
জীবনটা এমন হবে ভাবিনি। খারাপ লাগে। উচ্চশিক্ষা-দীক্ষায় দুই কন্যাকে মানুষ করেছিলাম। টাকা-পয়সার কমতি নেই। ঢাকায় নিজের বাড়ি, ভাড়ায় আরও তিন সুবিশাল ফ্ল্যাট। আজ একটা আনন্দের দিন। ওদের (দুই কন্যা) আমাকেই ফোন করতে হয়েছে। অবস্থা এমন যেন কথা বলার ফুসরত ওদের নেই। অথচ জীবনে কতো কতো সময়, শ্রম, উপার্জন ব্যয় করেছি ওদের পেছনে। আক্ষেপ হয় কি করলাম জীবনে!
এভাবেই আক্ষেপের বহিঃপ্রকাশ করেন সোয়েলি আক্তার নামে এক মা। তিনি একসময় সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ছিলেন।
তার (সোয়েলি আক্তার) স্বামী মারা গেছেন অনেক আগেই। আর দুই কন্যা সন্তান উচ্চশিক্ষার কথা বলে তাদের স্বামীর সঙ্গে কানাডা ও আমেরিকায় এখন স্থায়ী। তিনিই শুধু পড়ে আছেন ঢাকার ইন্দিরা রোডে। খারাপ লাগলেই চলে আসেন রাজধানীর আগারগাঁয়ের ‘প্রবীণ নিবাসে’। ঈদের এই নিঃসঙ্গ সময়টা তিনি কাটাচ্ছেন প্রবীণ নিবাসেই।
আজ (৩১ মার্চ) দুপুরে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, প্রবীণ নিবাসের বারান্দায় ননদের সঙ্গে গল্প করছেন তিনি। দুপুরের খাবার রুমে পৌঁছে গেলেও গল্প যেন অমৃতের স্বাদের মতো তার কাছে। ঢাকা পোস্টের প্রতিবেদকের পরিচয় দিয়ে কথা বলতে চাইতেই রুমে ডেকে নেন তিনি। খুলে বসেন গল্পের ঝুলি। যেন কথা বলার একজন মানুষ মিলেছে তার।
সোয়েলি আক্তার বলেন, এখানে (প্রবীণ নিবাস) আমার নিজের বলে আর কেউ থাকে না। তবুও এখানে আসি। কারও পরিবার চায় না, কেউ ডিভোর্সি, কেউবা অভিমানে এখানে এসেছেন। আমারটা একটু আলাদা। প্রথমে থেরাপি নিতে এখানে আসতাম। এখন মাসের ১৫/২০ দিন এখানেই থাকি।
তিনি বলেন, আত্মীয়-স্বজনরা খবর নেয়। কিন্তু নিজের বলে যারা সেই দুই মেয়েই বড় অবহেলা করে। ওরা তো ব্যস্ত। আজকে একটা ঈদের দিন তবুও কেউ নিজে থেকে ফোন করেনি। বড় মেয়ে তো আমেরিকা থাকে। সে তো কথা বলারই সময় নেই বলে ফোন রেখে দিছে। আর ছোট মেয়ে বলছে পরে ফোন করবে। এসব দেখে বাসার বুয়া বলে কেন যে এতো পড়াতে গেছেন। অল্প শিক্ষা আর অল্প বয়সে এখানে বিয়ে দিয়ে দিতেন কাছেই থাকতো। শুনি আর হাসি।
আক্ষেপ করে এই মা আরও বলেন, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি। স্বামীও ঢাবির আইআরের ছাত্র ছিল। ইউএনডিপিতে জব করতো। প্রচুর টাকা কামিয়ে গেছেন। কিন্তু জীবনের শেষ দুই বছর হয়তো সে অবহেলা কি জিনিস টের পেয়েছেন। মরণব্যাধি ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। হয়তো আমিও মরে যাবো। কিন্তু খারাপ লাগে এমন দিনে মেয়েদের যদি কাছে পেতাম। নাতি-নাতনি। থাক এসব বলে কি লাভ ওদের তো এসব অনুভূতিই নেই।
সোয়েলি আক্তার বলেন, অবহেলা অভিমান ভুলে ফোন করি, সুখ-দুঃখের দুটো কথা বলতে মন চায়। ফোন দিলে কথাই বলতে চায় না। ছোট মেয়েটার সঙ্গে কথা হয়, তবে সে কথা যেন সময়ের মাপে। অফিস যাওয়ার ও আসার পথে যখন সে গাড়ি ড্রাইভ করে তখন বলে। এসব বুঝি। বুঝেও কথা বলি। বলতে যে ইচ্ছে করে।
তিনি বলেন, এখানে থাকতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু তবুও থাকতে হয়। বাসায় বুয়া ছাড়া কেউ নেই। এখানে তো দুটো কথা বলার মানুষ আছে!
