Image description
আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড । পলাতক ২০২ জনের মধ্যে ১৪৭ জন অধরা । পলাতকদের ধরতে কাজ করা হচ্ছে : আইজি প্রিজন ।

আজো হদিস মেলেনি জেল থেকে পালানো বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের ফাঁসির আসামি ছাত্রলীগ নেতা মুনতাসির আল জেমিসহ ১৪৭ জনের। তিনি দেশেই আছেন নাকি বিদেশে পালিয়েছেন সে ব্যাপারেও কোনো তথ্য নেই গোয়েন্দাদের কাছে। তবে কাশিমপুর কারাগারের তৎকালীন কিছু কর্মকর্তার সহায়তায় জেল থেকে পালিয়েছেন জেমি এটি প্রায় নিশ্চিত বলে ধারণা করছে আবরারের পরিবার। তারা বলছেন, জেমির পালিয়ে যাওয়ার দায় কেউ নিতে চাইছে না। ধারণা করা হচ্ছে জেল থেকে পালানোর পর জেমি প্রতিবেশী দেশে পালিয়ে গেছে।

এ দিকে প্রশ্ন উঠেছে হাইসিকিউরিটি জোন কাশিমপুর কারাগার থেকে কিভাবে আসামি পালিয়ে যায় তা নিয়ে। তা ছাড়া ফাঁসির আসামি জেমির সাধারণ কারাবন্দীদের সাথে থাকার কথা ছিল না। তার থাকার কথা ছিল কনডেম সেলে। সেখান থেকে কিভাবে পালাল সে। অনেকের মতে কারাগারের কোনো কর্মকর্তার সহযোগিতা ছাড়া সেখান থেকে কারো পালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কারো ইন্ধনে তাকে সহযোগিতা করা হয়েছে? কে বা কারা সহযোগিতা করেছেন এখন পর্যন্ত সেটিও শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। তবে ঘটনার পর থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। ওই মামলার পর পুলিশ পালিয়ে যাওয়া ২০২ জনের মধ্যে ৫৫ জনকে আটক করেছে। জেমিসহ বাকি ১৪৭ জন আসামি এখনো অধরা রয়েছে। পলাতক এসব আসামির সবাই মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত।

আবরার হত্যাকাণ্ড ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগ নেতারা নানা ষড়যন্ত্র করেছিল। তারা আবরারকে শিবিরকর্মী আখ্যা দিয়েছিল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আবরার ফাহাদ ইসলামী ছাত্রশিবিরের তালিকাভুক্ত কেউ ছিলেন না।

আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ছাত্রলীগ নেতা মুনতাসির আল জেমির বন্দী নাম্বার ছিল ৫১৭৭। মুনতাসির আল জেমি (২৬) নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার কালিয়ান গ্রামের আব্দুল মজিদের ছেলে।

পুলিশ ও কারাকর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ৬ আগস্ট কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে অবস্থানরত বিভিন্ন ধরনের দুর্ধর্ষ বন্দী দাঙ্গা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালায়। বিশৃঙ্খলা ও দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণে কারাবিধি অনুযায়ী প্রথমে সতর্ক করা হলেও বন্দীরা আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তখন কারাকর্তৃপক্ষ দাঙ্গা হাঙ্গামা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টাকালে ২৫-৩০ কারারক্ষী গুরুতর আহত হয়। একপর্যায়ে কারাগারের দেয়াল ভেঙে ফেলে এবং বৈদ্যুতিক পোল উপড়ে তা দিয়ে মই বানিয়ে কারাগারের দেয়াল টপকে ২০২ জন বন্দী পালিয়ে যায়। এ সময় বিশৃঙ্খলা ও দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণে কারাবিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নিলে ছয়জন বন্দী নিহত হয়।

কারাগার থেকে আসামি পালিয়ে যাওয়ার ঘটনায় গত বছর ১৫ আগস্ট কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারের জেলার মো: লুৎফর রহমান বাদী হয়ে গাজীপুর মহানগরীর কোনোবাড়ী থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। ওই মামলার পর কোনোবাড়ি থানা পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ৫৫ জনকে গ্রেফতার করে কোনাবাড়ী থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে।

এ দিকে জেমির পালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে কারা কর্তৃপক্ষ আবরার ফাহাদের পরিবারকে জানায়নি। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি আদালতে শুনানির সময় তার পরিবার বিষয়টি জানতে পারে এবং আবরার ফাহাদের ছোট ভাই ও বুয়েট ছাত্র আবরার ফাইয়াজ ওই দিন সন্ধ্যায় তার লিখেন, আবরার ফাহাদ হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামি জেমি জেলখানা থেকে পালিয়ে গেছে ৫ আগস্টের পরে। অথচ আমাদের জানানো হচ্ছে আজকে, যখন ওর আইনজীবী কোনো যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করতে আসেনি তখন। ফাঁসির আসামির তো কনডেম সেলে থাকার কথা ছিল, সে পালায় কিভাবে! পালানোর পরেও এ তথ্য বাইরে না আসা তো এটাই প্রমাণ করে যে, তাকে ধরতেও কোনো চেষ্টা করা হয়নি। আগে থেকেই আরো তিনজন পলাতক আছে।

