Image description
৪২ ফুট উচ্চতার ‘মুজিব’ ম্যুরাল স্থাপনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন চলছিল ২৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে * অন্তর্বর্তী সরকারের তিন উপদেষ্টার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হয়নি

ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের কথিত উন্নয়নের হিংস থাবা থেকে রক্ষা পায়নি পার্কও, হয়েছে ছিন্নভিন্ন। লুটপাটের নেশায় উন্নয়নের নামে রাজধানীর বিভিন্ন পার্ক বিরানভূমিতে পরিণত করা হয়েছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে পান্থকুঞ্জ এমন কোনো সবুজ উদ্যান নেই যেখানে এই হিংস থাবা পড়েনি। চারিদিকে যানবাহনে ঠাসা ঢাকার প্রাণকেন্দ্রের মধ্যে এক টুকরো পান্থকুঞ্জ পার্ক যুগ যুগ ধরেই ছিল সাধারণ মানুষের প্রশান্তির জায়গা। সবুজ ঘেরা ওই পার্কে জীববৈচিত্র্যে বিভিন্ন প্রজাতির পাখিসহ কীটপতঙ্গে ভরা ছিল। কিন্তু, হাসিনার একান্ত ব্যক্তিস্বার্থে ‘ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেস’ তৈরির নামে পুরো পার্কটি লন্ডভন্ড করে ফেলা হয়েছে। প্রায় অর্ধশত প্রজাতির দুই হাজারেরও বেশি গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। ক্ষতবিক্ষত পার্কটির ভেতর এক্সপ্রেসওয়ের পিলারের অংশসহ দানবাকৃতির বড় বড় যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। একই সঙ্গে পার্কটির এক পাশ ঘিরে প্রায় আড়াইশত কোটি টাকা ব্যয়ে ৪২ ফুট উচ্চতার অসমাপ্ত ‘মুজিব’কেন্দ্রিক ভাস্কর্য-ম্যুরাল প্রকল্প ওঁৎ পেতে দাঁড়িয়ে আছে।

গত তিন দিন পান্থকুঞ্জ পার্ক এবং তার চারপাশ সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, একসময়ের সবুজ পার্কটির ভেতর-বাহির এবড়োখেবড়ো হয়ে পড়ে আছে। প্রায় ৯০ শতাংশ এলাকাজুড়ে কথিত উন্নয়নের ধ্বংসনীলার চিহ্ন স্পষ্ট হয়ে আছে। পার্কের চারপাশে রয়েছে স্টিলের টিন-কাঁটাতার দিয়ে বেড়া। অধিকাংশ জায়গাজুড়ে ছোট-বড় সরঞ্জাম-যন্ত্রাংশ পড়ে আছে। পিলারের এক একটি গর্তে ময়লা আর্বজনা ভরে আছে। দানবের মতো অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে ট্রাক, পাইল মেশিনসহ লোহার পাইপ, রডের স্তূপ। অপর দিকে ১৩৩ দিন ধরে পার্কটির ভেতর-বাইরে অবস্থান করছেন-‘বাংলাদেশ গাছ রক্ষা আন্দোলন’ নামের সামাজিক সংগঠনের প্রায় অর্ধশত কর্মী। এসব কর্মী রাত-দিন মৃত প্রায় পার্কটি পাহারা দিচ্ছেন-যাতে পার্কটিতে পুনরায় কাজ না করতে পারে।

সরেজমিন ঘুরে আরও দেখা যায়, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকার পার্কটিকে পুরোপুরি ধ্বংস করতে যা যা প্রয়োজন সবই করেছিল। পশ্চিত দিকে পার্ক দখল করে একটি ওয়াসার পাম্প ঘিরে বিভিন্ন যানবাহন ওয়াশ করার একটি প্ল্যান্ট রয়েছে। এর পাশেই ময়লা-আবর্জনা ফেলার জন্য বিশাল একটি সেড আছে। যেখানে মাদকাসক্তদের আড্ডা চলছে। ওই সারিতেই একটি পাবলিক টয়লেট। সবই করা হয়েছে পার্কের গাছ কেটে, সম্পূর্ণ অবৈধভাবে। এ তিনটি স্থাপনার বিরুদ্ধে আদালতে মামলাও আছে-কিন্তু স্থাপনাগুলো বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ও উচ্ছেদ করা সম্ভব হচ্ছে না।

পার্কটির ধ্বংসস্তূপের মধ্যখানে ১০ ফুট বাই ১২ ফুটের একটি ঝুপড়িঘর (পলিথিন দিয়ে গড়া)। প্রবেশ করতেই বেশ কয়েকজন তরুণকে দেখা গেল। জানালেন, তারা বাংলাদেশ গাছরক্ষা আন্দোলনের সদস্য। এরাসহ আরও অনেক সদস্য দিন-রাত এ পার্ক ঘিরেই জেগে থাকেন। কাঁদেন, পার্কটির ধ্বংসনীলা দেখে। ছোট ছোট গাছের চারারোপণ করছেন। ছোট গর্তে পানি রেখে পাখিদের গোসল-খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। সতর্কাবস্থানে থাকেন-অব্যবহৃত দানবগুলো ( যন্ত্রাংশ) যেন বিন্দুমাত্র নড়তে না পারে। পার্কজুড়ে হিংস তার চিহ্ন স্পষ্ট চোখে পড়ছিল। অনেক সচেতন মানুষ পার্কটি দেখতেও আসেন। পার্কটির ভেতরে থাকা কয়েকটি কুকুরকে খাবার দিতে আসা জৈনিক ব্যক্তি বললেন, ‘এ পার্ক ছিল এ শহরের অন্যতম সৌন্দর্যের প্রতীক। শুধু ‘মুজিব’ ম্যুরাল-ভাস্কর্য তৈরিসহ উন্নয়নের নামে কোটি কোটি টাকা লুটপাট করতেই এ পার্ককে নিশানা বানিয়েছিল ফ্যাসিস্ট হাসিনা।’ পার্কটির দক্ষিণ পাশে বিশাল এলাকাজুড়ে ম্যুরাল-ভাস্কর্যের শুরুর স্থাপনা চোখে পড়ল। চারপাশ ঘেরা ওই ম্যুরালের ভেতর প্রবেশ করতেই চোখে পড়ল বিশাল বিশাল আটটি পিলার। ওই সময় বেশ কয়েকজন দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারী পার্কটি ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন। এদের একজন বললেন, ‘ম্যুরাল-ভাস্কর্য’র অংশটুকু সিটি কররপোরেশন কর্তৃক নির্মিত হচ্ছিল। প্রায় আড়াইশত কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিতব্য মূর্তিটির উচ্চতা ৪২ ফুট। অর্থাৎ পাশের মেট্রোরেলের চেয়েও উঁচু ম্যুরাল করতে চেয়েছিলেন শেখ হাসিনা। তার একক সিদ্ধান্তেই এটি হচ্ছিল। আমরা এখন এটা পুরোপুরি ভেঙে দেব।’

জানা যায়, পার্ক ধ্বংসের এই প্রকল্প পরিবেশ ধ্বংস, নাগরিক অধিকারহরণ, অন্যায্য চুক্তি এবং রাষ্ট্রীয় অপচয়ের বিরুদ্ধে সচেতনমহল ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাস থেকেই আন্দোলন করে আসছিলেন। কিন্তু আওয়ামী গুন্ডাপান্ডা এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের (এসডিআরবি এবং সিনোহাইড্রো) বিধ্বংসী উন্নয়ন চলছিলই।

আন্দোলনকর্মীদের ভাষ্য, রাজধানীসহ দেশের সাধারণ মানুষ পার্ক ও গাছ রক্ষায় মরিয়া হয়ে উঠছে। কিন্তু দুর্ভাগা দেশের অন্তর্বর্তী সরকার ভাবছে না, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের যত উন্নয়ন সবই ছিল লুটপাটের জন্য।

