
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ করে দ্রুত নির্বাচনের পথে হাঁটবে। ৩০০ আসনে নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে জামায়াত। মাঠে-ময়দানে গণসংযোগ, জনগণের দুঃখ-কষ্টে পাশে দাঁড়ানো ও অন্তর জয় করার যে দায়িত্ব-সে ক্ষেত্রে যারা প্রার্থী হিসাবে সম্ভাব্য আলোচনায় এসেছেন তাদের দিয়েছি। বর্তমানে দলের নিবন্ধনের বিষয়টি আদালতে পেন্ডিং আছে। আশা করি ন্যায়বিচার পাব এবং দাঁড়িপাল্লা প্রতীক পাব। তিনি মনে করেন, যথেষ্ট জনপ্রিয়তার অবস্থানে জামায়াত এখন সময় পার করছে। সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে জনগণ মতামত দিলে সেই ফলাফলেরই প্রতিফলন ঘটবে। জনগণ যদি ভোট দিয়ে জামায়াতকে রাষ্ট্র ক্ষমতার দায়িত্বে দেয়, তাহলে প্রত্যাশা অনুযায়ী রাষ্ট্র গঠন করা তাদের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ। সেভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
সম্প্রতি রাজধানীর মগবাজারে জামায়াতের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার যুগান্তরকে একান্ত সাক্ষাৎকার দেন। প্রায় ঘণ্টাব্যাপী সাক্ষাৎকারে দেশের চলমান পরিস্থিতি, সংসদ নির্বাচন, সংস্কার, নির্বাচনি প্রস্তুতি, বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক, জোট, দলের নিবন্ধন ও আওয়ামী লীগ ইস্যুসহ নানা বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেন জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন স্টাফ রিপোর্টার নূরে আলম জিকু
যুগান্তর : সম্প্রতি লন্ডনে বিএনপির দুই শীর্ষ নেতার সঙ্গে জামায়াতের দুই শীর্ষ নেতার সাক্ষাৎ হয়েছে। এ নিয়ে দলের কোনো ফোরামে আলোচনা হয়েছে কিনা?
গোলাম পরওয়ার : লন্ডনে কোনো বৈঠক হয়নি। উনি (খালেদা জিয়া) তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, আমরা দীর্ঘ প্রায় ২৫-৩০ বছর একসঙ্গে আন্দোলন করেছি। উনি রাজনৈতিক সহকর্মী, একই সঙ্গে খুবই অসুস্থ। আমরা যেমন মজলুম, উনিও মজলুম। জামায়াতে ইসলামীর আমির লন্ডনে গিয়েছিলেন অন্য কাজে, ওই সময় উনার (খালেদা জিয়া) স্বাস্থ্যের খোঁজখবর নিতে গিয়েছেন। জাস্ট এটা একটা সৌজন্য সাক্ষাৎ। কুশলবিনিময় করে চলে এসেছেন। ওখানে কোনো রাজনৈতিক আলাপ হয়নি।
যুগান্তর : বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্ক কেমন? ভবিষ্যতে জোট করার কোনো পরিকল্পনা আছে কিনা?
গোলাম পরওয়ার : বিএনপি একটি রাজনৈতিক দল। রাজনৈতিক দল হিসাবে যে বন্ধুত্বপূর্ণ ও সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক থাকার-সেটাই আছে। জোট হওয়ার মতো প্রক্রিয়া যখন এসে যাবে, তখন আমরা সিদ্ধান্ত নেব।
যুগান্তর : ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে আপনারা জোট গঠনের চেষ্টা করছেন, অগ্রগতি কত দূর?
গোলাম পরওয়ার : অগ্রগতি সন্তোষজনক। আমরা আশাবাদী, নির্বাচন ইস্যুতে ইসলামি দলগুলোর ভেতরে একটা সমঝোতা হবে।
যুগান্তর : আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের ব্যাপারে জামায়াতের অবস্থান কী?
