
স্বস্তির গণপরিবহন হিসেবে জনপ্রিয়তা পেয়েছে মেট্রোরেল। চলাচলের সময় কয়েক ধাপে বাড়ার সঙ্গে মেট্রোরেলে বেড়েছে যাত্রীর সংখ্যা। বর্তমানে প্রতিদিন যাতায়াত করছে চার লক্ষাধিক যাত্রী। কিন্তু বিভিন্ন কারণে নগরবাসীর প্রিয় গণপরিবহনে সমস্যা দেখা দিচ্ছে। সমস্যাগুলোর মধ্যে কিছু কারিগরি সমস্যা এবং কিছু ব্যবস্থাপনাগত সমস্যা রয়েছে।
২০২২ সালের ডিসেম্বরে মেট্রোরেল সেবা চালুর পর থেকে কয়েক দফা মেট্রোরেলের চলাচল বিঘ্নিত হয়েছে। এর মধ্যে মেট্রোরেলের বৈদ্যুতিক তারে ঘুড়ি, ফানুস কিংবা গ্যাস বেলুন উড়ে এসে পড়া, বৈদ্যুতিক ত্রুটি, সার্কিট পুড়ে যাওয়া অন্যতম। সর্বশেষ গত শনিবার বৈদ্যুতিক ত্রুটির কারণে মেট্রোরেল পৌনে দুই ঘণ্টা বন্ধ ছিল। এ সময় মেট্রোতে আটকে পড়া যাত্রীদের পড়তে হয়েছে চরম ভোগান্তিতে।
ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) সূত্র জানিয়েছে, মেট্রোরেলে দুইভাবে বিদ্যুত্ ব্যবহার করা হয়। স্টেশনের বাতি, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাসহ অন্যান্য কাজ চালানো হয় অক্সিলারি বা সহযোগী বিদ্যুত্ বিতরণ ব্যবস্থার মাধ্যমে। আর বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে মেট্রো ট্রেন চালানোর বিদ্যুত্ সরবরাহ করা হয়। ঐদিন বিজয় সরণিতে ট্রেন চলাচলের মূল লাইনে সমস্যা দেখা দেওয়ায় ট্রেন চলাচল বিঘ্নিত হয়। সূত্র জানায়, কোনো একটি সাবস্টেশন থেকে সাধারণ কারণে বিদ্যুত্ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে অন্য সাবস্টেশন থেকে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সরবরাহ করা হয়। এতে মেট্রোরেলের চলাচলে কোনো বিঘ্ন ঘটে না। কিন্তু কোনো অস্বাভাবিক কারণে, অর্থাত্ কারিগরি ত্রুটি কিংবা সার্কিট পুড়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটলে অন্য সাবস্টেশন থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিদ্যুত্ সরবরাহ করা যায় না। কারণ এতে বড় দুর্ঘটনা বা অন্য সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। এ জন্য অস্বাভাবিক কোনো কারণে বিদ্যুত্ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে তা সচক্ষে দেখে পুনরায় চালু করা হয়। সচক্ষে দেখার জন্য কর্মকর্তাদের সড়ক পথে উত্তরা ডিপো থেকে ঘটনাস্থলে গিয়েছিল। এ জন্য মেট্রোট্রেন চালু হতে সময় বেশি লেগেছে।
ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন) মোহাম্মদ ইফতিখার হোসেন জানিয়েছেন, যান্ত্রিক সমস্যা স্বাভাবিক ঘটনা। তিনি জানান, ফিউজ পুড়ে যাওয়ার কারণে শনিবার বৈদ্যুতিক ত্রুটির ঘটনা ঘটেছিল। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মেট্রোরেল আমাদের দেশে প্রথম চলাচল শুরু হয়েছে। অভ্যস্ত ছিল না বলেই প্রথম দিকে মানুষের কিছুটা সমস্যা ছিল। মানুষ এখন অনেক সচেতন হয়েছেন।
তবে ব্যবস্থাপনাগত সমস্যার কারণেই যাত্রীরা অধিক ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা র্যাপিড পাসের সংকট।
র্যাপিড পাশের সংকটে ভোগান্তিতে মেট্রোরেল যাত্রীরা : মেট্রোরেলের ভাড়া পরিশোধে স্থায়ী কার্ড র্যাপিড পাশের চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। কিন্তু এ কার্ডের চাহিদা মেটাতে পারছে না মেট্রোরেল নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্বে থাকা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। ফলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে একক যাত্রার পাশ কিনে যাতায়াত করছেন যাত্রীরা। মেট্রোরেলে তিন ধরনের কার্ড ব্যবহূত হচ্ছে। এর মধ্যে স্থায়ী কার্ড হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে র্যাপিড ও ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি) পাস। অস্থায়ী হিসেবে একক যাত্রার পাশ বিক্রি হয়। এর মধ্যে এমআরটি বা র্যাপিড পাশে যাতায়াত করলে টিকিটের মূল্যে ১০ শতাংশ ছাড় পাওয়া যায়। এ কারণে প্রতিদিন হাজারো মানুষ এ কার্ডের জন্য ভিড় করছেন। এ কারণে মেট্রোরেলে ভ্রমণে চরম ভোগান্তিতে পড়ছেন যাত্রীরা। ডিএমটিসিএলের দাবি, সরকারের অনুমোদন না থাকায় ডিএমটিসিএল নিজেরা র্যাপিড কার্ড সংগ্রহ করতে পারছে না। এ কার্ড সংগ্রহে দায়িত্বে রয়েছে আরেক সরকারি সংস্থা ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ)। ডিএমটিসিএল সূত্র জানায়, ডিটিসিএ একটি প্রকল্পের আওতায় জাপানের নিপ্পন সিগন্যাল কোম্পানি থেকে ৩ লাখ ১৩ হাজার একক যাত্রার এবং ৭ লাখ ২৮ হাজার এমআরটি পাস কেনে। ২০২৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত সেগুলো বিক্রি হয়।