পান্থকুঞ্জ রক্ষা আন্দোলনে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ ও বন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানসহ তিনজন উপদেষ্টা পার্কে এসে আন্দোলনে অংশগ্রহণও করেন। ওই সময় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন দ্রুততম সময়ের মধ্যে এ প্রকল্পের কাজ চূড়ান্তভাবে বন্ধ করা হবে। পান্থকুঞ্জ পুনরুদ্ধার করে ফিরিয়ে আনা হবে আগের রূপ। কিন্তু, সেই প্রতিশ্রুতি সাত মাস পার হলেও প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হয়নি। দেশের বেশির ভাগ পরিবেশবিদ. স্থপতি ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের পক্ষে গান গেয়েছেন লুটপাটের অংশীদার হওয়ার জন্য।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে মূলত একটি উড়াল-সেতুর মতো বৃহৎ স্থাপনা, ধনীদের প্রাইভেট গাড়ি যাতে সব ধরনের যানজট এড়িয়ে নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারে এরকম দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই এর নির্মাণ শুরু হয়। প্রাথমিকভাবে যে পাঁচটি পথে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে তৈরির প্রস্তাবনা ছিল সেখানে পান্থকুঞ্জের ভেতরে কোনো র‌্যাম্প নামার কথা ছিল না। প্রকল্পের মোট আনুমানিক ব্যয় ১৯ হাজার ৮৫৭ কোটি ৫৭ লাখ টাকা, যার মধ্যে নিজস্ব অর্থায়ন হবে আনুমানিক ১৩ হাজার ৩৩০ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে, হাতিরঝিল ও পান্থকুঞ্জে চলমান এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পে পান্থকুঞ্জ পার্কের শত শত গাছ কর্তন এবং হাতিরঝিল জলাধার ভরাট করে নির্মাণকাজ করার জন্য পরিবেশ ছাড়পত্র নেওয়া হয়নি।

বাংলাদেশ গাছরক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক আমিরুল রাজিব যুগান্তরকে বলেন, উন্নয়নের নামে হাতিরঝিল-পান্থকুঞ্জ ধ্বংস করা হয়েছে। লুটপাটের উন্নয়নে পরিবেশ লাগাতার ধ্বংস হয়েছে। প্রকল্পটি ইতোমধ্যেই মাঠ, পার্ক ও জলাধার সংরক্ষণ আইন, পরিবেশসংক্রান্ত আইন ও বিভিন্ন পরিকল্পনার সুস্পষ্ট লংঘন করেছে। উপদেষ্টাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পার্কের ভেতর গড়ে ওঠা স্থাপনা পুরোপুরি উচ্ছেদ করাসহ পার্কের পূর্বের পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে পাস্থকুঞ্জ-হাতিরঝিল প্রকল্প চূড়ান্তভাবে বন্ধের ঘোষণা দিতে হবে। প্রকল্পটি শুরু থেকেই প্রাণ-প্রকৃতি ও পরিবেশ ধ্বংস করেছে। পান্থকুঞ্জ পার্ক ধ্বংস করে ফেলেছে। তিনি অভিযোগ করেন, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের বর্তমান রুট হচ্ছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দক্ষিণে কাওলা, কুড়িল, বনানী, মহাখালী, তেজগাঁও, মগবাজার, কমলাপুর, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত। কিন্তু এফডিসি থেকে পলাশী পর্যন্ত এই সংযোগ সড়ক বাস্তবায়ন করতে গিয়ে পরিবেশ ও পরিকল্পনা সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধিবিধানের কোনো তোয়াক্কা না করে ইতোমধ্যেই হাতিরঝিলের জলাধার ভরাট এবং পান্থকুঞ্জ উদ্যানের গাছগুলো কেটে ফেলা হয়। সবই করা হয় এ উন্নয়নকে কেন্দ্র করে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটের জন্য।