Image description

রাজধানীতে মাদকের অন্যতম আড়ত হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প। ক্যাম্পের ৯টি সেক্টরজুড়ে প্রকাশ্যেই চলছে মাদক ব্যবসা। মাদকের আগ্রাসন কমাতে প্রতিনিয়ত অভিযান পরিচালনা করছে যৌথ বাহিনী। পুলিশের পাশাপাশি র‌্যাব ও সেনাবাহিনীর অভিযানে গ্রেপ্তার হচ্ছে শীর্ষ মাদক কারবারিসহ তাদের অনুসারীরা। তবে এই গ্রেপ্তার অভিযানেও থেমে নেই মাদকের আগ্রাসন। শুধু বদলে যাচ্ছে সিন্ডিকেট। 

জেনেভা ক্যাম্পের বাসিন্দা ও মাদক কারবারিদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে। তাদের ভাষ্যমতে, একজন শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী গ্রেপ্তার হলে তার পরিবার বা প্রতিপক্ষ সেই ব্যবসার আধিপত্য দখল করে নেয়। মাদক ব্যবসায়ীর পরিবর্তন হলেও ক্যাম্পে মাদক বিক্রির চিত্র পাল্টায় না।

গত মঙ্গলবার (১৫ এপ্রিল) জেনেভা ক্যাম্পের পূর্ব পাশে হুমায়ুন রোড দিয়ে প্রবেশের সময় বেশ কয়েকজন যুবককে গোল হয়ে বসে থাকতে দেখা যায়। পাশে দুজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। একজন পকেট থেকে টাকা, অন্যজন কাগজে মোড়ানো কিছু আদান-প্রদান করছে। সঙ্গে থাকা সোর্স জানায়, কাগজে মুড়িয়ে হেরোইন দেওয়া হয়েছে। বিক্রেতার নাম পনি, সে হেরোইন ও ইয়াবা বিক্রেতা। অপর পাশে গোল হয়ে গাঁজার আসর বসেছে।

তখন দুপুর প্রায় ১টা। পাশেই ছিল সিএনজি, রিকশা ও মানুষের চলাচল। দিনদুপুরে প্রকাশ্যে এভাবেই মাদক বিক্রি হচ্ছে মোহাম্মদপুরের প্রায় প্রতিটি গলিতে।

ক্যাম্পের ভেতর সেক্টর ৪ ও ২-এর মাঝামাঝি রাস্তায় শাকিল বুক ডিপোর সামনে পিচ্চি রাজার স্পট, কিছুদূর এগিয়ে শামীম হোটেলের সামনে পাকিস্তানি রাজুদের স্পট। আরেকটু এগিয়ে ডাব দোকানের সামনে ও কাঁচা বাজারের মুখে নেটা সামিরের স্পট-এ এমন মাদক বিক্রির চিত্র চোখে পড়ে। এ ছাড়া ক্যাম্পের পূর্ব পাশে হুমায়ুন রোডে ইমতিয়াজ, কালা ফয়সাল, শাহ আলমের হেরোইন, ইয়াবা ও গাঁজার স্পট। লাইনের কিছুটা দূরে পাঁচ ভাই সোনু, হাসিব, মিনর, হীরা ও মিঠুদের ইয়াবা ও গাঁজার স্পট। একই রাস্তার অপর পাশে তিন ভাই বিল্লাল, ইকবাল ও আজাদের গাঁজার স্পট। ৭ নম্বর সেক্টরে সিমার মোড়ে নাদিম ও ফরিদের ইয়াবার স্পটে গিয়েও খোলামেলা মাদক বিক্রির চিত্র দেখা গেছে। এ ছাড়া ক্যাম্পের মুরগিপট্টি, এ ওয়ান মোড়, শহীদ হোটেলের মোড়সহ আরো কয়েকটি স্থানে গিয়েও প্রকাশ্যে মাদক বিক্রি করতে দেখা যায়। সোর্স ও স্থানীয়রা নিশ্চিত করেছে, এই স্পটগুলোর বেশির ভাগই আমজাদ আলী ওরফে সৈয়দপুরিয়া বাবু ও তার সঙ্গীরা নিয়ন্ত্রণ করে।

মোহাম্মদপুর জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) এ কে এম মেহেদী হাসান কালের কণ্ঠকে বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান পুলিশের নিয়মিত কার্যক্রম। মোহাম্মদপুরে যেহেতু একাধিক বস্তি আছে, সেই বস্তিকে কেন্দ্র করে মাদক কারবারিরা বেপরোয়া হয়ে উঠছে। এ জন্য আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। আমরা সাফল্যের সঙ্গে শীর্ষ মাদক কারবারিসহ অনেক মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তারে সক্ষম হয়েছি।

থানা সূত্রে জানা যায়, গত ১৬ এপ্রিল সৈয়দপুরিয়া বাবু ও তার সঙ্গীদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এর আগে গত বছর ২ নভেম্বর র‌্যাবের অভিযানে গ্রেপ্তার করা হয় মাদকসম্রাট ভুঁইয়া সোহেল ওরফে বুনিয়া সোহেলসহ তার ১৪ সহযোগীকে। ৯ জানুয়ারি গ্রেপ্তার হয় বুনিয়া সোহেলের প্রতিপক্ষ সেলিম আশরাফী ওরফে চুয়া সেলিম।

