
দেশে গ্যাসের তীব্র সংকটে জ্বলছে না বাসা-বাড়ির ঘরের চুলা, ঘুরছে না শিল্পাঞ্চলে মালিকদের কারখানার চাকা। অবস্থা এতই শোচনীয় যে, গ্যাস নিতে গিয়ে সিএনজি স্টেশনগুলোতে গাড়িচালকদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার হয়ে যাচ্ছে। একই কারণে কমেছে সিরামিক, ইস্পাত ও টেক্সটাইল খাতের উৎপাদনও। বর্তমানে গরমে বিদ্যুৎ খাতে গ্যাস সরবরাহে সরকার প্রাধান্য দেওয়ায় আবাসিক ও শিল্পে গ্যাসের সংকট বৃদ্ধি পেয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
শিল্প মালিকরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গ্যাসের জন্য সর্বোচ্চ দাম দিয়েও আমরা গ্যাস পাচ্ছি না। উৎপাদন এতই কমছে যে, সামনে কারখানা চালু রাখতে পারব কি না এ নিয়ে আশঙ্কা আছে। এরই মধ্যে উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হওয়ায় দেনার দায়ে জর্জরিত শিল্প মালিকদের অনেকে কারখানা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন। এতে থমকে যাচ্ছে শিল্প বিনিয়োগ, কমছে রপ্তানি আয়ও। বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) তথ্য অনুযায়ী দেশে বিদ্যুৎ খাতে সবচেয়ে বেশি ৩৯২ দশমিক ৪৫ (৪৩%) গ্যাস দেওয়া হচ্ছে। এরপর শিল্পে দেওয়া হচ্ছে ১৬৮ দশমিক ২১ (১৮%)। ক্যাপটিভে ১৫৩ দশমিক ৬২ (১৭%)। আবাসিকে ১০০ দশমিক ২০ (১১%)। সার উৎপাদনে ৫০ দশমিক ৪০ (৫%)। সিএনজিতে ৪৫ দশমিক ০৬ (৫%)। বাণিজ্যিক খাতে ৫ দশমিক ২৪ (১%)। চা বাগানে ১ দশমিক ১৭(০%) গ্যাস দেওয়া হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চট্টগ্রাম, গাজীপুর, সাভার, নারায়ণগঞ্জ, রূপগঞ্জ ও নরসিংদীর শিল্প কারখানাগুলোতে চাহিদামতো গ্যাস না পেয়ে উৎপাদন অর্ধেকে নেমেছে। অনেক শিল্প এলাকায় মালিকদের নিজস্ব গ্যাসচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা থাকলেও গ্যাসের সংকটে তা আর কাজে আসছে না। শিল্প মালিকরা বলছেন, গ্যাসের চাপ তিন ভাগের একভাগে নেমে এসেছে। এ দিয়ে উৎপাদন ধরে রাখা বেশ কষ্টের।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. সালেউদ জামান খান গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রূপগঞ্জের ভুলতায় অবস্থিত আমার কারখানায় এ মুহূর্তে গ্যাসের চাপ ১৫ পিএসআই থাকার কথা কিন্তু আছে মাত্র ২ পিএসআই। আমরা ক্রেতার অর্ডার ধরে রাখতে উচ্চমূল্যে ডিজেল কিনে কারখানার উৎপাদন ধরে রাখছি। বর্তমানে সক্ষমতার মাত্র ৫০ শতাংশ উৎপাদন করতে পারছি। আমাদের অবস্থা খুবই শোচনীয়।
কলাবাগান লেকসার্কাসের বাসিন্দা নাজনীন আহমেদ বলেন, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত গ্যাসের চুলার চাপ এতই কম থাকে যে রান্নার কাজ এখন গভীর রাতে করতে হয়। অনেক সময় দুপুরের খাবার বাইরে থেকে এনে খেতে হয়। দিনে ঘরের চুলা জ্বলেই না। মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যানের বাসিন্দা শামীমা আক্তার বলেন, প্রতিমাসে গ্যাসের বিল পরিশোধ করেও গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। দিনে তো নয়ই আগে গভীর রাতে মিটমিট করে চুলা জ্বলেও কয়েক মাস ধরে দিনে ও রাতে কখনই গ্যাসের চুলা জ্বলছে না। মিরপুর ১২ নম্বর এলাকার মিরপুর সিরামিক ওয়ার্কস সিএনজি ফিলিং স্টেশনে গত কয়েকদিন ধরে সকাল থেকে গ্যাস নিতে গাড়ির দীর্ঘ লাইন দেখা যাচ্ছে। ভাটারা এলাকার এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের গাড়িচালক আবদুর রহিম বলেন, ঢাকার সিএনজি স্টেশনগুলোতে গত এক মাস ধরে গ্যাস নিতে গিয়ে ভোগান্তিতে পড়ছি। গ্যাসের চাপ এতই কম যে কয়েক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে গ্যাস নিতে হয়। তবুও চাহিদামতো গ্যাসও পাওয়া যায় না। পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইনস) প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম গতকাল বলেন, আমরা বর্তমানে ২৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস দৈনিক দিতে পারছি। আর বিপরীতে গ্যাসের চাহিদা প্রায় ৪ হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের কাছাকাছি। এর মধ্যে গরমে চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিদ্যুৎ খাতে এখন গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। মোট সরবরাহকৃত গ্যাসের মধ্যে ১০৫০ মিলিয়ন গ্যাসই এখন বিদ্যুৎ উৎপাদনে দেওয়া হচ্ছে।
পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা জানান, দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য চেষ্টা চলছে। এ জন্য পুরোনো কূপগুলো সংস্কারের পাশাপাশি স্থলভাগে নতুন কূপ খননের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। তবে এটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। দেশীয় গ্যাস সংকটের কারণে এলএনজির ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে।
তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি পিএলসির অপারেশন ডিভিশনের মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী কাজী মো. সাইদুল হাসান বলেন, বর্তমানে দেশীয় গ্যাস ও এলএনজি মিলে আমাদের সরবরাহ কম আছে। এখন দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ১৯৬৩ মিলিয়ন ঘনফুট। এর বিপরীতে পাচ্ছি ১৫৩০ মিলিয়ন ঘনফুট। অর্থাৎ ঘাটতি আছে ৪৩৩ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের। পেট্রোবাংলাকে বলেছি যে, অন্তত ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস অতিরিক্ত দেওয়া হলেও চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করতে পারব। কিন্তু গরমে বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধিতে সরকার বিদ্যুৎ খাতে গ্যাস সরবরাহে প্রাধান্য দিচ্ছে। এর প্রভাবে শিল্প ও আবাসিকে গ্যাসের সংকট তৈরি হয়েছে। তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ আরও জানান, মে মাসের মাঝামাঝি ও জুনে গ্যাস সরবরাহ কিছুটা বাড়বে। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রায় ৪০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আসবে দেশীয় উৎস থেকে। আর এলএনজি থেকে ৬০ থেকে ৭০ মিলয়ন ঘনফুট গ্যাস বাড়তি আসবে। আবার এখন এলএনজি থেকে ৮৪০ মিলিয়ন ঘনফুট এলেও মে মাসের মাঝামাঝিতে ৯০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আসবে। জুনের ২ তারিখ থেকে আরও ৫০ মিলিয়ন ঘনফুট বাড়ার সম্ভাবনা আছে। আশা করা যাচ্ছে তখন পরিস্থিতি কিছুটা সহনীয় হবে।