা সংস্থাটি শর্তে বেড়াজালে ফেলেছে বাংলাদেশকে। এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর সম্প্রতি বলেন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে আলোচনা চলমান থাকলেও, ঋণ পাওয়া দেশের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়। ওয়াশিংটন সময় গত শুক্রবার আইএমএফের সঙ্গে বৈঠকের পর এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, তাদের সঙ্গে আমাদের এখনো কোনো চূড়ান্ত সমঝোতা হয়নি, তবে আমাদের অবস্থান একেবারে দূরত্বেও নেই। যদি সমঝোতা না-ও হয়, তবুও কোনো বড় সমস্যা হবে না। বাংলাদেশের অর্থনীতি স্বাভাবিকভাবেই চলবে।