
আউটসোর্সিংয়ের লোকবল নিয়োগে নোয়াখালী সিভিল সার্জন কার্যালয় ২০২২-২৩ অর্থবছরে দরপত্র প্রকাশ করলে কাজ পেতে স্থানীয় ও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ঠিকাদাররা অংশ নেন। সে সময় ঢাকা থেকে অংশ নেওয়া একজন ঠিকাদারকে কাজ দিতে তৎকালীন সিভিল সার্জন ডা. মাসুম ইফতেখার মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ঠিকাদার মো. মাহফুজুর রহমান বলছেন, চাহিদামতো অর্থ দেওয়া সম্ভব নয় বলে জানানোর পর সিভিল সার্জন তার বাবার অসুস্থতার কথা বলে ১২ লাখ টাকা ধার নেন। পরে কাজ পেতে চাইলে আরও ২০ লাখ টাকা দিতে হবে বলে জানান সিভিল সার্জন। এত টাকা দিতে না পারায় সিভিল সার্জন তখন অন্য বিডারকে কাজ দিয়ে দেন। এরপর দুই বছর অতিবাহিত হতে চললেও বাবার অসুস্থতার কথা বলে ধার নেওয়া ১২ লাখ টাকা ফেরত দেননি সিভিল সার্জন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঠিকাদার মো. মাহফুজুর রহমানকে কাজ পাইয়ে দিতে তৎকালীন সিভিল সার্জন ডা. মাসুম ইফতেখার প্রথমে ৪০ লাখ টাকা দাবি করেন। সেটি না পেয়ে সিভিল সার্জন তার বাবা অসুস্থ বলে ১২ লাখ টাকা ধার নেন। পরে কাজ দিতে আরও ২০ লাখ টাকা দাবি করেন। এতে অপারগতা প্রকাশ করলে সিভিল সার্জন অন্য ঠিকাদারকে কাজ দিয়ে দেন। এরপর পাওনা টাকা ফেরত চাইলে ডা. মাসুম ইফতেখার এক লাখ ৮০ হাজার টাকা মাহফুজুর রহমানকে ফেরত দেন এবং বাকি টাকা দুই কিস্তিতে পরিশোধের আশ্বাস দেন।
এই লেনদেনের বিষয়ে ঠিকাদার মাহফুজুর রহমান ও ডা. মাসুম ইফতেখারের হোয়াটসঅ্যাপ কনভারসেশন ও অডিও কালবেলার হাতে রয়েছে। এতে দেখা গেছে, ঠিকাদার মাহফুজুর রহমান টাকা ফেরত চাইলেই ডা. মাসুম ইফতেখার তার বাবার অসুস্থতার অজুহাতে সময় ক্ষেপণ করেন। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ডা. মাসুম ইফতেখারকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ওএসডি করে রাখা হয়। বর্তমানে তিনি ঠিকাদার মাহফুজুর রহমানের ফোন নম্বর ব্লক করে রেখেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এ ঘটনায় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর অভিযোগ দেন ঠিকাদার মাহফুজুর রহমান। এতে ঘুষ লেনদেনের বিস্তারিত তুলে ধরে টাকা ফেরত না পাওয়ার কথাও উল্লেখ করা হয়।
অভিযোগে আরও বলা হয়, ‘ডা. মাসুম ইফতেখার গত বছরের ২৫ নভেম্বর এবং ১০ ডিসেম্বর দুই কিস্তিতে টাকা পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, কিন্তু নির্ধারিত সময়ে টাকা পরিশোধ করেননি। এর পর যোগাযোগ করা হলে মাহফুজুর রহমানের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন নম্বরটি ব্লক করে দেন। ডা. মাসুমের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে গেলে তিনি তার ভাড়াটিয়া গুন্ডা দিয়ে মারধরের হুমকি দেন। এ সংক্রান্ত বিষয়ে লেনদেনের কিছু ডকুমেন্ট ও মোবাইলের কল রেকর্ডের প্রমাণ আমার কাছে রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত সাপেক্ষে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণেরও দাবি জানাই।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে ডা. মাসুম ইফতেখার কালবেলাকে বলেন, ‘মো. মাহফুজুর রহমান নামে আমাদের কোনো ঠিকাদার দরপত্রে অংশ নেননি। এই নামে কাউকে আমরা চিনিও না। একটা গোষ্ঠী আমাকে হয়রানি করতে এসব মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে সম্মান ক্ষুণ্ন করছে। এর আগে ২০২৩ ও ’২৪ সালেও দুবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং মন্ত্রণালয়ে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়ে হয়রানি করেছে। অথচ তারা তদন্ত করে আমার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগের কোনো প্রমাণ পায়নি।’
তিনি বলেন, ‘আমি দায়িত্বে থাকা অবস্থায় নিয়মতান্ত্রিকভাবে কাজ করার চেষ্টা করেছি। কোনো অনিয়মে জড়াইনি। কারও থেকে অর্থ নেওয়া কিংবা কাউকে হুমকি দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এসব আমাকে হয়রানি করতে ভিত্তিহীন অভিযোগ ছাড়া কিছুই নয়।’
এ বিষয়ে ঠিকাদার মো. মাহফুজুর রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘একজন সিভিল সার্জনকে আমি কেন হয়রানি করব। ২০২২ সাল থেকেই আমি অফিসিয়ালভাবে কাগজপত্র জমা দিচ্ছি। অধিদপ্তরে অভিযোগ দেওয়ার পর থেকেই সিভিল সার্জন বলে যাচ্ছেন অভিযোগ তুলে নেওয়ার জন্য। তিনি যদি সঠিক হন, তাহলে অভিযোগ ফেস করতে চান না কেন? ওএসডি হওয়ার পর থেকে তিনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ন্যস্ত হয়েও অফিসে আসেন না। আমি লিগ্যাল বলে আমি লিগ্যাল পদ্ধতিতে এগোচ্ছি। আমার তো টাকার বিষয়। তিনি আমার ব্যক্তিগত নম্বর ব্লক করে রেখেছেন। তার কোনো ভয় না থাকলে তিনি কেন আমাকে ব্লক করে দিয়েছেন।’
তিনি বলেন, ‘কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্য প্রথমে ডা. মাসুম ইফতেখার আমার কাছে ৪০ লাখ টাকা দাবি করেন। এত টাকা কেন লাগবে বললে তখন তিনি জানান ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করতে টাকা দিতে হবে। এরপর একবার তার বাবা অসুস্থ, আর্জেন্ট টাকার প্রয়োজন বলে আমার কাছ থেকে ১২ লাখ টাকা নেন। পরে কাজ দেওয়ার কথা বলে আরও ২০ লাখ টাকা চান। ওই টাকা দিতে অপরাগতা প্রকাশ করলে তিনি জানিয়ে দেন, আমাকে কাজ দিতে পারবেন না। আমি পাওনা টাকা চাইলে এ নিয়ে তিনি গড়িমসি করায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক বরাবর একটি অভিযোগ করি। এরপর এক লাখ ৮০ হাজার টাকা ফেরত দেন। পরে তার নোয়াখালী কার্যালয়ে টাকা দেওয়ার কথা বলে ডেকে নিয়ে স্থানীয় সন্ত্রাসী দিয়ে ভয় দেখিয়ে অভিযোগ তুলে নেন; কিন্তু এরপর থেকে আর টাকা ফেরত দিচ্ছেন না। ২০২২ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত তিন বছর ধরে পাওনা টাকার জন্য তার পেছনে ঘুরছি; কিন্তু কোনো প্রতিকার পাচ্ছি না। এখন আমি নিরুপায়।’