Image description

আলফাজ আনাম

বহু নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ সতর্ক করেছেন যে পানি নিয়ে আগামীতে বড় ধরনের যুদ্ধ হতে পারে। এমনকি তা পারমাণবিক যুদ্ধে রূপ নিতে পারে। এর মধ্যে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান ও পোপ ফ্রান্সিস এমন আশঙ্কার কথা জানিয়েছিলেন। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সাম্প্রতিক সামরিক উত্তেজনার মধ্যে পানিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের ঘোষণা দিয়েছে ভারত। সিন্ধু নদের পানিবণ্টন চুক্তি স্থগিত ঘোষণা করার পর পাকিস্তানের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সিন্ধুর পানি বাধাগ্রস্ত করার যেকোনো উদ্যোগকে যুদ্ধ হিসেবে দেখা হবে। আইয়ুব খান যখন পাকিস্তানের ক্ষমতা গ্রহণ করেন, তখন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পানিবণ্টন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। আইয়ুব খান সে সময় বলেছিলেন, পানি না পেলে যুদ্ধ অনিবার্য। (If there is no water there will be war)

দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় ১৯৬০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সিন্ধু নদীর পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিটির মাধ্যমে সিন্ধু ও এর উপ-নদীগুলোর পানিকে দুদেশের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া হয় এবং পানিবণ্টনের নিয়ম নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। সিন্ধু অববাহিকার পূর্বাঞ্চলীয় তিনটি নদী ইরাবতী, বিপাশা ও শতদ্রুর পানি ব্যবহার করার অনুমতি দেওয়া হয় ভারতকে। আর পাকিস্তানকে পশ্চিমাঞ্চলের তিনটি নদ-নদী সিন্ধু, ঝিলাম ও চেনাবের অধিকাংশ পানি ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়। চুক্তিটি কোনো দেশ একতরফাভাবে স্থগিত বা বাতিল করার বিধান নেই। এই চুক্তির মাধ্যমে ভাটির দেশ হিসেবে সিন্ধু ও তার উপ-নদীগুলোর পানির প্রায় ৮০ শতাংশের ওপর পাকিস্তানের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।

চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, ভারত বা পাকিস্তান নিজেদের প্রয়োজনে নদীগুলোর পানি ব্যবহার করলেও কোনো অবস্থাতেই পানির প্রবাহ আটকে রাখতে পারবে না। যেহেতু বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, ভারত তা স্থগিত করলে আন্তর্জাতিক সাহায্য চাইতে পারে পাকিস্তান। এই চুক্তিতে বিশ্বব্যাংক এক ধরনের গ্যারান্টারের ভূমিকা পালন করেছিল। এই চুক্তি হওয়ার পর ১৯৬২ সালে ও ১৯৭১ সালে দুবার বড় আকারে যুদ্ধে জড়িয়েছে কিন্তু চুক্তি বাতিল বা স্থগিত করা হয়নি। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, সিন্ধুর পানি আটকে দেওয়া বা ভিন্নদিকে প্রবাহিত করার মতো অবস্থা ভারতের নেই। এতে যে বিপুল অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে, তা এখনই করা সম্ভব নয়। ফলে ভারত চুক্তি স্থগিতের ঘোষণা দিলেও তা খুব বেশি কার্যকর করা সম্ভব হবে না।

সিন্ধু পানি চুক্তি বাতিল বা স্থগিত করা হোক বা না হোক, ভারতের উগ্রপন্থি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পানিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের ঘোষণা অত্যন্ত বিপজ্জনক। পাকিস্তানের সামরিক সক্ষমতা ও পারমাণবিক শক্তির কারণে ভারত হয়তো আগে কখনো এই অস্ত্র ব্যবহারের কথা বলেনি, কিন্তু এই অস্ত্র ভারত ব্যবহার করছে অনেক আগে থেকেই। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তা করা হচ্ছে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে।

