Image description
 
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর প্রীতি সমাবেশে বিতর্কিত সাংবাদিক কালবেলা সম্পাদক সন্তোষ শর্মার উপস্থিতি নিয়ে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। গত বুধবার রাজধানীর একটি মিলনায়তনে এ প্রীতি সমাবেশে ভিন্নধর্মাবলম্বীদের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
 
 
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন কমিটির পক্ষ থেকে সন্তোষ শর্মা অনুষ্ঠানে অংশ নেন, যা রাজনৈতিক এবং সাংবাদিক মহলে তীব্র বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এতে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক, ধর্মীয় এবং সাংবাদিক ব্যক্তিত্ব।
 
অনুষ্ঠানের কয়েকটি ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পরই বিষয়টি আলোচনায় আসে। ছবিতে দেখা যায়, সন্তোষ শর্মা জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে একই মঞ্চে বসে আছেন। ওই অনুষ্ঠানের একটি ভিডিও বিশেষভাবে বিতর্কিত হয়ে ওঠে। ভিডিওতে দেখা যায়, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ও জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান সন্তোষ শর্মার পাশে গিয়ে করমর্দন করছেন এবং উভয়ে হাস্যোজ্জ্বলভাবে কথা বলছেন। দৃশ্যটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। অনেকেই এমন ঘটনায় প্রশ্ন তোলেন। তাদের মতে পূজা উদযাপন কমিটির অন্য কেউ এলে বিতর্ক হতো না, বিতর্ক হয়েছে সন্তোষ শর্মাকে নিয়ে।
 
র’-সংশ্লিষ্টতা ও বাড়তি ক্ষোভ
সন্তোষ শর্মার জামায়াতের অনুষ্ঠানে উপস্থিতি নিয়ে যে ক্ষোভ ও বিতর্ক তৈরি হয়েছে, তার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো- ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইংয়ের (র’) সঙ্গে তার দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ। তাছাড়া তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে বিপুল পরিমাণ টাকার লেনদেন হয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, যে ব্যক্তি ভারতের কূটনৈতিক মহলে পরিচিত মুখ এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামরিক ইস্যুতে ওপার থেকেও ‘ফিড’ পান বলে গুঞ্জন রয়েছে, ওই ব্যক্তি কীভাবে একসময়কার ভারতবিরোধী জামায়াতের অনুষ্ঠানে অতিথি হয়ে যেতে পারেন?
 
সব মহলে সমালোচনা
এই ক্ষোভ বিশেষত জামায়াতের তৃণমূল এবং ইসলামী রাজনৈতিক ঘরানার তরুণদের মধ্যে বেশি দেখা হচ্ছে, যারা মনে করছেন জামায়াত আদর্শ বিসর্জন দিয়ে ‘নির্বাচনভিত্তিক মেইনস্ট্রিম রাজনীতির’ অংশ হতে গিয়ে নিজের শত্রুকেও বন্ধুতে পরিণত করছে।
 
হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মুফতি হারুন ইজহার চৌধুরী ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ‘জামায়াতে ইসলামী নিকৃষ্ট মুনাফেকিতে লিপ্ত হয়েছে। দিল্লির ওই কুত্তাগুলোর (সন্তোষ গং) সঙ্গে ওরা সংসার শুরু করছে। হে শিবির! হে শহীদ নেতাদের উত্তরসূরিরা! তোমাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এখন।’
 
২০১৮ সালে মধ্যরাতের নির্বাচনের আগে ও পরে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে শত শত আলেমকে গ্রেপ্তার ও গুম করেছিল শেখ হাসিনার সরকার। গ্রেপ্তার ও গুমের পর ডিবি অফিসে গোয়েন্দাদের সঙ্গে পাশাপাশি উপস্থিত থেকে ভুক্তভোগীদের জিজ্ঞাসাবাদ করতেন কালবেলা সম্পাদক ও প্রকাশক সন্তোষ শর্মা। এ নিয়ে অতীতে অভিযোগ করেছেন হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মুফতি হারুন ইজহার চৌধুরী এবং প্রবাসী হাফেজ আতিকুল্লাহ জুলফিকার।
 
আলোচিত ইসলামী বক্তা রফিকুল ইসলাম মাদানীও এ ঘটনায় ফেসবুকে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন । তিনি লেখেন, ‘যে সন্তোষ শর্মা আমাকে, শায়খ হারুন ইজহার হাফিজাহুল্লাহ এবং আরো অনেক আলেমকে রিমান্ডে নির্যাতন করেছে, সে যে বাংলাদেশের এক চিহ্নিত র’ এজেন্ট, এটা কে না জানে। তাকে দাওয়াতি সেমিনারে আমন্ত্রণ জানানো হলে আমাদের মনে কষ্ট আসাটাই স্বাভাবিক। যারা আমাদের সহযোগিতা করেছে, তাদের আমরা যখন আমাদের নির্যাতনকারীদের সম্মানের সঙ্গে বক্তব্য দিতে দেখি, তখন তা অত্যন্ত কষ্টদায়ক হয়— যা সহজে বোঝানো যায় না।’
 
তিনি আরো লেখেন-‘এটাও মনে রাখবেন, এই ভারতীয় গোষ্ঠী কখনো আপনাদের ক্ষমতায় দেখতে চাইবে না। যতই তাদের সঙ্গে মিল দেওয়ার চেষ্টা করেন, কোনো লাভ হবে না। বরং তাদের সঙ্গে ওঠাবসা আপনাদের প্রতি দেশের মানুষের ভালোবাসা কমিয়ে দেবে। এমনকি আপনাদের দলের অনেকেও বিষয়টি সমর্থন করবেন না। জামায়াত নেতাদের বলছি—সতর্ক থাকুন, এদের থেকে দূরে থাকুন এবং হিতাকাঙ্ক্ষীদের সমালোচনাকে গুরুত্ব দিন।’
 
