Image description
১২শ’ কোটি টাকা ব্যয়েও দূষণ বা দখলমুক্ত হয়নি

রাজধানী ঢাকাকে একসময় বলা হতো তিলোত্তমা নগরী। আর এখন এ শহরকে বলা হচ্ছেÑ দূষণের শহর, যানজটের শহর, ভোগান্তির শহর। ঢাকা দিন দিনই বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। চারপাশের নদীগুলোগুলো হলো ঢাকার প্রাণ। অথচ অবাধ দখল ও দূষণে এ শহরের চারপাশের নদীগুলো আজ মৃত। বায়ুদূষণে প্রায়ই বিশ্বের মধ্যে ১ নম্বর শহরের তালিকায় থাকছে এর অবস্থান।

গত বছরের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের এ সময় পর্যন্ত রাজধানীবাসীকে অস্বাস্থ্যকর বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে হচ্ছে। কখনো কখনো এর বাতাস খুবই অস্বাস্থ্যকর পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে। বায়ুমÐলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, গত ৯ বছরে ঢাকাবাসী মাত্র ৩১ দিন বিশুদ্ধ বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে পেরেছেন। অন্যদিকে ভয়াবহ যনজটের ভোগান্তি তো ঢাকাবাসীর নিত্যসঙ্গী। নগরীর খালগুলো যেন ময়লার ভাগাড়। এই ময়লা আবর্জনা মশার প্রজননকেন্দ্র। এতে করে মশার উপদ্রবে সারা বছরই অতিষ্ঠ থাকতে হয় নগরবাসীকে। তাছাড়া ডেঙ্গুও এখন মহামারীর রূপ নিয়ে হাজির হচ্ছে। অপরিকল্পিতভাবে খোঁড়াখুঁড়ির ফলে রাস্তা ঘাটের বেহাল দশা। গ্যাস নেই, বিদ্যুৎ নেই। ওয়াসার পানিতে ময়লা। ফুটিয়েও এ পানি পানযোগ্য করা যায় না। রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে সেবা নেই। প্রতিটি হাসপাতালেই বেডের চেয়ে তিন-চারগুণ রোগী। বারান্দায়, মেঝেতে শুয়েও রোগীরা হাসপাতালে কুকুর-বিড়ালের মতো থাকছেন। এমন এক অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ রাজধানী ঢাকাতে বিরাজ করছে। এসব বিবেচনায় যুক্তরাজ্যের ইকোনমিস্ট গ্রæপের গেøাবাল লিভেবিলিটি ইনডেক্স গত বছর ঢাকাকে বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় রেখেছে। এর পরিবেশ স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষা ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের বিবেচনায় ১৭৩টি শহরের মধ্যে বাসযোগ্যতায় ঢাকার অবস্থান এখন ১৬৮তম। তালিকায় নিচের দিক থেকে ষষ্ঠ স্থানে আছে বাংলাদেশের রাজধানী।

ঢাকার প্রাণ হলো এর চারপাশের নদী। বুড়িগঙ্গা নদীকে কেন্দ্র করেই মূলত ঢাকা শহর গড়ে ওঠেছে। এরপর তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যাÑ এসব নদীকে ঘিরে এ শহর বিস্তৃত হয়েছে। তাই নগরবিদরা বলছেন, নদী বাঁচলে ঢাকা বাঁচবে। অর্থাৎ ঢাকাকে বাঁচাতে হলে বা বসবাসযোগ্য করে গড়ে তুলতে হলে এর চারপাশের নদীগুলোকে বাঁচাতে হবে। অন্যতায় ভবিষ্যতে ঢাকা বসবাসের অযোগ্য এক পরিত্যক্ত নগরীতে পরিণত হবে। কিন্তু এই সরল সত্য বিষয়টিকে দিব্যি উপেক্ষা করছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)সহ সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠান। ঢাকার চারপাশের নদীগুলো যেমনÑ বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা এসব নদী পাড় দখল করে গড়ে ওঠেছে বিভিন্ন স্থপনা। কল-কারখানার বর্জ্যসহ গৃহস্থালি বর্জ্যওে নদীগুলো প্রতিনিয়ত দূষিত হচ্ছে। সরকারে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো এ ব্যাপারে নীরব। মাঝে মধ্যে নদী-দখলও দূষণমুক্ত করার কথা বললেও বাস্তবে এর কোনো পদক্ষেপ দেখা যায় না।

