
বেসরকারি প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জাহিদুল ইসলাম পারভেজকে ছুরিকাঘাত করে হত্যাকাণ্ডে জড়িত ঘাতকরা এখনো অধরা। পুলিশ এখনো তাদের গ্রেপ্তার করতে পারেনি। তবে এ ঘটনায় বনানী থানায় আটজনকে আসামি করে শনিবার রাতেই একটি মামলা করেছেন নিহত শিক্ষার্থীর ভাই হুমায়ুন কবির। মামলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের এলএলবি ও ইংরেজি বিভাগের তিন ছাত্র মাহাথি, মেহেরাব, আবুজর গিফারী ছাড়াও আরও পাঁচজনকে আসামি করা হয়েছে। নিহত শিক্ষার্থী পারভেজ টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ২২৩ ব্যাচের ছাত্র। তার বাড়ি ময়মনসিংহে।
বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রাসেল সরোয়ার বলেন, শনিবার বিকাল ৪টার পর বনানীতে প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ ও টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘাত শুরু হয়। এ সময় ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থীদের ছুরিকাঘাতে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী পারভেজ নিহত হন। তিনি বলেন, আমাদের টিম মাঠে কাজ করছে। তবে এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। বনানী থানার উপ-পরিদর্শক এ কে এম মইনুদ্দিন বলেন, প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষের ঘটনায় নিহত জাহিদুলের ভাই হুমায়ুন কবির বাদী হয়ে একটি মামলা করেছেন।
কী ঘটেছিল রাতে: পুলিশের তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র ও প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষার্থীরা বলেছেন, শনিবার বিকাল ৪টায় বনানীর ১২ কামাল আতাতুর্ক এভিনিউয়ের স্টার টাওয়ারে অবস্থিত প্রাইম এশিয়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে একটি টং দোকানে বন্ধুদের সঙ্গে শিঙাড়া খাচ্ছিলেন শিক্ষার্থী জাহিদুল ইসলাম পারভেজ। তার পাশেই বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে সদ্য ভর্তি হওয়া ইংরেজি ও ইন্টারন্যাশনাল হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্টের শিক্ষার্থী মাহাথি, মেহেরাব, আবুজর গিফারী সহ বেশ কয়েকজন। তাদের সঙ্গে ছিলেন ইউনিভার্সিটি অব স্কলার্সের দুই মেয়ে বন্ধু। এ সময় দুই নারী শিক্ষার্থী অভিযোগ করেন পারভেজ তাদের উত্ত্যক্ত করেছেন। বিষয়টি তারা প্রথমে প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটির প্রক্টর মোশাররফ হোসেনকে জানান। এরপর প্রক্টর পারভেজকে ডেকে নেন। এ সময় প্রক্টর অফিসে পারভেজ দাবি করেন- তিনি তার বন্ধুদের সঙ্গে নিজেদের নিয়ে আলাপ করছিলেন। সেই বিষয় নিয়েই নিজেরা হাসাহাসি করছিলেন, কাউকে উত্ত্যক্ত করেননি। এরপরও প্রক্টর পারভেজকে সরি বলতে বলেন। একপর্যায়ে ওই দুই ছাত্রীর কাছে সরি বলে ক্ষমা চান পারভেজ। তবে ক্ষমা চেয়েও মাফ পাননি তিনি। এরপর ৩০ থেকে ৪০ জন বহিরাগত ডেকে নেন ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থীরা। এ সময় পারভেজ ও তার এক বন্ধু ক্যাম্পাস থেকে বের হলে তাদের ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যান তারা। গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নেয়া হলে পারভেজকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে নিহত পারভেজের লাশের জন্য অপেক্ষারত তার মামাতো ভাই ও মামলার বাদী হুমায়ুন কবির বলেন, এক ভাই এক বোনের মধ্যে পারভেজ ছিল বড়। ছোট বোন ঢাকার মাইলস্টোনে পড়াশোনা করে। বাবা জসিম উদ্দিন কুয়েত প্রবাসী। মা পারভীন আক্তার গৃহিণী। তাদের গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা উপজেলার ফাই চাঁন গ্রামে। পারভেজ কাফরুলে কাজিপাড়া আলহেরা হাসপাতালের পাশে একটি মেসে থাকতো। প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ২২৩ ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিল পারভেজ। তিনি বলেন, আমার ভাই শান্ত স্বভাবের ছিল। কোনো মারামারির মধ্যে ছিল না। কেন তাকে হত্যা করা হলো বুঝতে পারছি না। এই হত্যার বিচার চাই। এ সময় ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক ডা. সাইফুল আলম বাদশা বলেন, নিহত পারভেজ ছাত্রদলের সক্রিয় কর্মী ছিল। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে পাওয়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, রক্তাক্ত অবস্থায় পেটে হাত রাখা অবস্থায় নিস্তেজ হয়ে পারভেজ একটি চেয়ারে বসে রয়েছেন। তার আশপাশে কয়েকজন তাকে নড়াচড়া করানোর চেষ্টা করছিলেন। কোনোভাবেই সাড়া দিচ্ছিলেন না পারভেজ। এরপর রক্তাক্ত অবস্থায় সহপাঠীরা তাকে কুর্মিটোলা হাসপাতালে নিয়ে যান। তবে হাসপাতালে যাওয়ার পথে পারভেজের কোনো সাড়া পাচ্ছিলেন না তাকে বহন করে নিয়ে যাওয়া শিক্ষার্থীরা।
গতকাল সকাল পৌনে ১১টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে নিহত শিক্ষার্থী পারভেজের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। ময়নাতদন্ত করেন ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক প্রভাষক ডা. ফারহানা ইয়াসমিন। এর আগে তার লাশের সুরতহাল করেন বনানী থানার এসআই মওদুদ কামাল। সুরতহাল প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেছেন, শনিবার বিকালে প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে গুরুতর জখমপ্রাপ্ত হন পারভেজ। তাকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। তার বুকের বাম পাশে একটি জখমের আঘাত রয়েছে।
ছুরিকাঘাতে নিহত জাহিদুল ইসলাম পারভেজের জানাজা গতকাল বিএনপি’র কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। তার আগে দুপুর সাড়ে ১২টায় তার মরদেহ পল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে নেয়া হয়। জাহিদুল ইসলামের চাচাতো ভাই দেলোয়ার হোসেন বলেন, পল্টনে জানাজা শেষে মরদেহ প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নেয়া হয়। সেখানে জানাজা শেষে গ্রামের বাড়িতে নেয়া হবে মরদেহ। সেখানেই তার দাফন করা হবে।
প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্ট অ্যালায়েন্স অব বাংলাদেশের ফেসবুক পেজে এক পোস্টে ‘ক্যাম্পাসে সন্ত্রাসী হামলায়’ পারভেজ হত্যার ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তারের দাবি জানানো হয়েছে। এ ছাড়া শনিবার রাত ১০টা ০৫ মিনিটে ফেসবুকে আরেকটি পোস্ট করা হয়। তাতে বলা হয়েছে, পারভেজ হত্যার ঘটনায় প্রত্যক্ষদর্শী ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি, বিবিএ এবং এলএলবি’র তিন শিক্ষার্থীর জড়িত থাকার বিষয়ে জানিয়েছেন। ক্যাম্পাসের সামনে বসার জায়গা নিয়ে বহিরাগত সন্ত্রাসী দিয়ে হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে।