
মরণবাঁধ ফারাক্কার প্রভাবে পদ্মার পানি প্রবাহের ওপর নির্ভরশীল দেশের উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৫৩টি নদনদী শুকিয়ে গেছে। এককালের খরস্রোতা নদনদীগুলো এখন পরিত্যক্ত নালা বা খালে পরিণত হয়েছে। কোনো কোনোটি অস্তিত্ব হারিয়েছে। এসব নদনদীর ওপর নির্ভরশীল কয়েক কোটি মানুষের জীবন-জীবিকাও সংকটে পড়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে অনেক সেচ প্রকল্প। নদনদীগুলো মরে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে গেছে নৌচলাচলপথ। এসব নদনদীর বুকে এখন বিভিন্ন ফসলের চাষাবাদ হচ্ছে। বিশেষ করে দেশের উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ২৬টি জেলার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত এসব নদনদী মরে যাওয়ায় ভূ-প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে সাড়ে ৪ কোটির বেশি মানুষ। এসব জেলার পানিস্তরও নেমেছে আশঙ্কাজনকভাবে। ফারাক্কার প্রত্যক্ষ প্রভাবে বন্ধের পথে গঙ্গা-কপোতাক্ষ (জিকে) সেচ প্রকল্পও। এমনকি সুন্দরবন অঞ্চলের নদনদীতেও বেড়েছে লবণাক্ততা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ফারাক্কার প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলো হচ্ছে-চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, পাবনা, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী, ফরিদপুর ও শরীয়তপুর। প্রায় ৫০ বছর আগে ১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল পরীক্ষামূলকভাবে একতরফা ফারাক্কা বাঁধ চালু করে ভারত। দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সর্বশেষ জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার মনকষা ইউনিয়নের তারাপুর এবং পাকা ইউনিয়নের পাকা সীমান্ত থেকে মাত্র ১৮ কিলোমিটার উজানে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার সরসেরগঞ্জ থানার গ্রাম ফারাক্কা। এখানে গঙ্গা নদীর ওপর নির্মিত ১১৯টি লকগেট বিশিষ্ট বাঁধটির নামকরণ হয় ফারাক্কা বাঁধ। ফারাক্কা থেকে ১৮ কিলোমিটার ভাটিতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের পাকা পয়েন্টে গিয়ে গঙ্গা নদীর নাম হয়েছে পদ্মা।
সরেজমিনে চাঁপাইনবাবগঞ্জে পদ্মার তীরবর্তী পাকা ইউনিয়নের বোগলাউড়ি, জগন্নাথপুর, মনোহরপুর, উজিরপুর, নারায়ণপুর, সুন্দরপুর ও চরবাগডাঙ্গা এলাকা ঘুরে দেখা যায়, পদ্মার বুকে এখন শুধু ধু-ধু বালুচর। একটি সরু চ্যানেলে পদ্মার পানিপ্রবাহ কোনোভাবে সচল আছে। বছর বছর পদ্মার পানিপ্রবাহ ক্ষীণ হওয়ায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ৬টি নদনদীও পানিশূন্য হয়ে মৃতপ্রায় খালে পরিণত হয়েছে। শিবগঞ্জ উপজেলার মনাকষা, বিনোদপুর ও দুর্লভপুর ইউনিয়নের ওপর দিয়ে প্রবাহিত চকের নদী উজানে ভারতের মালদহ জেলার হরিশচন্দ্রপুর পয়েন্টে গঙ্গার শাখা নদী হিসাবে উৎপত্তি হয়ে বিনোদপুর পয়েন্টে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। প্রায় ৫০০ মিটার প্রশস্ত এককালের খরস্রোতা চকের নদীটি ৩০ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে শিবগঞ্জের বোগলাউড়িতে গিয়ে পদ্মায় পড়েছে। তবে নিষ্কাশনমুখ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বর্র্ষাকালেও চকের নদী এখন বদ্ধ খাল হয়ে থাকে।
নদী তীরবর্তী তেলকুপি গ্রামের বাসিন্দা সফিকুল ইসলাম বলেন, স্বাধীনতার পরও চকের নদী দিয়ে বড় বড় মালবাহী নৌকা চলাচল করত। নৌকায় করে আশপাশের ২০ গ্রামের মানুষ মনাকষার হাটে এসে ধান, পাটসহ বিভিন্ন কৃষিপণ্য বিক্রি করত। এ নদীটির অস্তিত্ব এখন পুরোপুরি বিপন্ন। এখন নদীর বুকজুড়ে চাষ হচ্ছে ধান। সফিকুল ইসলাম আরও বলেন, আরও কয়েক বছর পরে আগামী প্রজন্ম জানবেই না এখানে একটি খরস্রোতা নদী ছিল। ফারাক্কার প্রভাবে চকের নদীটিকে বলা যেতে পারে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত নদীগুলোর একটি।
এদিকে ফারাক্কার প্রভাবে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ওপর দিয়ে প্রবাহিত প্রাচীন নদীগুলোর একটি পাগলা নদী। প্রায় ৪১ কিলোমিটার দীর্ঘ পাগলা নদীটি পাঁচ যুগ আগেও একটি গভীর নদী ছিল। গঙ্গার শাখা নদী শিবগঞ্জের শাহবাজপুর এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে কানসাট শিবগঞ্জ বাজার হয়ে ৪১ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে কালীনগরের কাছে মহানন্দা নদীতে পড়েছে। এককালের তীব্র খরস্রোতা পাগলা নদী এখন একটি সরু নালায় পরিণত হয়েছে। কয়েক বছর আগে পাগলা নদী খনন করা হলেও তাতে ফেরেনি স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ। পাগলা নদীর দুই কোল দখল করে ধান করছে আশপাশের লোকেরা। নৌচলাচলও প্রায় বন্ধ।
অন্যদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আরেক বড় নদী মহানন্দার অবস্থাও মরমর। ভারতের মালদহের ভেতরে দিয়ে ভোলাহাট পয়েন্টে মহানন্দা নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করে রহনপুর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের পাশ দিয়ে রাজশাহীর গোদাগাড়ীর উত্তরে গিয়ে পদ্মায় বিলীন হয়েছে। প্রায় ৯৫ কিলোমিটার দীর্ঘ মহানন্দা নদীও এখন বিপন্নপ্রায় একটি নদীতে পরিণত হয়েছে। বছরের চার মাস পানি থাকলেও বাকি আট মাস নদীর দুই কোলজুড়ে চাষ হচ্ছে ধানসহ বিভিন্ন ফসল। পানি উন্নয়ন বোর্ডের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোখলেসুর রহমান জানান, মহানন্দা জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ নদী। এই নদীর দুই তীরে গড়ে উঠেছে শহর-বন্দর। মহানন্দার দুই কূলে রয়েছে বেশকিছু সেচ প্রকল্প। জমিতে সেচ দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপক অবদান রাখছিল মহানন্দা। নদী এলাকায় ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটে। কিন্তু গত কয়েক বছরে নদীটির প্রবাহ কমে গেছে। মহানন্দার পানিপ্রবাহ ধরে রাখতে একটি রাবার ড্যাম নির্মাণ করা হয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের পুনর্ভবা নদীটিও ক্ষতিগ্রস্ত নদীগুলোর একটি।
সরেজমিন আরও দেখা যায়, ফারাক্কার প্রভাবে পদ্মায় পানিপ্রবাহ অস্বাভাবিক মাত্রায় কমে যাওয়ায় ব্যাপক বিপন্নতার শিকার হয়েছে রাজশাহীর বড়াল নদী। বড়াল পদ্মার অন্যতম একটি শাখা নদী। রাজশাহীর চারঘাটে পদ্মা থেকে উৎপত্তি হয়ে আড়ানী, নাটোরের বাগাতিপাড়া, বড়াইগ্রাম, পাবনার চাটমোহর, ভাঙুড়া, ফরিদপুর হয়ে সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ী দিয়ে মরা হুরা সাগর দিয়ে ১৪৭ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে পাবনার নাকালিয়ায় যমুনা নদীতে গিয়ে বিলীন হয়েছে বড়াল। সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা গেছে, বড়ালের উৎসমুখ থেকে পদ্মার পানি অনেক নিচে নেমে গেছে। বড়ালের উৎসমুখে পড়েছে বিশাল বালুস্তর। বর্তমানে বড়াল একটি সরু নালায় পরিণত হয়েছে। নদীর কোথাও পানি আছে, কোথাও নেই। বড়ালের বুকে চলছে ফসলের চাষ। পাশাপাশি পানি না থাকায় দীর্ঘপথে বড়ালের দুই পাড় দখল হয়ে গেছে। গড়ে উঠছে অবৈধ স্থাপনা। বড়ালের তীরে গড়ে ওঠা প্রাচীন ব্যবসা-বাণিজ্য কেন্দ্র আড়ানীর প্রবীণ ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম বলেন, ফারাক্কা বাঁধ চালুর পর পদ্মায় পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ায় শাখা নদী বড়ালও ধীরে ধীরে মরতে শুরু করে। স্বাধীনতার সময়েও বড় বড় মালবাহী নৌকা আসত আড়ানীতে। এখন এসব স্বপ্ন মাত্র। বড়ালে পানি নেই। নৌচলাচলও প্রায় বন্ধ। বড়ালের দুই তীরে ছোট-বড় ৪০টি ব্যবসা-বাণিজ্যকেন্দ্র গড়ে ওঠে, যেগুলো এখন ধুঁকছে। বড়ালের বিপন্নতায় অঞ্চলের অর্থনৈতিক ক্ষতিটা সবচেয়ে বেশি। বড়ালের পানি তুলে দুই তীরের হাজার হাজার বিঘা জমিতে ফসল ফলানো হতো। সেসব সেচ প্রকল্প প্রায় বন্ধ।