এদিকে জামায়াত-ঘনিষ্ঠ কয়েকজন সাংবাদিক ও লেখক সন্তোষ শর্মার উপস্থিতিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। এমনকি জামায়াতের আগে বিএনপির এক অনুষ্ঠানে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ভার্চুয়ালি উপস্থিতিতেও সন্তোষ শর্মা বক্তব্য রাখেন বলে কেউ কেউ উল্লেখ করেন।
 
এ বিষয়ে আলোচিত প্রীতি সমাবেশ আয়োজক ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জামায়াতের কোনো নেতার মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
 
তবে ফেসবুক স্ট্যাটাসের একটি কমেন্টে ঢাকা মহানগর উত্তর জামায়াতের প্রচার সম্পাদক আতাউর রহমান সরকার বলেন, সন্তোষ শর্মা হিন্দু কল্যাণ পরিষদ ও পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক। একটি ধর্মের প্রতিনিধি হিসেবে অংশগ্রহণ করেছেন। জামায়াতের দাওয়াতি সমাবেশ ছিল এটা। ১১-২৫ এপ্রিল গণসংযোগ কর্মসূচি (দাওয়াতি পক্ষ) চলছে, তারই ধারাবাহিকতায় বুধবার এ সমাবেশ আয়োজন করা হয়, যেখানে সব ধর্মের প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানানো হয়।
 
ফেসবুকের আরেকটি কমেন্টে আব্দুল হাই নামে একজন বলেন, জামায়াত সন্তোষ শর্মার পায়ে লুটিয়ে পড়েনি অথবা দেশ বিক্রি করেনি অথবা গোপন কোনো বৈঠক করেনি। জামায়াত ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ভিন্নমতাবলম্বীদের নিয়ে সম্প্রীতি সমাবেশ করেছে। সেখানে বিভিন্ন ধর্মের ধর্মীয় গুরুদের দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সন্তোষ শর্মাকেও দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। তিনি তার সাংগঠনিক দায়িত্ব থেকেই এসেছেন এবং তার সভাপতিও এসেছেন।
 
জামায়াতের কথা শুনতে ভিন্নধর্মাবলম্বীদের মধ্য থেকে তাকেও আনা হয়েছে। ইসলামী দল ক্ষমতায় এলে দেশ ‘কেমন’ হবে সেটা সবার আগে জানা দরকার সন্তোষের মতো লোকদের। ভিন্নধর্মাবলম্বীদের নিয়ে অনুষ্ঠান করলে হিন্দুদের মধ্যে দ্বিতীয় কার্ড পাবে সন্তোষ শর্মা। কারণ, সে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক। এ পদ তো জামায়াত তাকে দেয়নি।
 
জামায়াত সূত্র জানায়, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জামায়াত আয়োজিত ওই প্রীতি সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান। এ সময় তিনি বলেন, মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখতে হবে, ধর্ম ও পেশার ভিত্তিতে নয়। আমি যদি চিকিৎসক হয়ে সংখ্যালঘু না হই, তাহলে হিন্দু হলে সংখ্যালঘু বলবেন কেন?
 
ভিন্নধর্মাবলম্বীদের পক্ষ থেকে জামায়াতের ব্যানারে নির্বাচন করার আহ্বান জানিয়ে ডা. শফিকুর রহমান বলেন, কেউ জামায়াতের ব্যানারে নির্বাচন করতে চাইলে জামায়াত তার পক্ষ হয়ে জনগণের কাছে যাবে। তিনি বলেন, অতীতে যারা জালিমের হাতে নির্যাতিত হয়ে ‘আপদ’ মনে করে দেশ ছেড়েছেন, তাদের নিজের দেশে ফিরিয়ে আনতে চান তারা। এটা তার জন্মগত অধিকার।
 
জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আমির নুরুল ইসলাম বুলবুলের সভাপতিত্বে ও দক্ষিণের সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদের পরিচালনায় এতে ভিন্নধর্মাবলম্বীদের মধ্য থেকে সন্তোষ শর্মা ছাড়াও বক্তব্য দেন-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সুকোমল বড়ুয়া, বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি বাসুদেব ধর ও জাতীয় হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব অ্যাডভোকেট গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক, বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের ভাইস প্রেসিডেন্ট স্বরূপানন্দ, সিদ্ধেশ্বরী সর্বজনীন পূজা কমিটর সভাপতি ও সাবেক ডিআইজি নির্বাক চন্দ্র মাঝি, বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বিপ্লব দে, প্রিন্সিপাল অনুপম বড়ুয়া, সুজন দে প্রমুখ। এ ছাড়াও হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
 
সন্তোষ শর্মার প্রতিক্রিয়া
এ বিষয়ে কালবেলা সম্পাদক সন্তোষ শর্মাকে ফোন করা হলে তিনি রিসিভ করেননি। কালবেলা পত্রিকাও এ নিয়ে কোনো বিবৃতি প্রকাশ করেনি। তবে পত্রিকার কয়েকজন সাংবাদিক ব্যক্তিগতভাবে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
 
ঘটনাটি রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। একদিকে এটি জামায়াতের ‘মূল স্রোতের রাজনীতিতে’ ফেরার কৌশল হিসেবে দেখা যেতে পারে, অন্যদিকে ‘বামপন্থি’ ভাবমূর্তির গণমাধ্যমের প্রতিনিধির এমন উপস্থিতি সমাজে বিভ্রান্তি ও অসন্তোষ সৃষ্টি করছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ধরনের ঘটনা ভবিষ্যতে রাজনৈতিক মেরূকরণ ও মিডিয়ার নিরপেক্ষতা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলবে।