Image description

মরণবাঁধ ফারাক্কার ভয়াল থাবায় বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ঘটেছে পরিবেশগত মারাত্মক বিপর্যয়। নদ-নদীর অববাহিকা ছাড়াও দেশের কৃষি প্রধান উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বিশাল এলাকাজুড়ে মরুকরণ ত্বরান্বিত হচ্ছে। রাজশাহীসহ উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে উত্তপ্ত হচ্ছে প্রকৃতি, ঘন ঘন হচ্ছে দাবদাহ। পরিবেশ প্রকৃতি ও প্রাণীকুল হচ্ছে বিপর্যস্ত। বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট এখন নৈমত্তিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ফারাক্কার ভয়াল প্রভাবে দেশের উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে কমছে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ।

এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফারাক্কায় একতরফা পানি প্রত্যাহারের কারণে ভাটিতে বাংলাদেশের নদনদীগুলো বছরের ৮ মাসই পানিশূন্য থাকছে। প্রকৃতি ক্রমশঃ রুক্ষ ও শুষ্ক হয়ে পড়ছে। মাটিতে আর্দ্রতার পরিমাণ কমে গেছে। পদ্মা তীরবর্তী ও সংলগ্ন ১২টি জেলায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে গড় বৃষ্টিপাত। এসব জেলার খালবিল, ডোবা, পুকুর, প্লাবনভূমি, জলাশয়গুলোতেও বছরের অধিকাংশ সময় আর পানি থাকছে না। ফলে কৃষি, মৎস্য ও গবাদিপশু পালনে নতুন নতুন সংকট তৈরি হয়েছে। এখন এসব অঞ্চলের কোটি কোটি মানুষের পানির একমাত্র উৎস হয়ে উঠেছে ভূগর্ভস্থ পানি। তবে ক্রমবর্ধমান পানি উত্তোলনের ফলে ভূগর্ভেও পানির টান পড়েছে। বিশেষ করে রাজশাহীসহ বিস্তীর্ণ বরেন্দ্র অঞ্চলে ১৫০ ফিট খনন করেও গভীর নলকূপে আর পানি পাওয়া যাচ্ছে না। বরেন্দ্র অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষকে বিশুদ্ধ খাবার পানি পেতে প্রতিনিয়ত লড়াই সংগ্রাম করতে হচ্ছে। পানির অভাবে মানুষ গবাদিপশু পালন করতে পারছে না। মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত পুকুর, ডোবা, জলাশয় ফেটে চৌচির হয়ে পড়ছে। সবুজ মাঠ শুকিয়ে হচ্ছে বিবর্ণ।

পরিবেশ বিজ্ঞানীরা আরও বলছেন, ফারাক্কায় পানি প্রত্যাহারে পদ্মা নদী ও অববাহিকায় পরিবেশ ও প্রতিবেশের ওপর ভয়ংকর প্রতিকূল প্রভাব গত দুই দশক ধরেই দৃশ্যমান হয়েছে। দেশের উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের কৃষি, মৎস্য, বনজ, জলজ, শিল্প ও পানি সরবরাহ খাত ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে। ফারাক্কার প্রভাবে এই অঞ্চলের পরিবেশ ও প্রতিবেশগত ক্ষতির পরিমাণ ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে বলে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন। গঙ্গার পানির সিংহভাগ একতরফাভাবে প্রত্যাহারে পদ্মার উজানে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ভাটিতে ফরিদপুর পর্যন্ত ২৫০ কিলোমিটার নদী অঞ্চলে বসবাসকারী আড়াই কোটি মানুষ এখন সারা বছরই পানির কষ্টে ভোগেন। পদ্মার পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় উপকূল এলাকায় পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণও বেড়েছে। এর নেতিবাচক প্রভাব দেখা গেছে সুন্দরবনের গাছপালা ও জলজ সম্পদের ওপরেও। পবিবেশ বিজ্ঞানীদের গবেষণায় বলা হচ্ছে, পদ্মার বুক চিরে ছোট-বড় তিন হাজারের বেশি চরে বসবাসকারী কোটি মানুষ বছরের অধিকাংশ সময় টিউবওয়েলের পানি পান না। যে সামান্য পরিমাণ পানি পাওয়া যায় তাতেও আর্সেনিকের মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতির ফলে লাখ লাখ মানুষকে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ফেলেছে।