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৫৪টি আন্তঃসীমান্ত নদী রয়েছে এবং এই নদীর অনেকগুলোর উজানে ভারতীয় অংশে ড্যাম ও ব্যারাজ নির্মাণ করা হয়েছে। নদীর উজানে বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করায় বাংলাদেশের ভাটি অংশে যেমন প্রয়োজনের সময় বিশেষ করে শুকনো মৌসুমে পর্যাপ্ত পানি প্রবাহিত না হওয়ায় কৃষিসহ নানা কর্মকাণ্ড ব্যাহত হয়, তেমনি অতিরিক্ত পানি সামলানোর নামে বর্ষা মৌসুমে বাঁধগুলোর গেট খুলে দেওয়ায় ভাটি এলাকা বন্যাকবলিত হয় এবং ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। বাংলাদেশে ২৩০টিরও বেশি নদী রয়েছে। গত ৫৭ বছরে বাংলাদেশের ১৫৮টি নদী শুকিয়ে গেছে। অভিন্ন নদীর উজানে বাঁধ দিয়ে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত না করলে নদীগুলো শুকিয়ে যেত না। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতের পানি অস্ত্র ব্যবহারে ভয়াবহ বিপর্যয় দেখা দিয়েছে।

বাংলাদেশ কীভাবে ভারতের পানি আগ্রাসনের শিকার, তার বড় উদাহরণ হলো ফারাক্কা বাঁধ। পঞ্চাশের দশকের শুরুর দিকে ভারত ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ শুরু করে। পাকিস্তান আমলে এ নিয়ে আলোচনা হলেও এই বাঁধ চালু করার সাহস করেনি। স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবের শাসনামলে পরীক্ষামূলকভাবে ১০ দিনের জন্য ফারাক্কা বাঁধ চালু করে, যা আজও বন্ধ হয়নি। ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে ভারত শুধু একতরফা পানি প্রত্যাহার করেনি, চুক্তির নামে প্রতারণা করেছে। তা করেছে দিল্লির অনুগত হাসিনা সরকারের আমলে। ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর নতুন দিল্লিতে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রী দেব গৌড়া এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ায় পর ঢাকঢোল পিটিয়ে নানা আশার কথা শোনানো হয়। কিন্তু অল্পদিনেই সেই আশা ভেঙে যায়। ৩০ বছর বা ৩৬০ মাসের জন্য চুক্তি মাত্র তিন মাসেই অচল হয়ে পড়ে। বছরের সবচেয়ে শুকনো মৌসুম শুরুর এক মাস আগেই বাংলাদেশ সবচেয়ে কম পানি পেয়েছে। মার্চ মাসের ২৭ তারিখে (৯৭) বাংলাদেশ পানি পায় ৬ হাজার ৪৫৭ কিউসেক। এটা ফারাক্কা বাঁধ চালুর পর সর্বনিম্ন প্রবাহ। আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রাজ্জাক ব্যাখ্যা দেন, হিমালয়ে বরফ কম গলার কারণে নাকি পানি কম পাওয়া গেছে।

৯৬ সালের চুক্তি অনুসারে ৭০ হাজার কিউসেক থেকে ৫০ হাজার কিউসেক পর্যন্ত পানি বাংলাদেশ-ভারত সমান সমান অংশ পাবে। এটাই প্রকৃতপক্ষে চুক্তির আসল অংশ। কিন্তু ফারাক্কা পয়েন্টে পানির পরিমাণ ৫০ হাজার কিউসেকের নিচে নেমে গেলেই চুক্তির পানি বণ্টন ফর্মুলা অকার্যকর হয়ে পড়বে। সে ক্ষেত্রে দুদেশ জরুরি আলোচনার মাধ্যমে পানির নতুন পরিমাণ ঠিক করবে। গঙ্গার উজানে ব্যাপকহারে টেনে নেওয়ার পর ফারাক্কা পয়েন্টে যে পরিমাণ পানি পাওয়া যাবে, সেই পানির ভাগই বাংলাদেশ পাবে। গঙ্গার পুরো পানির ওপর আমাদের কোনো অধিকার নেই। তাহলে গঙ্গার পানি পাওয়ার নিশ্চয়তা কোথায়? পানিবণ্টন চুক্তির এটাই সবচেয়ে দুর্বল দিক। চুক্তির এই ভিত্তিটাই বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী। এ ছাড়া চুক্তিতে ইন্টারন্যাশনাল আরবিট্রেশনের সুযোগ রাখা হয়নি। পরিণতিতে ভারত চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করলেও দেন-দরবার করার জন্য অন্য কোথাও যাওয়ার পথ খোলা নেই। অথচ নেপালের সঙ্গে মহাকালী নদী চুক্তিতে ভারত ইন্টারন্যাশনাল আরবিট্রেশন মেনে নিয়েছে। এমনকি সিন্ধু নদের পানি চুক্তিতে এই সুযোগ আছে।