গোলাম পরওয়ার : এটা আমরা আগেই বলেছি, নিষিদ্ধ করার কাজ তো সরকারের। জনগণের প্রত্যাশা যেটা, সেটা সরকারকে বিবেচনায় নিতে হবে। দল নিষিদ্ধের কাজ তো সরকার করে, কোনো পার্টি তো নিষিদ্ধ করে না।
যুগান্তর : কেউ কেউ বলছেন-আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের চেষ্টা চলছে। এ অভিযোগের বিষয়ে আপনার অভিমত?
গোলাম পরওয়ার : এ বিষয়ে একেকজন একেকভাবে বলছেন। আমরা যারা ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে ছিলাম, গত কয়েক মাসে তাদের অনেকের কথায় কিছুটা ভিন্নতা শোনা যাচ্ছে। তবে ফ্যাসিবাদের মাস্টারমাইন্ড শেখ হাসিনার নামে দুই শতাধিক মামলা হয়েছে। সাক্ষ্য-প্রমাণ হয়েছে, বিচার শুরু হয়ে যাচ্ছে। বিচারের পূর্বে যদি কেউ পুনর্বাসনের কোনো চিন্তা করে তাহলে বুঝতে হবে তারা জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনা ভুলে গেছেন।
যুগান্তর : আগামী নির্বাচনে জামায়াতের বড় চ্যালেঞ্জ কী?
গোলাম পরওয়ার : চ্যালেঞ্জ হলো নির্বাচন নিরপেক্ষ করা। মানুষ নির্ভয়ে ভোটকেন্দ্রে যাবে। পেশি শক্তি এবং কালোটাকার ছোবল থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবে। এটা দেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। একই সঙ্গে জামায়াতের চ্যালেঞ্জ হলো-জনগণ যদি ভোট দিয়ে আমাদের রাষ্ট্র ক্ষমতার দায়িত্বে দেয়, তাহলে জনগণের প্রত্যাশার যে রাষ্ট্র, সেটা গঠন করাটা আমাদের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ। সেভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছি।
যুগান্তর : জামায়াত নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত? বর্তমান প্রেক্ষাপটে জামায়াতের অবস্থান কী?
গোলাম পরওয়ার : বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে জামায়াতে ইসলামী তিনদিকেই কাজ করছে। জাতীয় নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য কী করে হতে পারে, সে ব্যাপারে ঐকমত্য কমিশনের সংস্কার ও সব দলকে ঐক্যবদ্ধ করার যে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, সেক্ষেত্রে জামায়াত তার প্রস্তাবনা দিয়ে সহযোগিতা করে যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, ৩০০ আসনে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছি। যারা প্রার্থী হিসাবে সম্ভাব্য আলোচনায় এসেছেন, মাঠে-ময়দানে তৎপরতা চালানো, গণসংযোগ করা, জনগণের মাঝে যাওয়া, পরিচিত হওয়া, মানুষের দুঃখ-কষ্ট অসুবিধায় পাশে দাঁড়িয়ে সেবা ও অন্তর জয় করার যে দায়িত্ব এটাও আমরা তাদের দিয়েছি। তৃতীয়ত, জনগণকেও বলছি সরকার এবং দেশের স্থিতিশীলতার বিরুদ্ধে যে কোনো বাইরের ষড়যন্ত্র এবং চক্র যেন সফল হতে না পারে। জামায়াত এ বিষয়ে অনেক সক্রিয় আছে, নানাভাবে পদক্ষেপ নিচ্ছে।
যুগান্তর : জামায়াত তো এখনো দলের নিবন্ধন ফিরে পায়নি?
গোলাম পরওয়ার : এটা তো আইনি ব্যাপার। আদালতে পেন্ডিং আছে। আশা করি, ন্যায়বিচার পাব এবং দাঁড়িপাল্লা প্রতীক পাব।
যুগান্তর : নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে দলের অবস্থান কী?
