Image description
জুলাই গণহত্যার দৃশ্যমান বিচারের আগে নির্বাচনের দিকে যাওয়ার চিন্তা নেই সরকারের। অন্তত দু-একটি মামলার রায় না হলে সংসদ নির্বাচনের দিকে যাবে না ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। ফলে চলতি বছরে নির্বাচনের সম্ভাবনা ক্ষীণ। আগামী বছরের প্রথমার্ধেই হবে সংসদ নির্বাচন। এক্ষেত্রে আইনি জটিলতা না হলে রোজার আগে ভোট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অন্যথায় ঈদের পরেই ভোট হবে।
 
অন্তর্বর্তী সরকারের ঘনিষ্ঠ সূত্রে এ তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে। জানা গেছে, গত ১৬ এপ্রিল দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাতে গেলে তাদেরও সরকারের এমন অবস্থান জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিএনপির পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে, তারাও বিচারের পক্ষে। তবে বিচারের নামে যেন কালক্ষেপণ করা না হয়।
সরকারের ঘনিষ্ঠ একাধিক সূত্রের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, সরকার সংস্কার ও বিচার দুটোকেই প্রাধান্য দিয়ে এগোচ্ছে। এক্ষেত্রে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে কিছু মৌলিক সংস্কার এবং ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ জুলাই গণহত্যার সঙ্গে জড়িতদের বিচার সম্পন্ন করার বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। সরকার মনে করে তাদের প্রধান ম্যান্ডেট হলো রাষ্ট্রীয় সংস্কার ও জুলাই গণহত্যার বিচার। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বিভিন্ন সময় সংলাপে সরকার তার এ অবস্থানের কথা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে। সর্বশেষ ১৭ এপ্রিল বিএনপির সঙ্গে সংলাপেও এ বিষয় দুটি ওঠে আসে। এ ক্ষেত্রে সরকারের অবস্থান হচ্ছে- দৃশ্যমান কিছু সংস্কার এবং প্রতীকী হলেও দু-একটি বিচার সম্পন্ন করে নির্বাচনের পথে যাত্রা শুরু করবে। যার কারণে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ চাইলেও সরকার তাতে সাড়া দেয়নি।
সরকারের সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, বিচার সম্পন্ন হওয়ার বিষয়টি পুরোপুরি সরকারের ওপর বর্তায় না। এক্ষেত্রে আদালতের ওপর নির্ভর করছে। যার কারণে কবে নাগাদ বিচার প্রক্রিয়া শেষ হতে পারে সেটা টাইমফ্রেম দিয়ে বলা মুশকিল। যার কারণে সরকার হাতে একটু সময় রেখে নির্বাচনের ডেটলাইন দিয়েছে। বলছে, চলতি বছর ডিসেম্বর থেকে আগামী বছর জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। এক্ষেত্রে সরকারের নীতিগত অবস্থান পরিস্থিতি যা-ই হোক না কেন তারা জুনের পর একদিনও ক্ষমতায় থাকবে না।
নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ চাইতে গত ১৬ এপ্রিল প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিএনপির প্রতিনিধি দল। ওই বৈঠকে নির্বাচন, সংস্কার ও জুলাই গণহত্যার বিচারের বিষয়ে সরকারের অবস্থান তুলে ধরা হয় বলে জানা গেছে। বিএনপির সঙ্গে আলোচনাকালে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল জুলাই গণহত্যার বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে কথা বলেন। বিচারের বিষয়ে জনগণের একটি ম্যান্ডেট রয়েছে উল্লেখ করে বিএনপির প্রতিনিধিদের তিনি বলেন, অনন্ত পক্ষে একটি মামলার হলেও বিচার আমাদের শেষ করতে হবে। নাহলে দেশবাসীর কাছে আমাদের জবাবদিহি করতে হবে। এ সময় তিনি চলতি মাসের মধ্যে দুই থেকে তিনটি মামলার চার্জশিট দাখিল হওয়ার সম্ভাবনার কথাও জানান।
ওই বৈঠকের পর সংবাদ ব্রিফিংয়ে আসিফ নজরুল বলেন, ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সংসদ নির্বাচন হবে। সরকার ইচ্ছাকৃত দেরি করে মে বা জুন মাসে নির্বাচন করবে বিষয়টি সেটা নয় বলে তিনি জানান।
জুলাই গণহত্যার বিচারের প্রসঙ্গ টেনে আসিফ নজরুল বলেন, আমাদের জনগণের তো একটা আকাঙ্ক্ষা আছে যে, আমরা বিচার করে যাই। আমরা যদি কোনো বিচার না করে ইলেকশন দিই, আমরা মানুষের কাছে নিজের কাছে জবাব দেব কীভাবে? ফলে সংস্কার, বিচার এবং আমাদের সরকারের গৃহীত কিছু পদক্ষেপের ওপর নির্ভর করে এজন্যই ডিসেম্বর থেকে জুন টাইম বারটা করা হয়েছে।
