
বাংলাদেশের বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ১০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত ফেব্রুয়ারিতে এই প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে মাত্র ৬ দশমিক ৮২ শতাংশে, যেখানে গত বছরের একই সময়ে এটি ছিল ১০ দশমিক ১৩ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চ সুদের হার, বিনিয়োগে অনীহা এবং আমদানি ব্যয়ের সংকোচন এই প্রবৃদ্ধি কমার প্রধান কারণ। বর্তমানে ব্যাংক ঋণের সুদহার ১৫-১৬ শতাংশের মধ্যে থাকায় ব্যবসায়ীরা নতুন বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। যেখানে এক বছর আগে এই হার ছিল ১১-১২ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য নীতিসুদহার ১০ শতাংশের আশপাশে ধরে রেখেছে, যার প্রভাব ঋণের খরচে পড়ছে। এর প্রভাব পড়েছে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির ওপরও। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে এ ধরনের আমদানি কমেছে প্রায় ৩০ শতাংশ।
এছাড়া এ সময়ে এলসি নিষ্পত্তি কমেছে ২৫ দশমিক ২২ শতাংশ। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আট মাসে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি খোলা হয়েছে ১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলারের। এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমে যাওয়া দেশের অর্থনীতির জন্য ভালো খবর নয়। তিনি বলেন, ‘কোনও শিল্প স্থাপনের জন্য মূলধনি যন্ত্রপাতি অপরিহার্য, তবে কয়েক বছর ধরে এর আমদানি কমে গেছে, যার ফলে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধিও ৭ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে।’ তিনি বলেন, ‘চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে নানা বিশৃঙ্খলার মধ্যে বিনিয়োগ কমেছে, তবে রেমিট্যান্স প্রবাহ এবং উদার আমদানি নীতির ফলে অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা রয়েছে।’
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি খাতের পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি কমায় ঋণের চাহিদা হ্রাস পেয়েছে। পাশাপাশি রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে বিনিয়োগকারীরা নতুন প্রকল্পে ঝুঁকছেন না।
বিনিয়োগ স্থবির, প্রশ্নের মুখে কর্মসংস্থান
অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করে বলছেন, বিনিয়োগ বাড়ানো এবং ঋণের প্রবাহ সচল করা এখন জরুরি। নতুবা কর্মসংস্থানের পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে যেতে পারে। প্রতিবছর ২০-২২ লাখ তরুণ শ্রমবাজারে প্রবেশ করলেও কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে মাত্র ১৪-১৫ লাখের জন্য। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, দেশে বেকারের সংখ্যা আনুষ্ঠানিকভাবে ২৭ লাখ হলেও বিশ্লেষকদের মতে—বাস্তব সংখ্যা সোয়া এক কোটি ছাড়িয়ে গেছে।
বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে, কর্মসংস্থান সংকট ও মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়ায় ২০২৫ সালে দেশের দারিদ্র্যের হার ২২ দশমিক ৯ শতাংশে এবং অতি দারিদ্র্যের হার ৯ দশমিক ৩ শতাংশে পৌঁছাতে পারে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের দ্বিতীয়ার্ধে প্রায় ৪ শতাংশ শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। স্বল্প দক্ষ শ্রমিকদের মজুরি ২ শতাংশ এবং উচ্চদক্ষ শ্রমিকদের মজুরি ০.৫ শতাংশ কমেছে। টানা ৪০ মাস ধরে দেশের প্রকৃত মজুরি ধারাবাহিকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। এর ফলে প্রতি পাঁচটি পরিবারের মধ্যে তিনটি পরিবার তাদের সঞ্চয় ভেঙে দৈনন্দিন ব্যয় নির্বাহ করছে। এছাড়া বর্তমানে দেশের শ্রমবাজার এখনও মূলত অনানুষ্ঠানিক ও স্বল্প উৎপাদনশীল খাতের ওপর নির্ভরশীল। বিপুল সংখ্যক মানুষ অনিরাপদ পেশায় নিয়োজিত থাকায় আয় বৈষম্য দিন দিন বাড়ছে, যা সামাজিক-অর্থনৈতিক ভারসাম্যের জন্য উদ্বেগজনক ইঙ্গিত বহন করে।