গোলাম পরওয়ার : আমরাও নির্বাচনের কথা বলছি। সরকার সংস্কার নিয়ে কাজ করছে। আমরা বলেছি, সেখানে যাতে অপ্রয়োজনীয় বিলম্ব না হয়। প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ করে সরকারকে নির্বাচনের দিকে যেতে হবে। রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে।
যুগান্তর : নারী নেতৃত্ব ৩৩ শতাংশ রাখার বিধান রয়েছে। এ নিয়ে আপনার দলের অবস্থান কী?
গোলাম পরওয়ার : ৪৪ শতাংশ নারী আমাদের দলের নেতৃত্বে এসে গেছেন। নির্বাচন কমিশনের সীমা আমরা পার করে ফেলেছি।
যুগান্তর : ১৯৭১ সালের ভূমিকা নিয়ে জামায়াতের বিরুদ্ধে এখনো বিতর্ক আছে। এ বিষয়ে কী বলবেন?
গোলাম পরওয়ার : এটা রাজনৈতিক বিতর্ক। সব দলের ব্যাপারে কিছু বিতর্ক থাকে, বিতর্ক আছে। সেক্ষেত্রে আমাদের যে গ্রহণযোগ্য জবাব আমরা সেটা দিয়ে যাচ্ছি।
যুগান্তর : আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চলমান বিচার সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী?
গোলাম পরওয়ার : আমরা আশাবাদী। আশা করি, তারা প্রকৃত অপরাধীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে, অন্যায় বা উদ্দেশ্যমূলকভাবে নিরপরাধীকে যেন হয়রানি করা না হয়। সেটাও আমরা ট্রাইব্যুনালের কাছে প্রত্যাশা করি।
যুগান্তর : আগামী দিনে জামায়াতের লক্ষ্য কী?
গোলাম পরওয়ার : লক্ষ্য হচ্ছে-একটা সুন্দর দেশ গঠন করা। জনগণের যে আশা-আকাক্সক্ষা, তাদের দারিদ্র্যবিমোচন, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, আইন-আদালতে সুবিচার পাওয়া, বেকারত্ব দূর করা, ধর্ম-বর্ণ, পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে সবার অধিকার সুরক্ষা করতে পারি। আন্তর্জাতিকভাবে আধিপত্যবাদীদের কবল থেকে উন্মুক্ত হয়ে যেন স্বাধীন সত্তা নিয়ে দেশ পরিচালনা করতে পারি, এ লক্ষ্যেই দেশকে পরিচালিত করা। সব রাজনৈতিক দল, মত-যারা জুলাই আন্দোলনে আমাদের মিত্র ছিল, তাদের সঙ্গে একটা জাতীয় ঐক্যের পরিবেশ তৈরি করে সামনে চলা। এটাই আমাদের লক্ষ্য।
যুগান্তর : তরুণ প্রজন্মকে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করার কী কী পদক্ষেপ নিয়েছেন?
গোলাম পরওয়ার : আমরা তরুণদের আহ্বান জানাচ্ছি যে, মেধা, জ্ঞানভিত্তিক রাজনীতি ছাড়া, দেশ ও সমাজ-সভ্যতার পরিবর্তন হয় না। অসংখ্য তরুণ এখন ইসলামের শিক্ষায় আকৃষ্ট হচ্ছে, আমাদের দলেও যোগদান করছে। এ ব্যাপারে আমাদের আলাদা বিভাগ আছে। যুবকদের জন্য আলাদা বিভাগ এবং আলাদা পরিকল্পনা নিয়ে আমাদের কাজ চলছে।
যুগান্তর : সময় দেওয়ার জন্য যুগান্তরের পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ।
গোলাম পরওয়ার : আপনাকে এবং যুগান্তরের সব পাঠককে আমার পক্ষ থেকে আন্তরিক ধন্যবাদ।