Image description

ঢাকায় পরাজয়ের পাঁচ দশকের বেশি সময় পরে ইতিহাস যেন আবার কড়া নাড়ছে—এবার বেলুচিস্তানে। সম্প্রতি ইসলামাবাদে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আসিম মুনির বালুচ বিদ্রোহী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোর প্রতি কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। জাতীয় ঐক্য ও দ্বিজাতিতত্ত্বের কথা তুলে ধরে বিভাজনমূলক বক্তব্য দিয়েছেন তিনি। পাকিস্তান সেনাপ্রধানের বক্তব্যে যেমন আদর্শিক দিক আছে, তেমনি আছে ইতিহাসের অশনিসংকেত।

এই পরিস্থিতির সঙ্গে ১৯৭১ সালের পরিস্থিতির তুলনা করছেন অনেকে। জেনারেল ইয়াহিয়া খান তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগণের দাবিকে ‘বহিঃশক্তির প্ররোচনায় পরিচালিত বিদ্রোহ’ বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই অস্বীকার থেকেই জন্ম নিয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশ।

আসিম মুনিরের বক্তব্যের সুর ও ভাষার অনেকাংশেই যেন সেই পুরোনো গল্পের পুনরাবৃত্তি। কৃত্রিম একতা বজায় রাখার একগুঁয়েমি, ভিন্নমত দমন ও সামরিক শক্তির হুমকি—সবই যেন ইয়াহিয়া খানের প্রতিধ্বনি।

দ্বিজাতিতত্ত্বের আদর্শ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে প্রবাসী পাকিস্তানিদের আহ্বান জানিয়ে আসিম মুনির বলেন, ‘আপনাদের সন্তানদের পাকিস্তানের গল্প শোনাতে হবে, যেন তারা এটি ভুলে না যায়।’

পরিচয়ের রাজনীতি ও ইতিহাস পুনর্লিখনের এই বক্তব্য ভাইরাল হয়ে গেছে, তাতে দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রাসঙ্গিকতা ও বিপদ নিয়ে নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে।

দ্বিজাতিতত্ত্ব ছিল ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির আদর্শিক ভিত্তি। ব্রিটিশ ভারতে মুসলিম ও হিন্দুরা দুটি ভিন্ন জাতি এবং তাদের একসঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সম্ভব নয়—এই ছিল সেই আদর্শের মূলকথা।

পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেছিলেন, হিন্দু ও মুসলিমরা ভিন্ন দর্শন, রীতি ও আইন অনুসরণ করে। ফলে তাদের মধ্যে জাতীয় ঐক্য অসম্ভব। অন্যদিকে, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বহুত্ববাদের ভিত্তিতে নিজের পরিচয় গড়েছে ভারত।

এই ভাষণে বেলুচিস্তানের অস্থিরতা নিয়েও বক্তব্য দেন জেনারেল আসিম মুনির। পাকিস্তানের বৃহত্তম এই প্রদেশ এখন সবচেয়ে বেশি অস্থির। সম্প্রতি এই অঞ্চলে বিদ্রোহী তৎপরতা বেড়েছে।

এমন এক সময়ে সম্প্রতি প্রবাসী পাকিস্তানিদের এক সম্মেলনে তিনি বললেন, ‘আমরা খুব শিগগির এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে ভেঙে চুরমার করে দেব। আপনাদের কি মনে হয়, মাত্র ১৫০০ সন্ত্রাসী বেলুচিস্তান ছিনিয়ে নিতে পারবে? এমনকি দশ প্রজন্মের সন্ত্রাসীরা মিলেও বেলুচিস্তান বা পাকিস্তানের কিছু করতে পারবে না।’

 

পাকিস্তানের সেনাপ্রধানের কঠোর এই বার্তা এমন এক সময়ে এল, যার কয়েক সপ্তাহ আগেই বিদ্রোহী গোষ্ঠী বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি (বিএলএ) জাফর এক্সপ্রেস ট্রেন জিম্মি করে। ওই ঘটনায় ৬৪ জন নিহত হয়, যার মধ্যে আছে ৩৩ জন হামলাকারীর সবাই।

দীর্ঘদিন ধরে বিদ্রোহে জর্জরিত বেলুচিস্তান। কারণ, বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ থাকার পরও অঞ্চলটি অর্থনৈতিকভাবে বঞ্চিত ও রাজনৈতিকভাবে প্রান্তিক। বালুচ অধিকারকর্মীরা বহু বছর ধরে মানবাধিকার লঙ্ঘন, গুম ও সেনাবাহিনীর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের অভিযোগ করে আসছেন। তবে ইসলামাবাদ বরাবরই তা অস্বীকার করেছে।

অর্থবহ সংলাপের অভাব ও কেবল সামরিক সমাধানের ওপর নির্ভরতা এই অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদকে আরও গভীর করেছে। এই পরিস্থিতির সঙ্গে ১৯৭১ সালের পূর্ব পাকিস্তানের সংকটের মিল দেখা যাচ্ছে।

বেলুচিস্তান নিয়ে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান যে ভাষায় জাতীয় ঐক্যের প্রসঙ্গ তুলেছেন এবং যেভাবে বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রবণতার বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, তা আমাদের দৃষ্টিকে ইতিহাসের দিকে নজর দিতে বাধ্য করছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খানও ঠিক একইভাবে পূর্ব পাকিস্তানের আন্দোলনকে অস্বীকার করেছিলেন।

জাতীয় ঐক্যের ডাক তখনো ছিল, সঙ্গে বহিঃশক্তির হস্তক্ষেপের অভিযোগ ও ন্যায্য দাবিতে আন্দোলনকারীদের সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে দমনের চেষ্টা ছিল তীব্র। কিন্তু ইতিহাস দেখিয়েছে, ন্যায্য দাবিকে অস্বীকার ও দমন এবং সেনাশক্তির ওপর নির্ভরতা কেবলই ভাঙন ডেকে আনে।

আজ বেলুচিস্তান যেন বঞ্চনা, গুম ও অবরুদ্ধ প্রজন্মের সেই পুরোনো গল্পই বলছে। সামরিক বার্তাগুলোও ঠিক একই রকম আছে—অস্বীকার, হুমকি আর মিথ্যা স্থিতিশীলতার মুখোশ।

ইতিহাস আবার দরজায় কড়া নেড়ে শুধায়, ১৯৭১ থেকে পাকিস্তান কি কিছুই শেখেনি? নাকি আবার আরেক বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে চলেছে। শুধু কি ইউনিফর্ম বদলেছে, কিন্তু চিত্রনাট্য রয়ে গেছে আগের মতোই?

 

লেখক: সহকারী বার্তা সম্পাদক, আজকের পত্রিকা