শেখ হাসিনার মামলার বিচার বিলম্ব হচ্ছে, বৈঠকে বিএনপির তরফে এমন বক্তব্য এসেছে তুলে ধরে তিনি বলেন, এর আগে যে বিচার হয়েছে সেটা তুলনা করে আমরা দেখিয়েছি। বলেছি, যে কোনো ধরনের বিলম্ব করা হচ্ছে না। আমরা তাদের সবকিছু বুঝিয়ে বলার পর তারা আর কথা বলেননি।
এর আগে জানুয়ারিতে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল আশা প্রকাশ করে বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগেই ট্রায়াল কোর্ট তথা বিচারিক আদালতে এই বিচারকাজ শেষ করা সম্ভব হবে।
সরকারের একাধিক দায়িত্বশীল ব্যক্তির সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, জুলাই গণহত্যা সংশ্লিষ্ট দুই-তিনটি মামলাকে সামনে রেখে তারা এগোচ্ছে। ওইসব মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা, প্রসিকিউশনসহ সংশ্লিষ্টদের থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে সরকার ধারণা করছে ডিসেম্বরের মধ্যে অন্তত দুটি মামলার বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ হবে। একই সময়ে তাদের সংস্কার কার্যক্রমও একটি পর্যায়ে দাঁড়াবে। এরপরই ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিলের দিকে এগোবে সরকার।
জানা গেছে, আগামী বছর রোজা শুরুর আগে নির্বাচন সম্পন্ন করার ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। আগামী বছর ১৮ ফেব্রুয়ারি রোজা শুরুর সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ বা জানুয়ারির শুরুতে তফশিল ঘোষণা করে ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের ভোটগ্রহণের তারিখ নির্ধারণ করা হতে পারে। এক্ষেত্রে ফেব্রুয়ারির ১২ থেকে ১৫ তারিখের মধ্যে ভোটের দিন চূড়ান্ত হতে পারে।
অবশ্য, বিচারিক প্রক্রিয়ায় কিছুটা বিলম্ব হলে এবং ভোটার তালিকা হালনাগাদ সংক্রান্ত আইনি জটিলতা তৈরি হলে নির্বাচনে আরো দুই মাস পেছাতে পারে। সেক্ষেত্রে ২ মার্চ হালনাগাদ করা চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশের পরপরই নির্বাচনি তফশিল ঘোষণা করে এপ্রিলের মাঝামাঝি ভোট গ্রহণের তারিখ নির্ধারণ করা হতে পারে।
রোজার আগে পরে যখনই ভোট হোক না কেন ২০২৬ সালের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা এবং গ্রীষ্মের ঝড়-বৃষ্টির বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হবে বলে সরকারি সূত্র জানিয়েছে।
উল্লেখ্য, গত ১১ ফেব্রুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে আইনমন্ত্রী মার্চের মধ্যে দুই-তিনটি মামলার চার্জশিট হবে এমনটা জানিয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে গণহত্যা এবং এর আগে গুম-খুনের ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হওয়া মামলাগুলোর মধ্যে তিন থেকে চারটির রায় অক্টোবরের মধ্যে পাওয়া যাবে বলে আশা প্রকাশ করেছিলেন। তবে, আইনমন্ত্রীর প্রত্যাশা অনুযায়ী চার্জ গঠন না হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই বিচারিক প্রক্রিয়া পিছিয়ে যাবে।
গতকাল সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা একটি মামলার প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। অবশ্য, এই মামলার আসামিরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য। জানা গেছে, চলতি মাসের মধ্যে আরেকটি মামলার চার্জ গঠন হতে পারে। যদিও এ দুটি মামলায় শেখ হাসিনা বা তার সরকারের কাউকে এ পর্যন্ত আসামি করা হয়নি। তাদের ব্যাপারে পৃথক তদন্ত চলছে। ওই তদন্তের ভিত্তিতে তাদের আসামি করা হতে পারে। মূলত গণহত্যা সম্পর্কিত সবগুলোর মামলাতেই নির্দেশদাতা হিসেবে ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হুকুমের আসামি হিসেবে যুক্ত করা হবে প্রসিকিউশন সূত্রে জানা গেছে।