
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক গোয়েন্দা প্রধান ব্রিগেডিয়ার (অব:) রোকন উদ্দিন বলেছেন বান্দরবান সীমান্তের অভ্যন্তরে আরাকান আর্মির উপস্থিতির বিষয়টিকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখা ভুল হবে। নয়া দিগন্তেÍর সাথে আলাপকালে তিনি এ মন্তব্য করেন।
রোকন উদ্দিন বলেন, সম্প্রতি বান্দরবানে অনুষ্ঠিত ওয়াটার ফেস্টিভ্যাল বা জলকেলি উৎসব, যা চট্টগ্রাম হিলট্র্যাক্টস (পার্বত্য চট্টগ্রাম) এলাকার বিভিন্ন উপজাতী গোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী ও আনন্দঘন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হিসেবে পরিচিত, এবার তা এক নতুন ও উদ্বেগজনক মাত্রা ধারণ করেছে। কারণ, গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, এ অনুষ্ঠানে মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সদস্যদের উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে। এ উৎসবকে ব্যবহার করে তারা বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর সাথে সাংস্কৃতিক ও আদর্শিক সম্পর্ক ঘনীভূত করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, বিশেষভাবে উদ্বেগজনক হলো, এ আয়োজনে স্থানীয় উপজাতীয় নেতাদের সরাসরি সহযোগিতা। স্থানীয় নেতারা এ উৎসবে অংশগ্রহণকারী মিয়ানমার প্রবাসী ব্যক্তিদের আবাসন, যাতায়াত ও অন্যান্য সুবিধা দিয়েছেন। কিছু অংশগ্রহণকারী সাদা পোশাকে আরাকান আর্মির সদস্য বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। উৎসবে রাখাইন জাতিগত পতাকা, আরাকান প্রতিরোধমূলক গান এবং প্রতীকী ভাষা ও ইঙ্গিত ব্যবহার করা হয়েছে, যা এ আয়োজনকে শুধু সাংস্কৃতিক বিনিময় নয়, বরং একটি সফট ইনফিলট্রেশন বা নরম অনুপ্রবেশের কৌশল হিসেবেও চিহ্নিত করে।
সাবেক সেনা গোয়েন্দা প্রধান বলেন, এ ঘটনাটি আরাকান আর্মির একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার সূচনা চিহ্ন হতে পারে যেখানে তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে আদর্শিক প্রভাব বিস্তার ও স্থানীয় সমর্থন গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীগুলোর সাথে মিয়ানমারের রাখাইন ও চীন রাজ্যের নৃতাত্ত্বিক, ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক মিল থাকায় এ অঞ্চল ক্রস-বর্ডার প্রভাবের জন্য অত্যন্ত ঝুঁঁকিপূর্ণ। আরাকান আর্মি, যারা সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমার জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে সাফল্য অর্জন করেছে, এখন তাদের জাতিগত সংগঠনের মডেল পার্বত্য চট্টগ্রামেও ছড়িয়ে দিতে চায়, যা স্থানীয় অনুপ্রেরণাহীন জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারাকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারে। তিনি বলেন, এ ঘটনাটি বিচ্ছিন্ন কোনো সংস্কৃতিক আয়োজন হিসেবে দেখা ভুল হবে। এর পেছনে গভীর ভূরাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে, যেখানে বাইরের কোনো রাষ্ট্র বা অ-রাষ্ট্রীয় শক্তি এ ধরনের সংহতিকে গোপনে উস্কে দিচ্ছে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে কৌশলগত চাপ সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে। যদি এ ‘সফট অনুপ্রবেশ’ অব্যাহত থাকে, তাহলে এটি ভবিষ্যতে সক্রিয় নিয়োগ, সশস্ত্র প্রশিক্ষণ এবং চরমপন্থী সংগঠনের সাথে সংযোগ গড়ার দিকে গড়াতে পারে।
এ ঘটনায় আরাকান আর্মির সম্ভাব্য অংশগ্রহণ আমাদের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর জন্য তাৎক্ষণিক পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা সামনে নিয়ে এসেছে। সীমান্ত অঞ্চলে মানব গোয়েন্দা (ঐটগওঘঞ) বিস্তার, সঙ্কেত গোয়েন্দা (ঝওএওঘঞ) তৎপরতা বৃদ্ধি এবং স্থানীয় কমিউনিটি পর্যায়ে সচেতনতা ও তথ্য সংগ্রহ জোরদার করতে হবে। পাশাপাশি, মনস্তাত্ত্বিক অপারেশন (চংুঙঢ়ং) চালিয়ে যেকোনো ‘সশস্ত্র সংগ্রামকে মহিমান্বিত করার প্রচারণা’ প্রতিরোধ করতে হবে।
একইসাথে, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর একটি কৌশলগত শক্তি হিসেবে ব্যবহার যোগ্যতার দিক বিবেচনায় আনা যেতে পারে। যারা আরাকান আর্মি এবং মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর উভয়ের দ্বারা নিপীড়িত তাদের মধ্য থেকে নির্বাচিত তরুণদের প্রশিক্ষণ ও সংগঠিত করে আত্মনিয়ন্ত্রণের আন্দোলনে প্রস্তুত করা বাংলাদেশকে সীমান্ত রাজনীতিতে ভারসাম্য রক্ষায় সহায়তা করতে পারে।
ওয়াটার ফেস্টিভ্যাল আপাত দৃষ্টিতে একটি নিরীহ সাংস্কৃতিক আয়োজন মনে হলেও এর অন্তর্নিহিত রাজনৈতিক বার্তা, বিদেশি সংযোগ এবং স্থানীয় সহযোগিতা এটিকে একটি হাইব্রিড নিরাপত্তা হুমকিতে রূপান্তরিত করেছে। এটি বাংলাদেশের সীমান্ত নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের জন্য এক সতর্ক সঙ্কেত, যা অবিলম্বে মাল্টি-ডোমেইন নিরাপত্তা কৌশল গ্রহণের দাবি রাখে।