ঋণ প্রবৃদ্ধির রেকর্ড কমে যাওয়া
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম চালিকাশক্তি হলো বেসরকারি খাতে ঋণ। শিল্প-কারখানা স্থাপন, উৎপাদন বৃদ্ধি, নতুন উদ্যোগ ও কর্মসংস্থান তৈরিতে বেসরকারি খাতে ঋণের সহজলভ্যতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অথচ গত কয়েক মাস ধরেই বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে এসেছে। ফেব্রুয়ারি মাসে নেমেছে মাত্র ৬ দশমিক ৮২ শতাংশে। এর আগের মাস জানুয়ারিতে প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ১৫ শতাংশ। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে যেখানে ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ দশমিক ১৩ শতাংশ, আগস্টে তা কমে ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশে নেমে আসে। এরপর সেপ্টেম্বর থেকে টানা নিম্নমুখী ধারা বজায় রেখে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তা ৬ শতাংশের ঘরে ঠেকেছে। এমন পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাজার থেকে অর্থপ্রবাহ সংকুচিত করার নীতিতে এগোচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর জানিয়েছেন, মূল্যস্ফীতি কমার আগ পর্যন্ত নীতিসুদহার ১০ শতাংশে রাখা হবে। এর ফলে ব্যাংকগুলোর রেপো রেটও বাড়ায় তাদের তহবিলের খরচ বেড়েছে, যা ঋণের সুদহারে প্রভাব ফেলছে। চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৯ দশমিক ৮০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। বাস্তবে প্রবৃদ্ধি নেমে গেছে তারও নিচে।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি খাতের মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশে নেমেছে এবং মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিও ৩০ শতাংশ কমেছে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য উদ্বেগজনক।’ তিনি বলেন, ‘বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার কারণ হলো—উদ্যোক্তাদের নতুন বিনিয়োগে আগ্রহের অভাব এবং মুদ্রানীতি লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়া।’
কী ধরনের প্রভাব পড়ছে?
১. কর্মসংস্থান সংকট: দেশে প্রতিবছর গড়ে ২০-২২ লাখ নতুন কর্মক্ষম মানুষ শ্রমবাজারে আসে। অথচ বর্তমানে তৈরি হচ্ছে সর্বোচ্চ ১৪-১৫ লাখ নতুন কর্মসংস্থান। ফলে প্রতি বছর ৬-৮ লাখ নতুন বেকার যুক্ত হচ্ছে। ইতোমধ্যে দেশে বেকারের প্রকৃত সংখ্যা ১ কোটির কাছাকাছি পৌঁছে গেছে বলে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন।
২. দারিদ্র্য বাড়ছে: বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, ২০২৫ সালে বাংলাদেশের দারিদ্র্যের হার বেড়ে ২২ দশমিক ৯ শতাংশে পৌঁছাতে পারে। কর্মসংস্থান সংকট ও উচ্চ মূল্যস্ফীতি এর মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
৩. অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঝুঁকিতে: নিম্ন বিনিয়োগ প্রবণতা অব্যাহত থাকলে, আগামী বছরগুলোতে বাংলাদেশের সামগ্রিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা কঠিন হবে। ফলে মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণ পরিকল্পনা এবং এসডিজি বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর মতে, বর্তমান সুদের হারে শিল্প প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। ব্যাংকগুলোও ঝুঁকির কথা বলে নতুন ঋণ দিতে চাইছে না। এ প্রসঙ্গে নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘আমার প্রতিষ্ঠানের ব্যাংকঋণের সুদহার বেড়ে ১৬ থেকে ১৭ শতাংশে পৌঁছেছে। এভাবে সুদহার বাড়তে থাকলে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করাই কঠিন হয়ে পড়বে, মূলধন ফেরত দেওয়া সম্ভব হবে না। বর্তমানে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, এতে ঋণখেলাপির পরিমাণ বাড়বে এবং নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ কমে যাবে।’