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ২৫ মার্চ জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়ের রিপোর্টের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, বিক্ষোভকারীদের হত্যা করতে শেখ হাসিনা নিজেই নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কীভাবে একজন প্রধানমন্ত্রী নিজ দেশের নিরস্ত্র মানুষকে হত্যার পর লাশ লুকিয়ে ফেলার নির্দেশ দিতে পারে। ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার জন্য তিনি পৃথিবীর সব নিষ্ঠুরতা ছাড়িয়ে গেছেন। মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার কার্যালয়ের প্রতিবেদনকে অন্তর্বর্তী সরকার গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, যারা গণহত্যায় জড়িত ছিল, যারা নির্বিচারে মানুষ হত্যা করেছে, যারা এরই মধ্যে হত্যাকারী হিসেবে বিশ্বের কাছে স্বীকৃত তাদের বিচার এ দেশের মাটিতে হবেই।
তিনি বলেন, নির্বাচনের ব্যাপারে আগেও বলেছি, আবারও বলছি, এ বছর ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে।
সম্প্রতি তিন গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক এসকে তৌফিক হক, সৈয়দা লাসনা কবীর এবং মোহাম্মাদ ঈসা ইবন বেলাল একটি জাতীয় দৈনিকে যৌথ মতামত কলামে লিখেছেন, সরকারের উচিত হবে জনগণের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী সংস্কার-বিচার এবং রাজনৈতিক দলের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী নির্বাচন বিষয় ঐকমত্য তৈরি করে একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করা। তারা লিখেছেন, অনির্দিষ্টকালের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতায় থাকা যেমন কাঙ্ক্ষিত নয়, তেমনি জনগণের অভ্যুত্থান–পরবর্তী মৌলিক আকাঙ্ক্ষার ন্যূনতম বাস্তবায়ন ছাড়া নির্বাচনও গ্রহণযোগ্য হবে না। এই দুইয়ের মধ্যে একটি যৌক্তিক সমন্বয়ের মাধ্যমে ২০২৬ সালের জুনকে মাথায় রেখে সংস্কার, বিচার ও নির্বাচনের একটি সমন্বিত রূপরেখা প্রণয়নের ব্যাপারে সব পক্ষ একযোগে কাজ করলে বাংলাদেশের জনগণ উপকৃত হবে।
গত ১৮ এপ্রিল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার এক অনুষ্ঠানে সরকারকে উদ্দেশ্য করে বলেন, প্রয়োজনীয় সংস্কার ও জুলাই গণহত্যার বিচার নিশ্চিত করার পর নির্বাচন দিন। অন্যথায় জনগণ নির্বাচন মানবে না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ আমার দেশকে বলেন, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে সংস্কার ও বিচারিক প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সরকারের তরফ থেকে জানানো হয়েছে চলতি মাসে একাধিক মামলার চার্জশিট দেওয়া হবে। আগস্ট-সেপ্টেম্বরের মধ্যে এসব মামলার রায় হতে পারে বলে অনুমান করেছে।
বিচার প্রসঙ্গে বিএনপির অবস্থান স্পষ্ট করে সালাউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা শেখ হাসিনাসহ ওই দলের যারা গণহত্যায় জড়িত আমরা তাদের সবার বিচার চাই। তবে, এ বিচার হতে হবে যৌক্তিক সময়ের মধ্যে। অযথা সময়ক্ষেপণ করা যাবে না। এজন্য আমরা ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি তাদের লজিস্টিক সাপোর্ট বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছি।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মো. তাজুল ইসলাম চলতি মাসে আরেকটি মামলার চার্জশিট হবে বলে বলে আমার দেশকে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় জানান। তবে, তিনি বলেন, মামলার শুনানি বা রায় কবে হবে এটা আদালতের বিষয়। এটা বলার কোনো সুযোগ নেই।
প্রধান উপদেষ্টার সিনিয়র সহকারী প্রেস সচিব ফয়েজ আহম্মদ আমার দেশকে বলেন, সরকারের সংস্কার ও জুলাই গণহত্যার বিচারের একটি প্রতিশ্রুতি তো রয়েছে। তবে এর সঙ্গে নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই। সংস্কার, বিচার কার্যক্রম ও নির্বাচন সবই নিজস্ব গতিতে চলছে। একটির জন্য অন্যটি বাধা হয়ে দাঁড়ানোর সুযোগ নেই। আর নির্বাচনের বিষয়ে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট- ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।