এদিকে ফারাক্কার প্রভাবে পদ্মার শাখা নদী রাজশাহীর মুসাখান, নাটোরের নারদ এবং ১১টি নদীর পানিপ্রবাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে বলে রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্ট শাখার প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে। গত অর্ধশত বছরে রাজশাহীর হারিয়ে যাওয়া পদ্মার শাখা নদীগুলো হলো-নারদ, সন্ধ্যা, স্বরমংলা, নবগঙ্গা, দয়া, হোজা, বারাহী, চিনারকুপ ও মুসাখান। এর মধ্যে নারদ নদীতে খননকার্য পরিচালনা করে স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ ফিরিয়ে আনার কাজ করছে বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। তবে পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক হচ্ছে না উৎসমুখে পানি না থাকায়।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল বিভাগের সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ফারাক্কার প্রভাবে দেশের ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলোর নদনদীর মধ্যে পদ্মার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা নদী পাবনার ইছামতী। ইছামতী নদীটি পাবনার রূপপুরের ভাড়ারা গ্রামের কাছে পদ্মার প্রবাহ থেকে শাখা নদী হিসাবে উৎপত্তি হয়ে বেড়া শহরের ভেতর দিয়ে ৫০ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে মরা হুরাসাগর নদীতে পতিত হয়েছে। পাবনা এলাকার আত্রাই হচ্ছে ইছামতীর একটি শাখা নদী। ইছামতী ও আত্রাই দুটি নদী এখন মৃতপ্রায়। পাবনা এলাকায় ইছামতীর দখল একটি আলোচিত ইস্যু।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, ফারাক্কার প্রতিকূল প্রভাবের কারণে পদ্মার শাখা নদী কুষ্টিয়ার গড়াই এখন মহাবিপন্ন নদীর তালিকায় উঠেছে। নদী গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদন মতে, গড়াই হচ্ছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের লাইফ-লাইন। বিভিন্ন নামে দক্ষিণের অনেকগুলো জেলার ওপর দিয়ে গেছে গড়াই। হার্ডিঞ্জ সেতুর ১৯ কিলোমিটার ভাটিতে পদ্মা থেকে গড়াই নদীর উৎপত্তি। প্রায় ৮৯ কিলোমিটার দীর্ঘ গড়াই ঝিনাইদহ, রাজবাড়ী, ফরিদপুর হয়ে নড়াইলে গিয়ে মধুমতী নাম নিয়ে বাগেরহাটে গেছে। ফারাক্কার প্রভাবে গড়াই নদীর পানিপ্রবাহ কমে গেছে। ফলে নদীপারের মানুষের জীবন-জীবিকায় প্রতিকূল প্রভাব পড়েছে। বিশেষ করে দেশের বৃহৎ সেচ প্রকল্প গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্পটি পানির অভাবে বন্ধের উপক্রম হয়েছে।
পাউবোর সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফারাক্কা বাঁধের কারণে উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ছোট-বড় প্রায় ৫৩টি নদনদীর পানিপ্রবাহ বিপন্ন হয়ে পড়েছে। অনেক নদনদী এখন অস্তিত্বই বিলীন হয়ে গেছে। ফারাক্কায় যৌথ নদী কমিশনের অন্যতম সদস্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রেজাউল করিম সম্প্রতি গঙ্গার পানি পর্যবেক্ষণ কার্যক্রমে অংশগ্রহণ শেষে দেশে ফিরেছেন। বৃহস্পতিবার দুপুরে পাউবোর এই নির্বাহী প্রকৌশলী জানান, ফারাক্কা বাঁধের কারণে পদ্মায় পানিপ্রবাহের নেতিবাচক প্রভাব দৃশ্যমান। পদ্মায় পানিপ্রবাহ কমায় পদ্মার অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ শাখা নদীর পরিস্থিতি অনেকটা বিপন্ন। এসব নদনদী পদ্মার পানিপ্রবাহের ওপর নির্ভরশীল। বছরের কয়েক মাস ছাড়া অধিকাংশ সময় পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ায় পলি জমে নদীগুলো ভরাট হয়ে গেছে। ফলে নদীগুলোর স্বাভাবিক প্রবাহ নেই। দুই দেশের চুক্তি অনুযায়ী, পদ্মায় সীমিত পরিমাণ পানি আসছে ফারাক্কা থেকে। ফলে জৌলুস হারিয়েছে পদ্মা ও তার ওপর নির্ভরশীল নদনদীগুলো। ফলে এ অঞ্চলের জনজীবনে এর নেতিবাচক প্রভাব সুদূরপ্রসারী।