জানা গেছে, যাত্রী চাহিদা মেটাতে গত জানুয়ারিতে প্রাইম পাওয়ার সলিউশন নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে আড়াই লাখ র্যাপিড পাস সরবরাহের দায়িত্ব দেয় ডিটিসিএ। তারা ইন্দোনেশিয়া থেকে কার্ড আমদানি করে ডিএমটিসিএলকে দিচ্ছে। চলতি মাসের মধ্যে তাদের সব কার্ড সরবরাহের কথা। তবে এখন পর্যন্ত তারা মাত্র ১ লাখ ১৮ হাজার র্যাপিড পাশ সরবরাহ করতে পেরেছে।
ডিএমটিসিএলের এক কর্মকর্তা জানান, এখন মেট্রোরেলে দিনে ৪ লাখের বেশি যাত্রী যাতায়াত করে। মোট যাত্রীর প্রায় ৬০ শতাংশই র্যাপিড ও এমআরটি পাস ব্যবহার করে। বাকি ৪০ শতাংশ যাত্রী ব্যবহার করে একক যাত্রার কার্ড। কিন্তু এখন মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের কাছে বিক্রি করার মতো র্যাপিড ও এমআরটি পাস আছে খুব কম। ফলে প্রতিদিনই কার্ড কিনতে গিয়ে যাত্রীরা খালি হাতে ফিরছেন। অথচ ডিটিসিএর ঠিকাদার সময়মতো কার্ড সরবরাহ করতে পারছে না। ছয় মাস ধরে এভাবেই চলছে।
এ ব্যাপারে ডিটিসিএর নির্বাহী পরিচালক নীলিমা আখতার জানান, ইতিমধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ কার্ড চলে আসছে। বাকি কার্ড চলতি মাসের মধ্যেই চলে আসবে।
চলতি বছর কমলাপুর যাচ্ছে না মেট্রোরেল : মেট্রোরেল নির্মাণ ও পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত সম্প্রসারিত ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট লাইন-৬ (এমআরটি লাইন-৬) এর কাজ চলতি বছর শেষ হচ্ছে না। ফলে এ পথে এখনই মেট্রোরেলের সুবিধা পাচ্ছেন না যাত্রীরা। এজন্য অপেক্ষা করতে হবে অন্তত আরো দেড় বছর। এই বিলম্বের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা গেছে, মতিঝিল-কমলাপুর অংশে সিভিল ওয়ার্ক চলমান থাকলেও ইলেকট্রোমেকানিক্যাল কাজ নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে। আপাতত এ অংশের কাজ বন্ধ রয়েছে। এ বিষয়ে ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের (লাইন-৬) প্রকল্প পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) মো. জাকারিয়া জানান, মূলত বাজেটসংক্রান্ত জটিলতার কারণেই কাজে বিলম্ব হচ্ছে। তিনি আরো জানান, যদি এ জুনের মধ্যে ইলেকট্রোমেকানিক্যাল কাজে ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি করা সম্ভব হয় তাহলে ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ হবে।
অন্যদিকে যাত্রীর চাপ বেড়ে যাওয়ায় মেট্রোরেলে চড়তে গিয়ে প্রায় প্রতিদিনই যাত্রীদের মধ্যে হচ্ছে বাগিবতণ্ডা। ঘটছে পকেটমারির ঘটনা। এছাড়াও প্ল্যাটফরমের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, লিফট ও এসকেলটর ব্যবস্থাপনায় ঘাটতির অভিযোগ করেছেন অনেকেই। এসব সমস্যা নিরসনে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। গত শনিবার পৌনে দুই ঘণ্টা বন্ধ থাকার ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং বিভিন্ন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
মেট্রোরেলে ত্রুটি হলে কারিগরি টিমকে ১৫ মিনিটের মধ্যে পৌঁছাতে হবে : মেট্রোরেল বন্ধ হলে ত্রুটি সারাতে কারিগরি টিমকে ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যে পৌঁছানোর নির্দেশ দিয়েছেন বিদ্যুত্, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান।
মেট্রোরেলে সেবা বিঘ্নিত হলে টেলিভিশন স্ক্রলে জানানোর নির্দেশনা :বিদ্যুত্, মেট্রোরেল, সড়ক ও রেলপথে গ্রাহক কিংবা যাত্রীসেবা বিঘ্নিত হলে টেলিভিশনে স্ক্রলের মাধ্যমে জানানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যাত্রীসেবা আবার চালু হলে, সেটাও জানিয়ে ঘটনার জন্য দুঃখপ্রকাশ করতে হবে।
যাত্রী নিরাপত্তায় মেট্রোরেলের ভেতরে এমআরটি পুলিশ :যাত্রীদের বাড়তি নিরাপত্তার স্বার্থে মেট্রোরেলের প্রতিটি ট্রেনে গত ৪ মার্চ থেকে দুই জন করে এমআরটি পুলিশ সদস্য নিযুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া মেট্রোরেল স্টেশনগুলোতে পর্যাপ্ত এমআরটি পুলিশ সদস্য উপস্থিত রয়েছেন।