Image description

এস আলমের দখল করা দেশের ৮টি ইসলামী ব্যাংক থেকে অর্থ পাচার করা হতো অভিনব কায়দায়। ঋণ অনুমোদন ছাড়াই জালজালিয়াতির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা বের করে নেয়া হয় ব্যাংক থেকে। আর এ জালজালিয়াতির অন্যতম মাধ্যম ছিল ব্যাংকগুলোর আইটি বিভাগ। ইসলামী ব্যাংকের এক শাখা থেকেই এভাবে ২২ হাজার কোটি টাকা বের করে নেয় এস আলম। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত বিভাগ এ অভিনব কায়দায় ঋণ জালিয়াতির চিত্র থেকে হতবিহ্বল হয়ে পড়েছে। তারা অধিকতর তদন্তের জন্য ইতোমধ্যে মাঠে কাজ শুরু করে দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক দায়িত্বশীল সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, এস আলমের পিএস আকিজ উদ্দিন, মিফতা উদ্দিন ও মোকাম্মেল হোসেন ছিল এ অভিনব টাকা বের করার প্রধান কারিগর। তিনজনকেই পুরস্কার হিসেবে এস আলমের দখল করা ব্যাংকগুলোর বড় বড় পদে বসানো হয়। এর মধ্যে মোকাম্মেল হোসেনকে ইউনিয়ন ব্যাংকের এমডি পদে বসানো হয়। আকিজ উদ্দিনকে বসানো হয় ইসলামী ব্যাংকের ডিএমডি পদে। ডিএমডি হিসেবে বসেই ওই সময় ইসলামী ব্যাংকের প্রায় সব সিদ্ধান্তই নিতেন তিনি। এমডি হিসেবে মনিরুল মাওলার তেমন কোনো ক্ষমতা ছিল না। আকিজ উদ্দিন যে সিদ্ধান্ত নিতেন তাই মানতে বাধ্য থাকতেন তৎকালীন এমডি। আর মিফতা উদ্দিনকে কয়েক দফা বিশেষ পদোন্নতি দিয়ে ডিএমডি পদে বসানো হয়। আকিজ ও মিফতার কূটকৌশলেই ব্যাংক থেকে টাকা বের করে নেয়া হতো আইটি বিভাগের মাধ্যমে।

এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত টিমের একাধিক সদস্য গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক থেকে আইটি বিভাগের মাধ্যমে কোনো প্রকার ঋণের অনুমোদন না নিয়েই হাজার হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়েছে। যেমন, ইসলামী ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজের ঋণ নেয়ার সর্বোচ্চ সীমা ছিল ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। কিন্তু ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর নিয়মিত পরিদর্শনে বাংলাদেশ ব্যাংক দেখতে পায় আলোচ্য প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নেয়া হয়েছে ৩ হাজার ৮৫৪ কোটি টাকা। এখানে ঋণ বেশি নেয়া হয়েছে ৫৪ কোটি টাকা। এ হিসাবে ৫৪ কোটি টাকা সীমা অতিরিক্ত ঋণ নেয়ায় তা সমন্বয় করার কথা। কিন্তু আলোচ্য প্রতিষ্ঠানের নামে আবারও নতুন করে যখন ঋণ নেয়া হয়, তখন ঋণ দেখানো হয়েছে মাত্র ১০০ কোটি টাকা। ৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকা সীমার চেয়ে কম দেখানো হয়। আবারও নতুন করে ওই শাখা থেকে ৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকা ঋণ নেয়া হয়। এভাবে কম্পিউটারের মাধ্যমে ঋণ তথ্য মুছে জালজালিয়াতির মাধ্যমে নতুন করে বার বার ঋণ নেয়া হয়। আর এ কাজে সরাসরি সহযোগিতা করেছে তৎকালীন প্রধান কার্যালয়ের আইটি বিভাগের কর্মকর্তারা। আর অপকর্মের নির্দেশ দাতা ছিলেন আকিজ উদ্দিন ও মিফতা উদ্দিন। আবার এস আলম কোল্ড রোলড স্টিলস ঋণসীমা যেখানে দেখানো হয় ২ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু একই কায়দায় ঋণ নেয়া হয় কয়েকগুণ বেশি। এ ক্ষেত্রে ঋণের সর্বোচ্চ সীমা ও একক ঋণগ্রহীতার সীমাও মানা হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত দল এ অভিনব কায়দায় অর্থ বের করে নেয়ার চিত্র দেখে হতবিহ্বল হয়ে পড়েছেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তারা দেখতে পান নতুন করে ঋণের অনুমোদন নেয়া হয়নি। প্রতিবারই ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে আইটি বিভাগের মাধ্যমে ঋণ নেয়ার পরিমাণ শূন্য দেখানো হয়েছে। কখনো কখনো ১০ কোটি টাকা দেখানো হয়। এভাবে কম্পিউটারের মাধ্যমে অসংখ্যবার ঋণ তথ্য মুছে ফেলা হয়েছে। বারবারই নতুন নতুন ঋণ নেয়া হতো। এভাবে ২০১৭ সাল থেকে ২০২৪ সালের জুলাইয়ের আগ পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা বের করে নেয়া হয়েছে। এ অভিনব জালিয়াতি সম্পর্কে ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী থেকে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা পর্যন্ত জানতেন। কিন্তু চাকরি হারানো ও হয়রানির ভয়ে কেউ মুখ খুলতেন না। এমনকি নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ইন্সপেক্টররাও এসব অনিয়ম তাদের তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করতে সাহস পেতেন না। কারণ, তৎকালীন গভর্নর থেকে ডেপুটি গভর্নর এবং মাঠ পর্যায়ের কিছু কর্মকর্তা পর্যন্ত সবাই ছিলেন এস আলমের সুবিধাভোগী।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, এস আলম ব্যাংকগুলো থেকে দুই লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়েছেন, যার বেশির ভাগই নেয়া হয়েছে ঋণ অনুমোদন ছাড়া জালজালিয়াতির মাধ্যমে। শুধু ঋণ অনুমোদন ছাড়াই ঋণ নেননি, অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট থেকেও হাজার হাজার কোটি টাকা বের করে নেয়া হয় অভিনব কায়দায়। এ ক্ষেত্রে কোনো নিয়মনীতি মানা হতো না।