রাজধানী উন্নয়নের নামে সরকারের পক্ষ থেকে নানান পরিকল্পনা করছে, নানান প্রকল্প গ্রহণ করছে। যার মাধ্যমে এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী দুর্নীতি করে ব্যাপক অর্থের মালিক হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে এনজিওরা লাভবান হচ্ছে। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের পর জনমনে অনেক প্রত্যাশা জন্মেছিল। তারা ভেবেছিল, এবার হয়তো ঢাকার প্রকৃত উন্নয়ন হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের বন পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছিলেন, বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার চারপাশের নদীগুলোকে দখল ও দূষণমুক্ত করা হবে। তার এ বক্তব্যের পর ঢাকাবাসী বেশ অশান্বিত হয়েছিলেন। কেননা, উপদেষ্টা হওয়ার আগে একজন পরিবেশ আন্দোলনের কর্মী হিসেবে বুড়িগঙ্গাসহ দেশের সব নদীকে দখল ও দূষণমুক্ত করার জন্য তিনি অনেক আন্দোলন করেছেন। তার নিজের এনজিও বেলার পক্ষ থেকেও অনেক মানববন্ধন করেছেন, সেমিনার করেছেন। অথচ কোনো এক অদৃশ্য কারণে আজ তিনি নদীকে দখল ও দূষণমুক্ত করার কাজটিকে মুখ্য হিসেবে না নিয়ে অনেকটা গৌণ করে দেখছেন। তিনি পলিথিন বন্ধের বিরুদ্ধে সোচ্চার, খাল উদ্ধারের নামে নানান পদক্ষেপ নিচ্ছেন, বৃক্ষ রোপণের কথা বলছেন। অনেকেই বলছেন তার নেয়া প্রায় সব পদক্ষেপই এনজিও-সংশ্লিষ্ট। উপদেষ্টা হওয়ার আগে একজন এনজিওকর্মী হিসেবে তিনি বুড়িগঙ্গাসহ সব নদীর দখলদূষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করলেও এখন সে বিষয়ে তার জোরালো কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। এ বিষয়টি নগর পরিকল্পনাবিদসহ জনমনেও বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।

নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব ইনকিলাবকে বলেন, ঢাকার প্রাণ হলো বুড়িগঙ্গা নদী। এ নদীকে ঘিরে ঢাকা গড়ে উঠেছে। এরপর তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা এসব নদীকে ঘিরে এ শহর বিস্তার লাভ করেছে। তাই এ শহরকে বাঁচাতে হলে এর চারপাশের নদীগুলোকে অবশ্যই বাঁচাতে হবে। নদীকে দখল ও দূষণমুক্ত করে এতে প্রাণ ফিরিয়ে দিতে হবে। এ ছাড়া যত পরিকল্পনা গ্রহণ করা হোক, যত প্রকল্প নেয়া হোক তাতে খুব একটা সফলতা আসবে না। গাছ লাগানো, বিউটিফিকেশন কর্মসূচিÑ এসবের সুফল নগরবাসী তখনই পাবেন যখন ঢাকার চারপাশের নদীগুলো সচল থাকবে, পানি দূষণমুক্ত থাকবে। তা না হলে সব পরিকল্পনাই বিফলে যাবে।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান ইনকিলাবকে বলেন, ঢাকার প্রাণ হচ্ছে নদী। অথচ এই নদী বাঁচাতে সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই। বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর মুখে অনেক বড় বড় কথা বললেও কার্যত এর কোনো প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। নদী দখল ও দূষণমুক্ত করার ক্ষেত্রে তাদেরকে আন্তরিক বলে মনে হচ্ছে না। এর আগের সরকার ঢাকার চারপাশের বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু ও তুরাগ নদীর দখল ও ভরাটমুক্ত করতে ২০১৮ সালে ৮৪৮ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নিয়েছিল। এ প্রকল্পের মাধ্যমে কিছু পিলার বসিয়ে নদীর জায়গা অনেক অবৈধ দখলদারদের দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া ওয়াকওয়ে ও পিলার নির্মাণের নামে লুটপাট করা হয়েছে। তারপর এ প্রকল্পের কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ না হওয়ায় এর সময় ও ব্যয় বৃদ্ধি করা হয়েছে। পরিদর্শন করে। ৩৩২ কোটি টাকা ব্যয় বাড়িয়ে পিলার স্থাপন, ওয়াকওয়ে ও জেটিসহ অবকাঠামো নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ১৮১ কোটি টাকা। এত টাকার প্রকল্প নিয়েও নদী আজো দখল ও দূষণমুক্ত করা সম্ভব হয়নি। প্রকল্পের নামে শুধু লুটপাট হয়েছে। কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে এসব বিষয়ে অবশ্যই আন্তরিক হতে হবে। তাদের কাছে জনপ্রত্যাশা অনেক বেশি।
ঢাকার আশপাশের বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদী দখলমুক্ত করে নদীর গতিপথ ঠিক রাখতে ২০১৮ সাল থেকে কাজ শুরু করে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়। সীমানা পিলার স্থাপন করে ওয়াকওয়ে নির্মাণসহ অবকাঠামোতে শুরুতে ৮৪৮ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। তবে, প্রকল্পের পরিধি বাড়িয়ে তিন বছর পর এক হাজার ১৮১ কোটি টাকার প্রকল্প পাস হয় একনেকে। ২০২৩ সালের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথাছিল। কিন্তু আজো সে প্রকল্পের কাজ শেষ হয়নি। প্রায় এক হাজার ২০০ কোটি টাকা ব্যয় হলেও নদীর দূষণ বা দখল কোনো কিছুই মুক্ত হয়নি।