জেনেভা ক্যাম্পের স্থানীয় বাসিন্দা আলী আকবর কালের কণ্ঠকে বলেন, এভাবে গ্রেপ্তার অভিযান অব্যাহত থাকলেও ক্যাম্প থেকে মাদক নির্মূল করা সম্ভব হবে না। কারণ এখানে একাধিক সক্রিয় গ্রুপ থাকার পাশাপাশি সবাই রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ছত্রচ্ছায়ায় মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে। অনেকে আবার পুলিশ প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করেই ব্যবসা করছে। ফলে অভিযানের আগেই তারা গোপন সংবাদ পেয়ে সটকে পড়ে।

বদলে যাচ্ছে সিন্ডিকেট : অনুসন্ধানে জানা যায়, বর্তমানে জেনেভা ক্যাম্পের শীর্ষ হেরোইন ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত মাদকসম্রাট বুনিয়া সোহেল। তবে তার গ্রেপ্তারের পর হেরোইন ব্যবসার আধিপত্য দখল করে সৈয়দপুরিয়া বাবু। সম্প্রতি তাকে গ্রেপ্তার করা হলেও ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ এখনো তার কাছে। ইয়াবা ব্যবসায় অন্যতম হোতা ছিল চুয়া সেলিম। তাকে গ্রেপ্তারের পর সম্প্রতি সেই স্থান দখল করে নেয় শান্ত। এ ছাড়া চুয়া সেলিমের কিছু অংশে আধিপত্য বিস্তার করছে নেটা সামির ও তার মামা কামরান। অন্যদিকে শীর্ষ মাদক কারবারি ইশতিয়াকের মৃত্যুর পর গাঁজা ব্যবসার হাল ধরেছে তারই ম্যানেজার জাভেদ।

এ ছাড়া অন্যান্য শীর্ষ মাদক কারবারির মধ্যে রয়েছে ইয়াবা সম্রাট খ্যাত পাকিস্তানি রাজু এবং গাঁজা ব্যবসার অন্যতম হোতা মাদকসম্রাজ্ঞী রানী। গাঁজার অপর একটি সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছে বুনিয়া সোহেলের ভাই টুনটুন, পিচ্চি রাজা, কান কামরান ও তার বড় ভাই সুরজ। গাঁজায় পৃথক সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে জয়নুল, মোনা, সগির এবং এস কে রাব্বানী। এ ছাড়া দীর্ঘদিন কারাভোগের পর জামিনে মুক্ত হয়ে আবারও মাদক কারবার শুরু করেছে ইয়াবা সুন্দরী পাপিয়ার স্বামী পাচু ওরফে নদিম।

আবার শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তারের পর অনেক খুচরা ব্যবসায়ীও এখন সরাসরি কক্সবাজার বা টেকনাফ থেকে মাদক এনে ক্যাম্পে বিক্রি করছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জেনেভা ক্যাম্পের ১ নম্বর সেক্টরের মসজিদ গলিতে জাভেদের মাদক স্পট পরিচালনা করে ইরফান। সে জেনেভা ক্যাম্পের বোবা বিরিয়ানির মালিক আলতাফের ছেলে। ২ নম্বর সেক্টরে ক্যাসেট দোকানের সামনের মাদকের স্পটটি পরিচালনা করছে পিচ্চি রাজা। একই এলাকায় মাদক বিক্রি করে নাঈম ওরফে পিস্তল নাঈম। মূলত শামীম হোটেলের সামনে মাদক বিক্রি করে নাঈমের লোকজন। ক্যাম্পে কাপড়ের মার্কেট এলাকার ইয়াবার স্পট চালায় নেটা সামীর। ইয়াবা সুন্দরী পাপিয়ার স্বামী পাচু ওরফে নাদিমের স্পট গফুর হোটলের সামনে।

এ ছাড়া পিচ্চি রাজা, সামির ওরফে পিচ্চি সামির, মনু ওরফে কোপ মনু, শাহ আলম, আরজু ওরফে মুতনা আরজু, হাসিব ওরফে লেলা হাসিব, নাদিম, ফরিদ ও কান কামরান ও সুরজসহ খুচরা পর্যায়ে শতাধিক ব্যবসায়ী এখন নিজেরাই মাদক এনে নিজ নিজ স্পট গড়ে তুলছে।

একাধিক মাদক ব্যবসায়ী কালের কণ্ঠকে জানায়, সুরজ ও কামরান আগে পিচ্চি রাজার হয়ে মাদক বিক্রি করত। বর্তমানে তারা কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে নিজেরাই ইয়াবা কিনে আনছে। ১ নম্বর সেক্টরে নিজের বাসা থেকেই ইয়াবার স্পট চালায় তারা। ১ নম্বর সেক্টর থেকে মডেল স্কুল পর্যন্ত ঘুরে ঘুরে মাদক বিক্রি করে সুরজের লোকজন। সম্প্রতি কক্সবাজার থেকে ফেরার পথে চট্টগ্রামের আনোয়ারায় সুরজকে গ্রেপ্তারে অভিযান চালায় জেলা ডিবি পুলিশের একটি টিম। কিন্তু অভিযানের আগেই প্রাইভেট কার থেকে নেমে পালিয়ে যায় সুরজ।

চট্টগ্রাম ডিবি পুলিশের কর্মরত উপ পুলিশ পরিদর্শক আব্দুল্লাহ আল মামুন এ বিষয়ে বলেন, গোপন সূত্রে জানতে পারি মাদক কারবারি সুরজ কক্সবাজার থেকে বিপুল ইয়াবা নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়েছে। তাকে ধরার জন্য আমরা চেকপোস্ট বসাই। সুরজ যে প্রাইভেট কারে করে কক্সবাজার গিয়েছিল সেটা থামিয়ে তল্লাশি করা হয়। পরে গাড়ির ড্রাইভার জানায়, সুরজ মাঝপথে নেমে বিমানে ঢাকায় চলে গেছে।