গঙ্গা চুক্তিতে প্রকৃত অর্থে গঙ্গার পানিবণ্টন সমস্যার আদৌ কোনো সমাধান হয়নি। একইভাবে তিস্তা নদী নিয়ে ভারতের সঙ্গে কোনো চুক্তি স্বাক্ষর করা সম্ভব হয়নি। ২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় গঙ্গার মতো তিস্তার ক্ষেত্রেও একটি মুখ দেখানো চুক্তির উদ্যোগ নেওয়া হলেও তাও ব্যর্থ হয়। তখন হাসিনা সরকার ঘোষণা দিয়েছিল, তিস্তা চুক্তি না হলে ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দেওয়া হবে না। কিন্তু হাসিনা শুধু ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দেয়নি, ভারতের স্বার্থ পূরণে আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনাসহ মোংলা ও চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের অনুমতি দেন।

এরপর চীন তিস্তা প্রকল্পে আগ্রহী হয়। কিন্তু ভারতের বাধার মুখে সে প্রকল্পের কাজ শুরু করতে পারেনি।

বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো ধরনের যুদ্ধ পরিস্থিতি ছাড়া ভারতের অনুগত বন্ধু সরকারের সময় গঙ্গা ও তিস্তায় পানি প্রত্যাহার শুরু করে ভারত। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দুর্বলতার সুযোগ নিয়েছে ভারত। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে এই দুটি নদীর পানিবণ্টনে যতটা স্বার্থ রক্ষা করা সম্ভব হয়েছিল, হাসিনা আমলে তা আর রক্ষা করা সম্ভব হয়নি।

বাংলাদেশ যদি পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে চায়, তাহলে ভারতের ওপর চাপ প্রয়োগের নীতি বাংলাদেশকে গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশ-ভারত অভিন্ন নদীর অনেকগুলোর উৎসমুখ চীনে। চীন এখন ব্রহ্মপুত্র নদের উজানে বাঁধ নির্মাণ করে পানি প্রত্যাহারের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। চীন যাতে এমন পরিকল্পনা গ্রহণ না করে, তা নিয়ে ভারত চীনের সঙ্গে দেন-দরবারের চেষ্টা করে যাচ্ছে। চীন ব্রহ্মপুত্রের পানি প্রত্যাহার করলে শুধু ভারত নয়, বাংলাদেশও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এটি বাংলাদেশের প্রধান নদী। ফলে বাংলাদেশের পানি ব্যবস্থাপনার সঙ্গে চীনকে সম্পৃক্ত করা এখন জরুরি হয়ে উঠেছে।

সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস চীন সফরের সময় বাংলাদেশের নদী ও পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার জন্য চীনের কাছ থেকে ৫০ বছরের একটি মাস্টারপ্ল্যান চেয়েছেন। অববাহিকাভিত্তিক নদী ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। চীন একই সঙ্গে তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়নে আগ্রহী। এখন বাংলাদেশের সামনে একমাত্র পথ হচ্ছে ভারতের পানি অস্ত্র মোকাবিলায় নদী ও পানি ব্যবস্থাপনায় চীনের সঙ্গে বহুমুখী প্রকল্প গ্রহণ করা। যাতে বর্ষা মৌসুমে আসা পানি সংরক্ষণ করে নদীগুলোর অভ্যন্তরীণ প্রবাহ ফিরিয়ে আনা যায়। শুকনো মৌসুমে একতরফা পানি প্রত্যাহার করলেও বাংলাদেশের পানির চাহিদা ও সেচ কার্যক্রম যাতে ব্যাহত না হয়। আমরা যেন ভুলে না যাই ফারাক্কা বাঁধ চালু করার মধ্য দিয়ে পাকিস্তান নয়, বাংলাদেশের ওপর ভারত পানির অস্ত্র প্রয়োগ করেছিল।