বাংলাদেশ ওয়াটার রিসোর্স প্ল্যানিং ওরগানাইজেশনের (ওয়ারপো) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পদ্মা অববাহিকা তথা রাজশাহী অঞ্চলের চার জেলার বিস্তীর্ণ এলাকায় পানি স্তর আশঙ্কাজনক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। রাজশাহী তথা উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ৭১ শতাংশ এলাকায় মাঝারি, উচ্চ ও অতি উচ্চমাত্রার ঝুঁকিতে পড়েছে ভূগর্ভস্থ পানি স্তর। চার দশক আগে রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলের তানোর, গোদাগাড়ী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল ও গোমস্তাপুর ও নওগাঁর, সাপাহার, পোরশা, নিয়ামতপুরসহ আরও কয়েকটি এলাকায় মাটির ৮০ ফিট তলেই পানিস্তর ছিল। এখন সেখানে ১৫০ ফুট খনন করেও পানি মিলছে না। এসব এলাকায় স্থাপিত বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রায় তিন শতাধিক গভীর নলকূপ আংশিক ও পুরোপুরি অকেজো হয়ে পড়েছে।

রাবির পরিবেশ বিজ্ঞান ইনিস্টিটিউটের এক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ফারাক্কার পানি প্রত্যাহারের ফলে দেশের উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদনদীগুলো শুধু পানি শূন্য হয়ে পড়েনি, পদ্মা অববাহিকায় পানির আধার হিসাবে থাকা ৩৩ হাজার ৬৮০ হেক্টর বিল, ৮৪ হাজার ৪৯৮টি পুকুর, ৬ লাখ ১০ হাজার ৪৬৭ হেক্টর প্লাবনভূমি পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ পরিপালনে এসব পানির উৎস্য যুগ যুগ ধরে ব্যবহার হয়ে আসছিল। বিলগুলোতে এখন আর কোনো মাছই পাওয়া যায় না। বিল ও প্লাবনভূমির পুরোটাই পলি দিয়ে ভরাট হয়ে এখন সর্বত্র ফসলের আবাদ হচ্ছে। অন্যদিকে খাল-বিল, ডোবা-পুকুর, জলাশয় ও প্লাবনভূমিগুলো পলিতে ভরাট হওয়ায় অসময়েও নদী ভাঙনের শিকার হচ্ছে নদীকূল তীরবর্তী মানুষেরা।

সম্প্রতি রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার পদ্মা তীরবর্তী চরআষাড়িয়াদহ ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, নদীর বুকে বসবাস করেও চরাঞ্চলের মানুষ সারা বছরই পানীয় জলের কষ্টে ভুগছেন। চরভুবনপাড়া গ্রামের আশরাফুল ইসলাম বলেন, ফারাক্কার প্রভাবে পদ্মা এখন প্রায় পানি শূণ্য। চারদিকে ধু ধু বালুচর। আগে পদ্মার পানি ছিল গরু মহিষসহ গবাদি পশু পালনে পানির বড় উৎস। এখন তো পদ্মায় পানি নেই। পদ্মার বুক চিরে একটা সরু নালা বয়ে যাচ্ছে তাও গ্রামগুলো থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে। এখন বছরে একবারও গবাদিপশুকে গোসল করাতে পারি না। আগে হস্তচালিত নলকূপ ছিল চরাঞ্চলের মানুষের পানীয় জলের একমাত্র উৎস। কিন্তু এখন টিউবওয়েলে আর পানি উঠে না। এখন গ্রামে গ্রামে মোটর দিয়ে ভূগর্ভের পানি তুলে পান করি, রান্নাবান্নার কাজে ব্যবহার করি। শীতের কয়েকটা মাস বাদ দিলে সারা বছরই তাপপ্রবাহ চলে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের সাম্প্রতিক এক গবেষণষায় উঠে এসেছে গত ৩৬ বছর ধরে পদ্মা অববাহিকায় মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত সময়ে তাপপ্রবাহের মেয়াদকাল বাড়ছে। পাশাপাশি কমছে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ। পদ্মায় নাব্য হ্রাস ছাড়াও খাল, বিল, ডোবা, জলাশয় শুকিয়ে যাওয়ায় রাজশাহী অঞ্চলে উষ্ণতা ফিবছর বাড়ছে।