যেমন- ইসলামী ব্যাংকের অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের মাধ্যমে এস আলমের ঋণ নেয়ার সর্বোচ্চ সীমা ছিল মোট নিয়ন্ত্রক মূলধনের ৩০ শতাংশ, যা অঙ্কের হিসেবে ২৮ কোটি ৭০ লাখ মার্কিন ডলার। কিন্তু ২০২৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঋণ নেয়া হয় ১২৫ কোটি মার্কিন ডলার, যা মোট নিয়ন্ত্রক মূলধনের ১৩০ শতাংশ। শুধু ইসলামী ব্যাংক থেকে নয়, এমন আরো ৮টি ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা বের করে নেয়।

ইসলামী ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ইসলামী ব্যাংকের ওপর এমন প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকার দায়সৃষ্টি করে এস আলম। এর মধ্যে এস আলম ভেজিটেবল অয়েলের মাধ্যমে ২৮ কোটি ডলার, ইনফিনা সিনথেটিক ফাইবার কোম্পানির বিপরীতে ৯৩ লাখ ডলার, এস আলম সুপার এডিবল অয়েলের বিপরীতে সাড়ে ৪৮ কোটি মার্কিন ডলার, এস আলম স্টিলসের বিপরীতে সাড়ে সাত লাখ মার্কিন ডলার, এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ড্রাস্ট্রিজের বিপরীতে ২০ কোটি ৩৫ লাখ মার্কিন ডলার দায় সৃষ্টি করা হয়। আবার এস আলম কোল্ড রোলেসের বিপরীতে দুই কোটি চার লাখ ডলার দায় সৃষ্টি করা হয়। আবার বিভিন্ন ব্যাংকের অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে এস আলম বৈদেশিক মুদ্রায় যে ঋণ নেয়া হয়, তা-ও পরবর্তীতে ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে পরিশোধ করে ইসলামী ব্যাংকের ওপর দায় সৃষ্টি করে এস আলম। আর এ অপকর্মে সরাসরি ভূমিকা রাখে আকিজ উদ্দিন। যেমন, সোনালী ব্যাংকের ২২ কোটি ৪৬ লাখ মার্কিন ডলার, এক্সিম ব্যাংকের এক কোটি ৬৬ লাখ মার্কিন ডলার, জনতা ব্যাংকের ৮ কোটি ৮৪ লাখ ডলারের দায় ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে পরিশোধ করা হয়।

সংশ্লিষ্ট এক সূত্র জানিয়েছে, ইসলামী ব্যাংক থেকে বেশি মূল্যে ডলার কিনে এস আলমের পাচারের অর্থ পরিশোধ করতে বাধ্য করা হয় কিছু কর্মকর্তার মাধ্যমে। এভাবে অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংক থেকে ১৬০ কোটি ডলার ঋণের নামে পাচার করে এস আলম। যেখানে ভালো গ্রাহকরা ডলারের সঙ্কটের কারণে এলসি খুলতে পারেনি, সেখানে এস আলমকে পানির মতো বৈদেশিক মুদ্রা বের করে দেয়া হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এ বিষয়ে একাধিক তদন্ত টিম মাঠে কাজ করছে। এসব অভিনব জালিয়াতি দেখে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, ইসলামী ব্যাংকগুলোতে যতই তদন্ত করা হচ্ছে ততই অবাক করার মতো ঘটনা বের হয়ে আসছে। ব্যাংকগুলো থেকে মহাডাকাতি করা হলেও তৎকালীন কর্তৃপক্ষ ছিল নিশ্চুপ। রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে জনগণের সম্পদ এভাবে ডাকাতি করা বিশ্বে আর কোথায় নেই বলে তারা মনে করছেন।