Image description
স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন » শুরুতে চার রোগের চিকিৎসায় বিমা - সুবিধার প্রস্তাব থাকছে প্রতিবেদনে । ক্যানসার , ডায়ালাইসিস , কার্ডিয়াক সার্জারি , পক্ষাঘাতের চিকিৎসায় ব্যয় বেশি । বাংলায় প্রতিবেদন চূড়ান্ত করার কাজ চলছে , দুই সপ্তাহের মধ্যে জমা হবে । বিশেষজ্ঞরা বলছেন , জাতীয় স্বাস্থ্য তহবিল ছাড়া বিমা বাস্তবায়ন সম্ভব নয় ।

জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার ব্যয় বহন করতে গিয়ে অনেক মানুষ দরিদ্রতার মধ্যে পড়ছে । বিষয়টি বিবেচনায় ব্যয়বহুল চিকিৎসায় স্বাস্থ্যবিমা চালুর পক্ষে স্বাস্থ্য খাতের সংস্কার কমিশন । চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এ প্রস্তাব দিয়ে শুরুতে চার থেকে পাঁচটি ব্যয়বহুল চিকিৎসার জন্য বিমা - সুবিধা দিতে অন্তর্বর্তী সরকারকে পরামর্শ দেবে কমিশন । এগুলোর মধ্যে রয়েছে ক্যানসার , ডায়ালাইসিস , কার্ডিয়াক সার্জারি ও পক্ষাঘাত । সংস্কার কমিশন বলেছে , আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে সরকারের কাছে এই প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে । প্রতিবেদনে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার বাইরে ব্যয়বহুল চিকিৎসাগুলোকেও অগ্রাধিকার দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হবে ।

সংস্কার কমিশন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে । স্বাস্থ্যবিমার প্রস্তাবকে ভালো বললেও স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদেরা বলছেন , এটি বাস্তবায়নের উপায়ও কমিশনকে বলতে হবে । জাতীয় স্বাস্থ্য তহবিল ছাড়া সর্বজনীন স্বাস্থ্যবিমা বাস্তবায়ন সম্ভব নয় । গত বছরের ১৮ নভেম্বর ১২ সদস্যের স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন গঠন করা হয় । এই কমিশনের প্রধান করা হয়েছে জাতীয় অধ্যাপক ডা . এ কে আজাদ খানকে । প্রতিবেদন দিতে কমিশনকে প্রথমে ৯০ দিন সময় বেঁধে দেওয়া হয় । পরে গত ফেব্রুয়ারিতে প্রথম দফায় ৩০ মার্চ পর্যন্ত এবং মার্চের শেষে দ্বিতীয় দফায় ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয় । কমিশনের অন্তত তিন সদস্য আজকের পত্রিকাকে জানান , তাঁদের মাঠপর্যায়ের সব কার্যক্রম মার্চের মধ্যেই শেষ হয়েছে । জেলা , বিভাগ, মেডিকেল কলেজ চিকিৎসা শিক্ষা , ওষুধ , জনস্বাস্থ্য , মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্যের বিষয়সহ বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে সংলাপ করা হয়েছে । মাঠপর্যায়ের কর্মীদের মতামত , বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থার গবেষণা প্রতিবেদনও আমলে নিয়েছে কমিশন । ইংরেজি ভাষায় তৈরি করা প্রতিবেদনটি বর্তমানে বাংলা ভাষায় চূড়ান্ত করার কাজ চলছে ।

