
ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল—একটি নাম, একটি প্রতীক। তার হাত ধরেই বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে নার্সিং পেশা। নাসিং শুধু পেশা নয়, একইসঙ্গে মহৎ সেবাকর্মও। যারা নাসিং পেশায় জড়িত, সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে রোগীদের সেবা দেন—কেমন আছেন তারা? রাজধানীর বেশ কিছু হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, এ যুগের ফ্লোরেন্স নাইটিংগেলরা ভালো নেই। তাদের মধ্যে দেখা গেল নার্সিং পেশা নিয়ে হতাশা, ক্ষোভ ও শোষণের নানা চিত্র।
মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নার্স লাউঞ্জে ঢুকতেই দেখা গেল কয়েকজন সাধারণ নার্স যার যার কাছে ব্যস্ত। ক্ষণিক কথা বলে বোঝা গেল—এই পেশার বাইরের চাকচিক্য যতই থাকুক, ভেতরে জমে আছে চাপা ক্ষোভ আর ক্লান্তির দীর্ঘশ্বাস। কথায় কথায় কিছু নার্স বলেই ফেললেন, আমাদের অনেক কিছু বলার আছে, কিন্তু বলা যায় না। এক মুহূর্ত থেমে গিয়ে একজন সংযোজন করলেন, ‘কারণ প্রশাসন নাখোশ হয়ে যায়।’
এই ‘নাখোশ’ হওয়ার ভয় যেন এক অদৃশ্য দেয়াল—যার পেছনে বন্দি হয়ে আছে তাদের সত্যি কথাগুলো। তারা বললেন না ঠিকই, তবে বোঝা গেল—দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা, দায়িত্বের ভারসাম্যহীনতা আর সম্মানের ঘাটতি কেমন করে তাদের আঘাত করছে ভেতর থেকে। কেউ মুখ খোলে না কারণ যে কথা বলবে, সে-ই হয়ত বদলির মুখে পড়বে কিংবা ‘অসম্মানজনক আচরণ’-এর অভিযোগ গায়ে মাখতে হবে।
এই নীরবতা আসলে একধরনের আর্তনাদ। অনেক কিছু বলার আছে তাদের—কিন্তু যারা শোনার ক্ষমতায় আছেন তারা হয়তো শুনতে চান না। আর যারা বলতে চান তারা জানেন—এই বলার দায় অনেক বড় ও অনেক মূল্যবান।
এদিকে এই হাসপাতালের নার্সিং সুপার-ইনটেন্ডেন্ট শাহানারা আক্তার বলেন, নার্সিং পেশা হলো একটা মহৎ পেশা। আমাদের এখানে ৪০০ নার্স রয়েছে। নার্স হিসাবে আমি খেয়াল করি কীভাবে এজন রোগী ভাল চিকিৎসা পেতে পারেন। আমাদের করোনা ও ডেঙ্গুর সময় রোগীর সেবায় নার্সদের ভালো সুনাম আছে। ওই সময় আমাদের হাসপাতালে ১২০০ থেকে ১৪০০ এর মতো রোগী ছিলেন। আমাদের এটি হলো ৫০০ বেডের হাসপাতাল । আমরা এখানে আন্তরিকতার সাথে রোগীদের সাথে আচরণ করি। যখন রোগীরা হাসপাতাল ছেড়ে চলে যান, তখন যাতে সন্তুষ্ট হয়।
তিনি আরও বলেন, আমাদের এখানে ৩ টা ব্যাচ কাজ করে। সকাল ৮ টা থেকে দুপুর ২টা প্রথম ব্যাচ। তারপর দুপুর ২টা থেকে রাত ৮টা। আবার রাত ৮টা থেকে সকাল ৮টা। আর আমরা যারা প্রশাসনে আছি, তারা অফিসিয়াল সময়টা ব্যবহার করি।
