Image description

ভেজাল জ্বালানি তেলে সয়লাব সারা দেশ। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে নীরব ভূমিকা পালন করে চলেছে বিপিসি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়। প্রতিরোধে নেই তাদের কার্যকর পদক্ষেপ। ফলে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন ভোক্তারা।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভেজাল তেলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন গাড়ির মালিকরা। এতে হাজার হাজার গাড়ি নষ্ট হচ্ছে। শুধু তাই নয়, গাড়িতে ভেজাল তেল ব্যবহারের কারণে দূষিত হচ্ছে পরিবেশও। এ বিষয়ে জরুরিভিত্তিতে সরকারের পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।

জ্বালানি বিভাগের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, দেশের পেট্রোল পাম্পগুলোতে ভেজাল তেল বিক্রির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এসব পাম্প থেকে তেলও কম দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। মাঝেমধ্যে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হলেও নিয়মিত তদারক করা হয় না। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) যে নজরদারি করার কথা, বাস্তবে তারা তা করে না। এতে গ্রাহকরা নিয়মিত প্রতারিত হচ্ছেন।

 

এদিকে বিপিসির টেকনিক্যাল কমিটির প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, আমেরিকার অথেনটিক্স কোম্পানি কর্তৃক প্রস্তাবিত ফুয়েল মার্কিং প্রোগ্রাম ভোক্তাপর্যায়ে জ্বালানি তেলে ভেজাল প্রতিরোধে কার্যকর পদ্ধতি। গত বছরের ১০ সেপ্টেম্বর কমিটি এ প্রতিবেদন জমা দিলেও তিন মাস পর বিপিসির চেয়ারম্যান অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠান ২৪ ডিসেম্বর। এরপর তিন মাসেরও বেশি সময় পার হলেও অজ্ঞাত কারণে ওই ফাইল পড়ে আছে।

 

সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, বিপিসি ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের একটি বিশেষ গ্রুপ তাদের অবৈধ উপার্জন বন্ধ হয়ে যাবে; এ আশঙ্কায় এ ফাইল অনুমোদনে বাধা সৃষ্টি করছে। এ ছাড়া জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব খালিদ আহমেদ একজন পুরোদস্তুর ফ্যাসিবাদের দোসর, তিনি দীর্ঘদিন থেকে বিপিসি এবং জ্বালানি মন্ত্রণালয়েই নিজের পদায়ন নিশ্চিত করে রেখেছেন। যুগ্ম সচিব হাফিজুর রহমানসহ প্রায় সবাই বিগত সরকরের সুবিধাভোগী এবং এই মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারণী জায়গায় বসে আছেন। তাদের কলকাঠিতেই ফাইলটি অনুমোদনে বাধার সৃষ্টি করছেন।

 

জ্বালানি তেলে ভেজাল প্রতিরোধে কার্যকর পদ্ধতিটি অনুমোদনের বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব খালিদ আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, প্রস্তাবটি পাওয়া গেছে। তবে বিপিসি এ বিষয়ে আগ্রহী নয়। বিপিসি আলাদাভাবে অটোমেশন করার চেষ্টা করছে।

 

কেরানীগঞ্জ মডেল টাউনের বাসিন্দা বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা মাহবুবুল আলম একটি রিকন্ডিশন টয়োটা কার কিনেছিলেন। কয়েক মাস ভালোভাবে চালাতে পারলেও হঠাৎ তার গাড়িতে সমস্যা দেখা দেয়। স্টার্ট না নেওয়া, গাড়ির ইঞ্জিনে বিকট শব্দ হওয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন সমস্যা ক্রমেই বাড়তে থাকে।

 

ধোলাইখালের একটি গ্যারেজে নেওয়ার পর মাহবুবুল জানতে পারেন, ভেজাল জ্বালানি তেল ব্যবহারের কারণে গাড়ির ইঞ্জিন বিকল হয়ে পড়ছে। এ অবস্থায় গাড়ির বাকি তেল ফেলে দেওয়ার পাশাপাশি ফিল্টার বদলে ফেলেন তিনি। এভাবে মাস দুয়েক চলার পর গাড়িটি ফের অচল হয়ে যায়।

 

ধোলাইখাল এলাকার বেশ কয়েকটি গাড়ির গ্যারেজ ঘুরে দেখা গেছে, সেখানে বিভিন্ন মডেলের গাড়ি মেরামত করছেন মেকানিকরা। তারা জানান, বেশিরভাগ গাড়িতেই ইঞ্জিনের সমস্যা দেখা দিয়েছে। আর এক্ষেত্রেও বেশিরভাগ ইঞ্জিনের সমস্যার প্রধান কারণ ভেজাল ও ময়লাযুক্ত তেল ব্যবহার।

 