বিনিয়োগে ৫ বাধা
বাংলাদেশে বেসরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় কম, আর এর পেছনে প্রধানত পাঁচটি বড় বাধা কাজ করছে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা সংস্থা (আইএফসি)। সম্প্রতি প্রকাশিত ‘প্রাইভেট সেক্টর ডায়াগনস্টিক ফর বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। বাধাগুলো হলো:
১. বিদ্যুৎ সমস্যা, ২. অর্থায়নের সীমাবদ্ধতা, ৩. দুর্নীতি, ৪. অনানুষ্ঠানিক খাতের আধিক্য ও ৫. উচ্চ করহার।
জাতিসংঘের (আঙ্কটাড) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বাংলাদেশের এফডিআই প্রায় ১৪ শতাংশ কমে ৩০০ কোটি ডলারে নেমেছে।
আইএফসি'র প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশের বেসরকারি বিনিয়োগ কম এবং জিডিপির তুলনায় তা অপর্যাপ্ত। এটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম প্রতিবন্ধক। প্রতিবছর বিভিন্ন খাতে বিশেষ করে আবাসন, তৈরি পোশাকশিল্প, ডিজিটাল আর্থিকসেবা এবং পেইন্ট ও ডাইস শিল্পে অন্তত ৩৫ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে, যদি এই খাতগুলোর ওপর যথাযথ বিনিয়োগ হয়।
কর্মসংস্থানের চাবিকাঠি দেশীয় বিনিয়োগ
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কর্মসংস্থানের মূল চালিকাশক্তি হলো দেশীয় বিনিয়োগ। উৎপাদন বাড়াতে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে বিনিয়োগের বিকল্প নেই। পরিসংখ্যান বলছে, দেশে কর্মসংস্থান তৈরিতে দেশীয় বিনিয়োগের ভূমিকা বিদেশি বিনিয়োগের তুলনায় অনেক বেশি। তবে নীতিনির্ধারকদের উদ্যোগে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করাকেই বেশি গুরুত্ব দিতে দেখা যায়। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, তাহলে দেশে কর্মসংস্থান বাড়বে কীভাবে?
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০০৯-১০ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত ১০ হাজার ৫৭৫ কোটি ডলারের দেশীয় বিনিয়োগে প্রায় ২৮ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। বিপরীতে ৫ হাজার ৯৪৩ কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগে কর্মসংস্থান হয়েছে মাত্র ৫ লাখ ৪৫ হাজার জনের। হিসাব অনুযায়ী, দেশীয় বিনিয়োগে একজনের কর্মসংস্থান করতে যেখানে ৩৭ হাজার ডলার লাগে, বিদেশি বিনিয়োগে তা প্রায় আড়াই গুণেরও বেশি ৯৩ হাজার ডলার।
বিশ্লেষকদের মতে, দেশীয় বিনিয়োগকারীরা স্থানীয় অর্থনীতির সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত থাকেন। তাদের মুনাফা দেশে থেকেই পুনরায় বিনিয়োগ হয়, ফলে সংযোগ শিল্প গড়ে ওঠে এবং টেকসই কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। কিন্তু বিদেশি বিনিয়োগকারীরা মুনাফার বড় অংশ দেশে ফেরত নিয়ে যান, ফলে কর্মসংস্থানের স্থায়িত্ব এবং পরিমাণ, দুটোই কমে যায়।
তবে, বিদেশি বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না। বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে উচ্চ প্রযুক্তি, কারিগরি জ্ঞান, রফতানি বাজারে প্রবেশ ও অবকাঠামো উন্নয়ন ঘটে। তবে বাস্তব চিত্র বলছে, বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) বাড়ছে না। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে নিট এফডিআই আগের বছরের তুলনায় ৭১ শতাংশ কমেছে।
কী করা দরকার
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য জরুরি ভিত্তিতে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি, ঋণের প্রবাহ সহজ ও সাশ্রয়ী করতে নীতিগত পদক্ষেপ নিতে হবে।
তাদের মতে, দেশীয় বিনিয়োগকারীদের জন্য স্বল্প সুদে ঋণের সুযোগ, অবকাঠামো উন্নয়ন, গ্যাস-বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান, নীতিনির্ধারণে ধারাবাহিকতা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা জরুরি।