২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে বুয়েটের শেরেবাংলা হলে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবরার ফাহাদকে ছাত্রলীগের (বর্তমানে নিষিদ্ধ) একদল নেতাকর্মী পিটিয়ে হত্যা করে। হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার দায়ে ২০২১ সালের ৮ ডিসেম্বর বুয়েটের ২০ শিক্ষার্থীকে মৃত্যুদণ্ড ও পাঁচজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেন বিচারিক আদালত। পরে আসামিদের ডেথ রেফারেন্স, আপিল ও জেল আপিলের ওপর দীর্ঘ শুনানি শেষে ২০২৫ সালের ১৬ মার্চ বিচারিক আদালতের এ রায় বহাল রেখে রায় দেন হাইকোর্ট।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলো- বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল (সিই বিভাগ, ১৩তম ব্যাচ), সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান রবিন (কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ১৫তম ব্যাচ), তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অনিক সরকার অপু (মেকানিক্যাল ইঞ্জনিয়ারিং, ১৫তম ব্যাচ), সাহিত্য সম্পাদক মনিরুজ্জামান মনির (ওয়াটার রিসোর্সেস ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৬তম ব্যাচ), ক্রীড়া সম্পাদক মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন (মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৫তম ব্যাচ), উপসমাজসেবা সম্পাদক ইফতি মোশাররফ সকাল (বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৬তম ব্যাচ), সদস্য মুনতাসির আল জেমি (এমআই বিভাগ), সদস্য মোজাহিদুর রহমান (ইইই বিভাগ, ১৬তম ব্যাচ), সদস্য হোসেন মোহাম্মদ তোহা (এমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), সদস্য এহতেশামুল রাব্বি তানিম (সিই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), শামীম বিল্লাহ (মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), মাজেদুর রহমান মাজেদ (এমএমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), খন্দকার তাবাক্কারুল ইসলাম তানভীর (মেকানিক্যাল, ১৭তম ব্যাচ), মুহাম্মদ মোর্শেদ-উজ-জামান মণ্ডল জিসান (ইইই বিভাগ, ১৬তম ব্যাচ), এস এম নাজমুস সাদাত (এমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), মোর্শেদ অমর্ত্য ইসলাম (এমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), মিজানুর রহমান (ওয়াটার রিসোর্সেস, ১৬ ব্যাচ), শামছুল আরেফিন রাফাত (মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং), উপদফতর সম্পাদক মুজতবা রাফিদ (কেমিকৌশল) এবং এস এম মাহামুদ সেতু (কেমিকৌশল)।

যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ আসামি হলেন- বুয়েট ছাত্রলীগের সহসভাপতি মুহতাসিম ফুয়াদ (১৪তম ব্যাচ, সিই বিভাগ), গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক ইসতিয়াক আহমেদ মুন্না (মেকানিক্যাল, তৃতীয় বর্ষ), আইনবিষয়ক উপসম্পাদক অমিত সাহা (সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং), সদস্য আকাশ হোসেন (সিই বিভাগ, ১৬তম ব্যাচ) ও মোয়াজ আবু হোরায়রা (সিএসই, ১৭ ব্যাচ)। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স, আসামিদের আপিল ও জেল আপিলের ওপর শুনানি শেষ হয়। এরপর আদালত মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখেন।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে গতকাল আবরার ফাইয়াজ নয়া দিগন্তকে বলেন, জেমির পালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে দিনশেষে দায় নিতে চাচ্ছে না কেউ। বর্তমান যারা দায়িত্বে আছেন তারা বলছেন, আমরা নতুন দায়িত্ব নিয়েছি। এ ব্যাপারে আমরা এখনো তেমন কিছু জানি না। তবে আমরা আশায় থাকব জড়িত সবাই শাস্তির আওতায় আসুক।

জানতে চাইলে ইসলামী ছাত্রশিবির কেন্দ্রীয় কমিটির অফিস সেক্রেটারি সিবগাতুল্লাহ নয়া দিগন্তকে বলেন, আবরার ফাহাদ ইসলামী ছাত্রশিবিরের তালিকাভুক্ত কেউ ছিলেন না। তবে তিনি ছিলেন ইসলামিক মানসিকতার। হয়তো সে কারণেই শিবিরের কার্যক্রমকে পছন্দ করে থাকতে পারেন। এর বাইরে আর কিছুই ছিল না।

এ দিকে কাশিমপুর কারাগার থেকে আসামিদের পলায়নের ঘটনায় কোনাবাড়ী থানায় দায়ের করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই রফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা এখন পর্যন্ত ৫৬ জনকে গ্রেফতার করেছি। অন্যদের গ্রেফতার করতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তিনি আরো বলেন, মামলা দায়েরের পর কারাকার্তৃপক্ষ আমাদের সাথে কোনো যোগাযোগ রাখেনি বা কেউ স্বেচ্ছায় কারাগারে ফিরে এসেছে কি না সেটিও জানায়নি।

কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারের জেল সুপার আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, পুলিশ ৫৬ জনকে গ্রেফতারের দাবি করলেও তারা এ পর্যন্ত কারাগারে ফেরত পেয়েছেন ৫৫ জনকে। আলোচিত আবরার হত্যা মামলার আসামি মুনতাসির আল জেমি এখনো ফেরত আসেনি। পলাতকদের মধ্যে আবরার হত্যা মামলার আসামি জেমি ছাড়া আলোচিত আর কোনো মামলার আসামি নেই।

জানতে চাইলে আইজি প্রিজন ব্রি. জেনারেল সৈয়দ মো: মোতাহের হোসেন নয়া দিগন্তকে বলেন, সরকারের বিভিন্ন সংস্থা কাজ করছে। আমরা তাদের সার্বিক সহায়তা করছি যাতে পালিয়ে যাওয়া জেমিসহ অন্য আসামিদের দ্রুত আটক করে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়। এই ঘটনায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।