Image description

আত্মপ্রকাশের মাত্র দুই মাস। এর মধ্যেই খাদের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে হারিয়েছে সাধারণ মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন, গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে দেশের অন্যসব রাজনৈতিক দলের কাছেও। অন্যদিকে দলটির একাধিক নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এবং দলীয় কোন্দলে দলটি ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে। 

এর কারণ হিসেবে দলটির নেতৃত্বের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা এবং দূরদর্শিতার অভাবকেই দায়ী করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছে, এনসিপি যে বিকল্প শক্তি হয়ে উঠতে পারত, তা তারা নিজেদের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার কারণে হারিয়েছে। যদিও এখনো সময় আছে, নেতৃত্ব বদল এবং স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনলে হয়তো পরিস্থিতি কিছুটা সামাল দেওয়া যাবে। না হলে এই দল হারিয়ে যাবে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, যদি এনসিপি দ্রুত দলীয় সংস্কার, আর্থিক স্বচ্ছতা ও ভালো নেতৃত্ব নিশ্চিত না করে, তবে দলটি কার্যত অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। এ সংকট কাটাতে না পারলে এনসিপি রাজনৈতিক ইতিহাসে আরেকটি ‘হতাশাজনক বিকল্প শক্তির’ উদাহরণ হতে হবে।

দলটির আত্মপ্রকাশের পর থেকে এ পর্যন্ত পর্যালোচনা করে দেখে গেছে, দিন যতই যাচ্ছে দলটির জনসমর্থন অবনতি হচ্ছে। বিশেষ করে দলটির রাজনৈতিক সভা সমাবেশের উপস্থিতি একেবারেই হতাশাজনক। 

তথ্য বলছে, এর পেছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে বৈষম্যবিরোধীদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এ দুটি সংগঠনের মধ্যে বিভাজন। ফলে এনসিপি সভা-সমাবেশ কিংবা তাদের রাজনৈতিক কোনো কর্মকাণ্ডে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীদের সমর্থন মিলছে না। এর মধ্যে আবার নানা ইস্যুতে এ দুই সংগঠনের নেতাকর্মী একে অপরের ওপর দোষ চাপানো ও মারামারি ঘটনা ঘটছে। যা দলটির রাজনৈতিক কাজকে এগিয়ে যেতে আরেক বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া সম্প্রতি দলটি একাধিক নেতার বিরুদ্ধে ওঠা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ সাধারণ মানুষের মনে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। পাশাপাশি সংগঠনের কর্মকাণ্ডে অসন্তোষ জানিয়ে একাধিক নেতাকর্মীর পদত্যাগের বিষয়টি ব্যাপক সমালোচনা ও প্রশ্ন তুলেছে দলটির কার্যক্রম নিয়ে।  এরই মধ্যে আলেম সমাজের প্রত্যাশা ও ধর্মীয় মূল্যবোধকে অগ্রাধিকার না দেওয়ায় জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) থেকে পদত্যাগ করেছেন দলটির কেন্দ্রীয় সদস্য ও সাধারণ আলেম সমাজের আহ্বায়ক মুহাম্মদ রিদওয়ান হাসান। গত মঙ্গলবার রাত পৌনে ১০টায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক বার্তায় তিনি এ পদত্যাগের ঘোষণা দেন।

পদত্যাগপত্রে তিনি উল্লেখ করেন, চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে শহিদ আলেম-ওলামা ও মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটানো ছিল আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। কিন্তু এনসিপি সময়ের সঙ্গে সেই লক্ষ্য থেকে সরে এসেছে। তিনি আরো বলেন, আমি দেশের ইসলামপ্রিয় জনগণের আকাক্সক্ষাকে আরো নিবিড়ভাবে প্রতিনিধিত্ব করার সংকল্প নিয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির কেন্দ্রীয় সদস্যপদ থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করছি।

এর আগে টাকার বিনিময়ে আওয়ামী লীগের নেতাদের পুনর্বাসন করছে এমন অভিযোগ আনেন দলটি আরেক নেতা এম রাফিদ ভূইয়া। এর একদিন পরই তিনি গদত্যাগ করেন। যদিও পদত্যাগপত্রে ব্যক্তিগত কারণে পদত্যাগ করেছেন বলে উল্লেখ করেন।

এদিকে বুধবার বগুড়ায় আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আয়োজিত সমাবেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুপক্ষের নেতাকর্মীদের মধ্যে দফায় দফায় মারামারির ঘটনা ঘটেছে। গতকাল বিকাল সোয়া পাঁচটার দিকে শহিদ টিটু মিলনায়তন চত্বরে (পৌর পার্ক) এনসিপির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলমের উপস্থিতিতে এ ঘটনা ঘটে। 