এদিকে রাজশাহী অঞ্চলের তাপমাত্রা ক্রমশ অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে বলে আঞ্চলিক আবহাওয়া দপ্তরের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। রাজশাহী অঞ্চলে মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত সময়ে গড় তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৪০ ডিগ্রি পর্যন্ত উঠছে। আবহাওয়ার এই চরম বৈরিতা মাসের ২০ দিনই ঊর্ধ্বমুখী থাকছে। ফলে অঞ্চলের জনজীবন ও প্রাণীকুলের জন্য অসহনীয় হয়ে উঠছে। রাজশাহীর পরিবেশকর্মী কামাল উদ্দিন বলেন, ফারাক্কার প্রভাবে পানি শূন্য পদ্মার বুকে এখন অসংখ্য বালুচর। গরমকালে এসব বালুস্তর তপ্ত হয়ে অতি গরম হাওয়া প্রকৃতিতে ঢুকছে। মরুভূমির মতো অতি শুষ্ক হাওয়ায় গাছ পালা পুড়ে যাচ্ছে।

অন্যদিকে ফারাক্কা বাঁধের কারণে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের পরিবেশের ভারসাম্য মারাত্মকভাবে নষ্ট হচ্ছে বলে পরিবেশ বিজ্ঞানীদের বিভিন্ন সময়ে গবেষণায় উঠে এসেছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. চৌধুরী সারওয়ার জানান বলেন, ফারাক্কার প্রভাবে পদ্মাসহ ভাটির নদীগুলো বছরের বেশিরভাগ সময়ই পানিশূন্য থাকছে। ফলে ভূ-প্রকৃতি ক্রমশঃ উত্তপ্ত হচ্ছে। এতে দেশের পদ্মা সংলগ্ন বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে মাটিতে আর্দ্রতার পরিমাণ কমে গেছে। ফলে বছর বছর অঞ্চলের ভূ-প্রকৃতি আরও তপ্ত হচ্ছে। একই কারণে অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানি স্তর নিচে নামছে। বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানি স্তর রিচার্জ হচ্ছে না। মাটিতে আর্দ্রতা কমে যাওয়ায় গাছপালার পর্যাপ্ত পানি পাচ্ছে না। এর ফলে গাছপালা খর্বাকৃতির হচ্ছে। এছাড়া জলবায়ু জনিত সংকট তীব্রতর হচ্ছে। প্রকৃতি পরিবেশ ও পরিবেশ চরম বিপন্নতার দিকে যাচ্ছে।

এদিকে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের সর্বশেষ প্রতিবেদনে জানা গেছে, পদ্মা বিধৌত অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির জোগান দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। দুই দশক আগে রাজশাহী অঞ্চলের জেলাগুলোতে স্থাপিত ১০ হাজার ২৩৫টির বেশি হস্তচালিত নলকূপ পুরোপুরি অকেজো হয়ে গেছে। অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ এখন পানীয় জলের জন্য বিকল্প উৎসের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী রেজাউল করিম বলেন, ভূগর্ভের পানির জোগান দ্রুত হ্রাস পেলে এলাকায় মরু প্রবণতা বাড়ে। এই প্রবণতা রোধে দ্রুত সময়ে পরিকল্পনামাফিক পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।