নার্সদের কাজের বিবরণ বলতে গিয়ে তিনি বলেন, সকালে একজন নার্স এসেই প্রথমে ওয়ার্ডে যায় এবং রোগীর খোঁজ খবর নেয়। রোগীর বেড মেকিং থেকে আরম্ভ করে মেডিসিন দেওয়া ও খাবার দেওয়া। সেই সঙ্গে ইনভেস্টিগেশনের কাজগুলো করা। ওয়ার্ডটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা তাও নার্সদের দায়িত্ব। মোট কথা হাসপাতালের বড় একটা অংশের কাজ নার্সরাই করেন।
এদিকে, জাতীয় চক্ষু হাসপাতালের নার্স সুপার অফিসে ঢুকতেই কিছু অভিযোগ কানে এলো। নার্স সুপার নাফিসা আক্তার (ছদ্মনাম) বলেন, নারীদের সব পেশাতে পরুষ কর্তৃক ডমিনেটেট হয়। আমরা নার্স হিসাবে তেমন কোন মূল্যায়ন পাই না। সব জায়গায় পুরুষদের আধিপত্য। যেইটা আমরা চাই সেইটা পাই না। আমাদের গুরুত্ব কম দেয়।
প্রতিদিনের কাজের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, আমরা প্রতিদিনই রোগীদের নিয়ে কাজ করে থাকি। আমাদের এই হাসপাতালটি আউটডোর বেইজ হাসপাতাল। আমরা আউটডোর রোগীদের নিয়েই বেশি কাজ করি। আমরা নার্স হিসাবে ১:২ থাকলেও কিন্তু আমরা কাজ করছি ১:৫০ রোগী নিয়ে। এখানে রোগী ওভারলোডেড।
তিনি বলেন, আমাদের সারাদিনই রোগীদের পিছনে দৌড়াতে হয়। আমরা সার্জারিতে সাধারণত ড্রেসিং,ইনজেকশন ও স্যালাইনের কাজ করে থাকি।
তিনি আরও বলেন, আউটডোরে মেশিনে চোখের কাজগুলোর পরীক্ষা করে থাকি। কোন একটা কাজ বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা আমাদেরই করতে হয়। কিছু জায়গায় নার্সদের দরকার নাই ওখানেও কাজ করতে হয়। হাসপাতালে রোগী ঢুকা থেকে শুরু করে বিদায় হওয়া পর্যন্ত সব রোগী নার্সদেরই কেয়ারিংয়ে থাকে।
নার্সদের অ্যাকাডেমিক নিয়ে তিনি বলেন, নার্সরা সাধারণত এইচএসসি শেষ করে বিএসসি (৪ বছরের) বা ডিপ্লোমা (৩বছরের) করে থাকে। আমাদের এখানে নার্সের সংখ্যা হলো ২৫০ জন। কিন্তু বর্তমানে রানিং ২০০ জন। এখান থেকে পড়াশোনা শেষ করে পরবর্তী আমাদের টার্গেট থাকে সুপারভাইজার,নার্সিং স্টাফ ও প্রভাষক হওয়া ।
একইভাবে জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতালে গেলে সেখানকার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নার্স জানান, নার্সরা সাধারণত অপারেশন থিয়েটার, ওয়ার্ড এবং ইনভেস্টিগেশন বিভাগে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। রোগীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় কাজের চাপও তুলনামূলকভাবে বেশি থাকে। তবে কর্মস্থলে নার্সদের প্রায়ই ডমিনেশনের মুখোমুখি হতে হয়। তিনি বলেন, ‘ডাক্তারদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে অনেক সময় এমন পরিস্থিতি হয় যা কিছুটা স্বাভাবিক বলেই ধরা হয়।” তবে নার্সদের স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ থাকে না। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ ছাড়া নার্সরা কিছু বলতে বা করতে পারেন না যা একধরনের কর্মস্থলের পরাধীনতারই প্রতিচ্ছবি।