বাজারে ভেজাল জ্বালানি তেলের বিপণন ঠেকাতে প্রায়ই মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে অভিযান চালানো হয়। প্রতি মাসেই দেশের বিভিন্ন স্থানে কোনো না কোনো পেট্রোল পাম্পকে এজন্য জরিমানাও করা হচ্ছে। যদিও পেট্রোল পাম্প মালিকদের দাবি, এখানে পাম্পগুলোর কোনো হাত নেই। পাম্পে ভেজাল মেশানোর বা খোলাবাজার থেকে তেল কেনার সুযোগ নেই।

ধোলাইখালের একটি গ্যারেজের মেকানিক আলম মিয়া জানান, জাপান থেকে আনা টয়োটার রিকন্ডিশন গাড়িগুলোর একেকটি ইঞ্জিন সাধারণত পাঁচ লাখ কিলোমিটার পর্যন্ত চলার কথা। কিন্তু বাংলাদেশে আনার পর এর অনেকগুলোই আড়াই থেকে তিন লাখ কিলোমিটারের মধ্যে নষ্ট হয়ে যায়। এভাবে মাইলেজ কমে যাওয়া ও তাতে তারতম্য দেখা দেওয়ার বড় একটি কারণ হলো ভেজাল তেলের ব্যবহার।

 

অভিযোগ আছে, ডিপো থেকে জ্বালানি তেল পাম্পে নেওয়ার সময় মাঝপথে সবচেয়ে বেশি ভেজাল মেশানো হয়। আবার বেসরকারি পরিশোধনাগারে কনডেনসেট নিয়ে যাওয়ার পর সেখানেও ভেজাল মেশানোর অভিযোগ রয়েছে। নির্ভরযোগ্য একটি সূত্রের দাবি, জ্বালানি তেলে ভেজাল মেশানো এককভাবে কোনো পক্ষের জন্য সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে বড় একটি সিন্ডিকেট রয়েছে।

 

বর্তমানে ডিজেল বিক্রি হচ্ছে লিটারপ্রতি ১০৫ টাকা এবং কেরোসিন ১০৫ টাকায়। এ ছাড়া প্রতি লিটার পেট্রোল ১২২ এবং অকটেন ১২৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সে অনুযায়ী প্রতি ১০ লিটার জ্বালানি তেলের মধ্যে এক লিটার কনডেনসেট মেশানো গেলে লিটারে জ্বালানি তেলে অন্তত ১০ টাকা বাড়তি মুনাফার সুযোগ রয়েছে পেট্রোল পাম্প ও খোলাবাজারের বিক্রেতাদের।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজারে ভেজাল জ্বালানি তেলের বিক্রি বন্ধে নজরদারি বাড়িয়ে খাদ্যের মতো গুরুত্ব দিয়ে জ্বালানি তেলের মানও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

 

প্রকৌশলী অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন বলেন, দেশের বাইরে ৯৯ মানের অকটেনও পাওয়া যায়। অকটেনের মান ৯৫ থাকলেই তা গাড়ির ইঞ্জিনের জন্য নিরাপদ। আমি যতদূর জানি, আমাদের দেশে এ মানের অকটেন ব্যবহার করার কথা থাকলেও তা হয় না। জ্বালানি তেলে একটির মধ্যে আরেকটি ভেজাল দিয়ে অনেক আগে থেকে বিক্রি করা হচ্ছে। এটি বন্ধে কঠোর পর্যবেক্ষণ থাকা জরুরি।

 

পেট্রোল পাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নাজমুল হক দেশের পেট্রোল পাম্পগুলোতে ভেজাল এবং পরিমাপে কম দেওয়ার অভিযোগটি সরাসরি অস্বীকার না করে কৌশলে বলেন, ঢাকা শহরে এ ধরনের ঘটনা নেই। তবে ঢাকা সিটির বাইরের কিছু পাম্পের মান নিয়ে কিছু প্রশ্ন উঠেছে। নিয়মিত তদারক করলে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব।

 

বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) পরিচালক (মান) সাইদুল ইসলাম আমার দেশকে বলেন, জ্বালানি ভেজালমুক্ত করার দায়িত্ব বিপিসির। কারণ তাদের ডিলার হচ্ছে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা কোম্পানি। বিএসটিআই মাঝেমধ্যে পেট্রোল পাম্পে অভিযান চালিয়ে ভেজাল ও পরিমাপে কম দেওয়ার প্রমাণ পেলে পাম্প সিলগালা ও জরিমানা করতে পারে। ভেজালমুক্ত করতে হলে মন্ত্রণালয় ও বিপিসিকে উদ্যোগ নিতে হবে।

 

সার্বিক বিষয়ে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ সাইফুল ইসলামের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি।

 

বিপিসির চেয়ারম্যান আমিনুল আহসানের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এমনকি হোয়াটসআপে মেসেজ দিয়েও তার কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।

 

পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক নাগরিক সংগঠন ধরার সদস্য সচিব শরীফ জামিল বলেন, সম্প্রতি ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে বায়ুদূষণের মাত্রা বেড়েই চলেছে। ভেজাল জ্বালানি তেল ব্যবহার এর অন্যতম কারণ। এ বিষয়ে জরুরিভিত্তিতে সরকারের পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।