জানতে চাইলে স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের প্রধান ও জাতীয় অধ্যাপক ডা . এ কে আজাদ খান বলেন , নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে । সূত্র বলেছে , কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে , দেশে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় ( আউট অব পকেট এক্সপেন্ডিচার ) বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা । নিজস্ব ব্যয়ে চিকিৎসা করাতে বিপর্যয়ের পরিস্থিতিতে পড়ছে মানুষ । বিনা মূল্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব হওয়া উচিত । তবে প্রাথমিক সেবার বাইরেও ব্যয়বহুল চিকিৎসাগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়ার প্রস্তাব থাকছে প্রতিবেদনে । সরকারের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট বলছে , স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় ৬৭ শতাংশ । তবে বিশ্বব্যাংকের হিসাবে বাংলাদেশে এই ব্যয় ৭৪ শতাংশ ।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ( বিআইডিএস ) সূত্র বলছে , চিকিৎসার উচ্চব্যয়ের কারণে দেশের ১৮ শতাংশ পরিবার বিপর্যয়মূলক স্বাস্থ্যসেবা ব্যয়ের মধ্যে পড়েছে । ২০২২ সালে বিপর্যয়কর স্বাস্থ্যসেবা ব্যয় মেটাতে গিয়ে দেশে ৬১ লাখের বেশি মানুষ দরিদ্র হয়েছে । সংস্কার কমিশনের একজন সদস্য বলেন , স্বাস্থ্য খাতে অর্থায়নের বিষয়টিতে মুক্তবাজার অর্থনীতিতে গুরুত্ব দিতে সরকারকে প্রস্তাব করার সিদ্ধান্ত হয়েছে । স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় মেটাতে গিয়ে মানুষকে দরিদ্রতা থেকে বাঁচাতে কর্মপরিকল্পনা দেওয়া হবে । তিনি বলেন , ধনীরা চিকিৎসার জন্য কোটি টাকা ব্যয় করলেও বিপর্যয়ের মুখে পড়েন না । তবে মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র মানুষ দরিদ্র হন । কেউ কেউ সর্বস্ব হারান । অনেক সময় অর্থের অভাবে স্বাস্থ্যসেবা পাওয়াও কঠিন হয়ে পড়ে । গবেষণার তথ্য ও অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করে এমন চার থেকে পাঁচটি জটিল স্বাস্থ্য অবস্থা ও ব্যয়বহুল চিকিৎসা শনাক্ত করা হয়েছে । যেগুলোর ব্যয় বিমা থেকে বহন করতে সরকারকে পরামর্শ দেওয়া হবে ।

যেসব চিকিৎসা বিমার আওতায় আনার প্রস্তাব থাকছে দেশে মৃত ব্যক্তিদের মধ্যে ৭০ শতাংশই মারা যান অসংক্রামক ও দীর্ঘমেয়াদি কয়েকটি রোগে । এর মধ্যে হৃদরোগ ও ক্যানসার শীর্ষে । এ ছাড়া পক্ষাঘাতগ্রস্তদের চিকিৎসা ও কিডনি বিকল রোগীদের ডায়ালাইসিস ব্যয়বহুল হওয়ায় চিকিৎসাবঞ্চিত হচ্ছেন অনেক রোগী । কমিশন সূত্র বলছে , ব্যয় বিবেচনায় কমিশন শুরুতে ডায়ালাইসিস , পক্ষাঘাত , করোনারি আর্টারি বাইপাস গ্রাফটিং বা বাইপাস সার্জারি , ক্যানসারের চিকিৎসাকে স্বাস্থ্যবিমার আওতায় আনার প্রস্তাব দেবে । কমিশনের দুজন সদস্য বলেন , তাঁরা চার থেকে পাঁচটি অবস্থা নির্ণয় করেছেন । সরকার এগুলোর দু - তিনটি নিয়ে শুরু করতে পারে । পক্ষাঘাত , ডায়ালাইসিসের জন্য পুরো পরিবার মারাত্মক আর্থিক সংকটে পড়ে । ক্যানসারের চিকিৎসা , কার্ডিয়াক সার্জারি ব্যয়বহুল । যেসব খরচ একজন মানুষকে দারিদ্র্যসীমায় ঠেলে দিচ্ছে , তা নিয়ে সরকারের বিমা শুরু করা উচিত । এসব বিমার আওতায় এলে প্রতারণার সুযোগ থাকবে না । কারণ , কার্ডিয়াক সার্জারি , ক্যানসার বা ডায়ালাইসিস প্রয়োজন না হলে কোনো প্রতিষ্ঠান এসব নিয়ে প্রতারণা করতে পারবে না । শুরুতে সাধারণ রোগগুলোকে বিমায় রাখলে তা কার্যকর করা কঠিন । ধীরে ধীরে সব ধরনের চিকিৎসা স্বাস্থ্যবিমার আওতায় আনা যাবে । তবে দেশে এসব রোগের চিকিৎসা - সুবিধা অপ্রতুল । যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনের এক গবেষণার তথ্য বলছে , দেশে কার্ডিয়াক সার্জারির সুবিধা থাকা প্রতিষ্ঠান আছে ৩২ টি ।