প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, বিকেল সাড়ে চারটার দিকে সমাবেশস্থলে পৌঁছান সারজিস আলমসহ এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতারা। এরপর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি পক্ষ মিছিল নিয়ে পৌর পার্ক চত্বরে প্রবেশ করেন। সমাবেশের প্রধান অতিথি সারজিস আলম মঞ্চে বসে ছিলেন এবং এনসিপির কেন্দ্রীয় অন্য নেতারা বক্তব্য দিচ্ছিলেন। এ সময় বৈষম্যবিরোধীদের একটি পক্ষ সারজিস আলমের বিরুদ্ধে স্লোগান দেন। তখন সারজিসের পক্ষ নিয়ে অন্যরা তাদের সঙ্গে হাতাহাতিতে জড়ান। একপর্যায়ে দুপক্ষের মধ্যে তুমুল মারামারি বেধে যায়প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন জানান, বৈষম্যবিরোধীদের দুপক্ষের মধ্যে মারামারির সময় সমাবেশের মঞ্চে বক্তব্য দিচ্ছিলেন এনসিপির নেতারা। কেন্দ্রীয় যুগ্ম সদস্য সচিব তাহসিন রিয়াজ, যুগ্ম মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সাকিব মাহদী, কেন্দ্রীয় নেতা নাজমুল ইসলাম, সাদিয়া ফারজানাসহ অন্যরা এক মিনিটের মতো করে বক্তব্য দেন। আর প্রধান অতিথি সারজিস আলম চার মিনিটের মতো বক্তব্য দিয়ে দ্রুত মঞ্চ থেকে নেমে যান। পরে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে শহরের সাতমাথা প্রদক্ষিণ করা হয়। মিছিলের সামনে-পেছনে প্রচুর পুলিশ ছিল।

ঘটনাস্থলে থাকা বগুড়া সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এস এম মঈনুদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেন, সারজিস আলম মঞ্চে ওঠার পর এনসিপির সমর্থকদের একটি অংশ তার বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে থাকেন। এ সময় অপর একটি অংশ বাধা দিতে গেলে দুপক্ষের মধ্যে হাতাহাতি হয়। পরে সারজিসের পক্ষের লোকজন অন্য পক্ষকে ধাওয়া দিয়ে সমাবেশস্থল থেকে তাড়িয়ে দেন।

জানতে চাইলে এনসিপির বগুড়া জেলার অন্যতম সংগঠক আহমেদ সাব্বির গণমাধ্যমকে বলেন, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে বগুড়ায় এনসিপির বিক্ষোভ সমাবেশ কর্মসূচি ছিল। এনসিপি থেকে সাময়িক বহিষ্কৃত কেন্দ্রীয় এক নেতার কিছু উচ্ছৃঙ্খল সমর্থক ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি অংশের কিছু নেতাকর্মী সমাবেশস্থলে এসে সারজিস আলমের বিরুদ্ধে স্লোগান দেওয়াসহ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করেন। এ সময় হাতাহাতি হয়েছে। পরে তাদের প্রতিহত করে সমাবেশস্থল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে কথা হলে বিপ্লবী ওয়ার্কাস পার্টি সাধারণ সম্পাদক ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ সাইফুল হক খোলা কাগজকে বলেন, তাদের এ যাত্রাটাকে আমি খুব নিবিষ্ট রাজনীতির জায়গা থেকে দেখে আসছিলাম। আমি ভেবেছিলাম নানা কথা থাকলেও, তরুণ এই দলটা মানুষের যে আশা আকাক্সক্ষা তা খানিকটা হলেও পূরণ করবে। আমি ব্যক্তিগতভাবেও তাদের এ যাত্রাটাতে স্বাগত জানিয়েছিলাম। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে আমি নিজে আশাহত হচ্ছি, হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। কারণ তাদের মধ্যে যে দুর্নীতি-অনিয়ম, বিভক্তি ও অবিশ্বাস-সন্দেহ বাড়ছে এবং গণমাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে; ফলে সম্ভাবনার অনেকখানি ফিকে হয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া গণমাধ্যমে যা প্রকাশ পাচ্ছে এটাও হয়তো সামান্য, আমার ধারণা বড় অংশটা এখনো হয়তো প্রকাশই হয়নি। তাই বলা যায় একটা তরতাজা সবুজ রং; মাত্র অল্প সময়ের মধ্যে অনেকখানি ধুসর হয়ে যাচ্ছে। মানুষের আস্থা-ভালোবাসার পরিবর্তে তৈরি হয়েছে নানা প্রশ্ন, সন্দেহ ও সমালোচনা।
  
তবে এনসিপির সব সম্ভাবনা এখনি একেবারে শেষ হয়ে গেছে এমনটা নয় জানিয়ে তিনি বলেন, তারা এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারে, যদি তারা একটি আদর্শিক রাজনৈতিকভাবে ভাবনাচিন্তা করে। এ সময় তিনি বলেন, আমি এ তরুণদের সাফল্য চাই, কারণ তারা পুরোপুরি ব্যর্থ হলে তরুণদের রাজনীতির প্রতি যে রাজনৈতিক মনোষ্কতা এটাও কিন্তু নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।
 
এসব বিষয়ে জানতে এনসিপি মুখ্য সমন্বয়ক নাসিরুদ্দীন পাটোয়ারীর সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘এসব বিষয়ে আখতার হোসেন ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলুন। তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়ছে, তিনি কথা বলবেন। পরে দলটির সদস্য সচিব আখতার হোসেনকে কল দিরে রিসিভ না করায় কথা বলা সম্ভব হয়নি।