
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত বছরের ১৮ জুলাই উত্তরার বিএনএস সেন্টারে স্নাইপারের গুলিতে গুরুতর আহত হন টঙ্গীর তা’মীরুল মিল্লাত কামিল মাদরাসার দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী গাজী মো. জুনাইদুর রহমান। গাইবান্ধার ফুলছড়ি থানার হরিপুর গ্রামের বাসিন্দা জুনাইদুর। উপর্যুপরি গুলিতে প্রথমে হাতের রগ ছিঁড়ে যায়, পরে বুকের নিচে লাগে গুলি।
জুলাই বিপ্লবের সেই দুঃস্বপ্নের দিনগুলোর বর্ণনা দিয়ে জুনাইদুর রহমান বলেন, ‘স্নাইপারের একটি গুলি আমার ডান হাত চিরে বেরিয়ে যায়। আরেকটি গুলি বুকের নিচ দিয়ে ঢুকে তলপেটে আটকে যায়। মনে হলো যেন একটি সুই শরীরের ভেতরে ঢুকে গেল; নিশ্বাস নিতে পারছিলাম না। গুলি লাগার স্থান দিয়ে শরীরের ভেতরে বাতাস ঢুকতে ছিল। চিকিৎসকরা তিনবার অপারেশনের পর পেটের গুলিটি খুঁজে পান।’ তিনি বলেন, ‘ডান হাতে লিখতে না পারায় লেখাপড়া ও ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। আমার ক্যারিয়ারের কোনো নিশ্চয়তা নেই। এখনো সেদিনের গুলির দৃশ্য আমাকে তাড়া করে বেড়ায়।’
আন্দোলনের ঘটনা বর্ণনায় জুনাইদুর রহমান জানান, মাদরাসায় আলিম শ্রেণির বর্ষ সমাপনী পরীক্ষা চলছিল। ১৬ জুলাই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের গুলিতে আবু সাঈদ নিহত হলে আন্দোলন স্ফুলিঙ্গের মতো পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে ১৮ জুলাই উত্তরা বিএনএস সেন্টারের সামনে সহপাঠীদের সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দেন তিনি। সেখানে তারা বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ রাবার বুলেট, ছররা গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড, কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা চালায়। তখন নিরস্ত্র আন্দোলনকারীরা নিরুপায় হয়ে সাহসিকতার সঙ্গে পুলিশের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলেন। পরে পুলিশ বেপরোয়াভাবে গুলি চালাতে থাকলে একের পর এক লাশ পড়তে থাকে।
জুনাইদুর আরো জানান, ওই দিন (১৮ জুলাই) বেলা ৩টার দিকে পুলিশের গুলি চালানোর মাত্রা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। রাবার বুলেট, ছররা গুলির পাশাপাশি সীমান্তে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ব্যবহার করা স্নাইপার রাইফেল থেকে অতিমাত্রায় গুলি ছোড়া হয়। বিকাল ৫টার দিকে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ একযোগে গুলি শুরু করে। ফলে রাস্তায় টেকা যাচ্ছিল না। এই মুহূর্তে উত্তরা পূর্ব থানার ছাদ থেকে ছোড়া একটি স্নাইপারের গুলি জুনাইদুরের ডান হাত ভেদ করে বেরিয়ে যায়। একটি গুলি বুকের নিচ দিয়ে ঢুকে তলপেটে আটকে যায়।
সেদিন অন্তত ১০টি স্নাইপার রাইফেল দিয়ে অনবরত গুলি চালানো হয়েছে উল্লেখ করে জুনাইদুর রহমান জানান, চোখের সামনের একের পর এক লাশ পড়তে থাকে। গুলির স্থানটি বাম হাত দিয়ে চেপে ধরে দৌড়ে ৫০ মিটার যাওয়ার পর মাত্রাতিরিক্ত রক্তক্ষরণের পর আর এগোতে পারছিলেন না তিনি। পরে সহযোদ্ধারা তাকে উদ্ধার করে উত্তরা কুয়েত-মৈত্রী হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে অপারেশন করে পেটের গুলি বের করতে না পেরে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে তিনবার অপারেশনের পর গুলিটি বের করেন চিকিৎসকরা।
কুর্মিটোলা হাসপাতালটি যেহেতু সেনাবাহিনী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, সেহেতু তারা গুলিটি দেখেই শনাক্ত করতে পারেন যে, এটা সীমান্তে ব্যবহৃত বিজিবির স্নাইপার রাইফেলের গুলি।
এদিকে ৩ আগস্ট বিকেলে শেখ হাসিনা কুর্মিটোলা হাসপাতালে আসেন। দ্বিতীয় রোগী হিসেবে তিনি জুনাইদুরের কাছে যান। জিজ্ঞেস করেন, ‘বাবা কেমন আছো তুমি? সুস্থ আছ তো?’
শেখ হাসিনাকে দেখে রাগে-ক্ষোভে ফুঁসছিলেন জানিয়ে জুনায়েদ বলেন, ‘যে কি না গুলি করার নির্দেশ দিয়েছিল, সে কীভাবে এসে জানতে চায় আমরা কেমন আছি।’ তখন সরকারের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা তাকে জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি থাকো কোথায়?’ টঙ্গী বলা হলে, ওই কর্মকর্তা পুনরায় বলেন, ‘টঙ্গীতে থেকে উত্তরা কি তামাশা করতে এসেছ? সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করো তোমরা?’ এ সময় সেনা কর্মকর্তাসহ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা তাকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেন।
গাইবান্ধার ফুলছড়ির হরিপুর গ্রামের আনিসুর রহমান ও জাকিয়া সুলতানা দম্পতির বড় ছেলে জুনাইদুর। তার ছোট তিন বোন রয়েছে। সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, আহতদের যে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো যেন পূরণ করা হয়। সেই সঙ্গে আহতদের সহযোগিতা, পুনর্বাসন, চাকরির ব্যবস্থা, সর্বোপরি আহতদের রাষ্ট্রীয়ভাবে উপাধি দেওয়ার দাবি জানান।
বাবা আনিসুর রহমান বলেন, ‘শেখ হাসিনা ও তার দোসরদের নির্দেশে পাখির মতো গুলি করে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতাকে হতাহত করা হয়েছে। তাদের দেশে এনে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। ফ্যাসিস্ট হাসিনার বিচার আমার জীবদ্দশায়ই দেখে যেতে চাই।’