জাতীয় কিডনি ও ইউরোলজি ইনস্টিটিউট বলছে , দেশে সরকারি ও বেসরকারি কিডনি ডায়ালাইসিস কেন্দ্ৰ আছে ১৩০ টি , ডায়ালাইসিস মেশিন রয়েছে ৬৫০ টি । অথচ দেশে ২ কোটি মানুষ দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগে আক্রান্ত । এর মধ্যে বছরে অন্তত ৩৫ হাজার থেকে ৪০ হাজার মানুষের কিডনি রোগ শেষ পর্যায়ে ( পঞ্চম স্তর ) পৌঁছায় । অর্থাৎ তাঁদের কিডনি প্রতিস্থাপনের বিকল্প নেই । প্রতিস্থাপন পর্যন্ত তাঁদের ডায়ালাইসিস করতে হবে । কিডনি প্রতিস্থাপনের সুবিধা রয়েছে ১০ টি প্রতিষ্ঠানে । ডায়ালাইসিস প্রয়োজন — এমন রোগীদের মাত্র ২৫ শতাংশ এই সুবিধার আওতায় আসছে । একইভাবে ক্যানসারের চিকিৎসা- সুবিধাও অপ্রতুল । চিকিৎসা - সুবিধার অপ্রতুলতায় কীভাবে স্বাস্থ্যবিমা বাস্তবায়ন হবে- এমন প্রশ্নে কমিশনের একজন সদস্য জানান , মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বাড়াতে সরকারকে পরামর্শ দেওয়া হবে । সচ্ছল ব্যক্তিদের কাছ থেকে প্রিমিয়াম ( কিস্তি ) নেওয়া হতে পারে । সামাজিক বিনিয়োগ , সোশ্যাল বিজনেসের (সামাজিক ব্যবসা) জন্য বিনিয়োগকারীদের উদ্বুদ্ধ করা হতে পারে । বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে নিজ উদ্যোগে কাজ করত । সে ক্ষেত্রে সরকারের কোষাগারে তারা লভ্যাংশের নির্দিষ্ট অংশ জমা দেবে । তা থেকে জটিল চিকিৎসায় ব্যয় হবে । বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ( ডব্লিউএইচও ) মতে , একটি দেশের স্বাস্থ্য - ব্যয়ের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ সেবাগ্রহীতার নিজের পকেট থেকে যেতে পারে । স্বাস্থ্যের জন্য সরকারের ব্যয় জিডিপির ৫ থেকে ৬ শতাংশ হতে হবে । সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের ( সিপিডি ) তথ্যমতে , তথ্যমতে , ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ৫ দশমিক ২ শতাংশ , যা জিডিপির মাত্র শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ ।

ডব্লিউএইচওর সর্বশেষ হিসাব বলছে , ২০২২ সালে বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় ছিল জিডিপির ২ দশমিক ৩ শতাংশ । স্বাস্থ্যবিমা নিয়ে সংস্কার কমিশনের চিন্তাকে ইতিবাচক বলছেন স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদেরা । তবে বিমা কীভাবে বাস্তবায়ন হবে , তা নিয়ে পরিকল্পনা থাকতে হবে বলে মনে করেন তাঁরা । তাঁরা বলছেন , সরকার একটি জাতীয় স্বাস্থ্য তহবিল গঠন করতে পারে । যেখানে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সবার কাছ থেকে দৈনিক এক টাকা বা তার কম কেটে নেবে । অতি প্রক্রিয়াজাত খাবার , তামাক পণ্যসহ অতি বিলাসী পণ্য থেকে নির্দিষ্ট অঙ্কের বিশেষ কর আদায় করে ওই তহবিলে রাখা উচিত । সেখান থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী সরকার চিকিৎসাবিমায় খরচ করবে ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড . সৈয়দ আব্দুল হামিদ আজকের পত্রিকাকে বলেন , ‘ কীভাবে স্বাস্থ্যবিমা বাস্তবায়ন হবে , তার স্পষ্ট উল্লেখ কমিশনের প্রতিবেদনে থাকতে হবে । রোগের সংখ্যা প্রাথমিকভাবে কম , তাতে সমস্যা নেই । দেশে স্বাস্থ্যবিমা চালু করা কঠিন । কেননা , মাত্র ১২-১৩ শতাংশ কর্মজীবী মানুষ আনুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন । বাকিরা আয় করেন অনানুষ্ঠানিক খাতে । তাঁদের কাছ থেকে কীভাবে বিমার প্রিমিয়াম নেওয়া হবে ? এসব বহনের সক্ষমতা সরকারের নেই । কেউ প্রিমিয়াম দিয়ে বিমার সুবিধা নিলে তেমন বিমা তো কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের রয়েছে । তিনি বলেন , বিমার সুবিধায় স্বাস্থ্যসেবা কোন প্রতিষ্ঠান , কীভাবে দেবে , তার উপায় থাকা উচিত । জাতীয় স্বাস্থ্য তহবিল ছাড়া সর্বজনীন স্বাস্থ্যবিমা বাস্তবায়ন সম্ভব নয় ।