একই ফ্লোরে কথা হয় আরেক নারী প্রবীণের সঙ্গে। নিজের নাম প্রকাশ না করে রংপুর থেকে আসা এ প্রবীণ বলেন, পরিবারের সবাই প্রতিষ্ঠিত। স্বামী মারা গেছে। দুই ছেলে-মেয়ে প্রতিষ্ঠিত।
সরকারি চাকরি করা এ নারী বলেন, এখনো সম্মানের সঙ্গে বাঁচার চেষ্টা করছি। এতো শ্রম, উপার্জন যাদের জন্য সেই তাদের আচরণে যখন মনে হয়েছে আমি ‘বোঝা’ দেরি করিনি। খোঁজ-খবর নিয়ে সোজা এখানে চলে আসছি। আমার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনদের অনেকেই এখানে আশপাশেই থাকে। অনেকে দেখতে আসে। পরিবারের লোকজনও আসে। কিন্তু আমি আর ফিরি না। আত্মসম্মানে লাগছে। ফিরে গিয়ে বোঝা হয়ে বাঁচার চাইতে এখানেই নিজের মতো থাকাকেই ভালো মনে হয়।
এভাবে মনের চাপা কষ্ট নিয়ে আরও অনেকেই এই প্রবীণ নিবাসে বসবাস করছেন বছরের পর বছর। শুধু অবহেলা আর অভিমানের কারণেই এখানে ২৫ বছর কাটিয়ে দিয়েছেন চিত্রশিল্পী শেখ মুজিবুল হক। অথচ রাজধানীর ধানমন্ডি শংকরে নিজের রোজগারে গড়া বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট আছে তার। রয়েছে তিন মেয়ে এক ছেলে। ছেলে-মেয়েদের সেই শংকরের অ্যাপার্টমেন্টে জায়গা হয়েছে। যখন দেখেছেন নিজের জন্য সন্তানদের জায়গা হচ্ছে না, অভিমান থেকে নিজেই জায়গা করে নিয়েছেন এই প্রবীণ নিবাসে। এরপর মুখফুটে কোনোদিন শোনেননি মুজিবুল ‘বাবা বাসায় ফিরে আসো’।
ফিরতে মন চায় না? জানতে চাইতেই তিনি অনেকটা আঁতকে ওঠার মতো করেই যেন বলেন, ‘না না আমি তো এখানেই ভালো আছি। বুঝে গেছি ওরা নেবে না। ছেলেটা অমায়িক, তবুও ফিরি না। যদি কখনো শুনি, জায়গা হবে না! এই ভেবেই ফেরা হয় না।’
পেশায় চিত্রশিল্পী মুজিবুলের বাবা ছিলেন ব্রিটিশ আমলের কালেক্টর। পৈত্রিক নিবাস যশোরের শেখ পাড়ায় হলেও জন্ম তার রংপুরে। বাবা-মা’র সাথেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তরে ঘুরে বেড়িয়েছেন জেদি অভিমানী শেখ মুজিবুল। অথচ অব্যক্ত কষ্ট নিয়ে ২৫ বছর আগে ওঠেন এই আগারগাঁওয়ের প্রবীণ নিবাসে।
গল্পে আর কথায় তুলে ধরেন ইন্টারমিডিয়েট সময় থেকেই টিউশনি করে নিজের খরচ চালানোর স্মৃতি। রেকর্ড মার্কস নিয়ে ঢাকা কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্স ও মাস্টার্স করা মুজিবুল ছবি আঁকাতে পারঙ্গম। নিজের কক্ষে ডেকে নিয়ে দেখান নিজের হাতে আঁকা সব ছবি।
তিনি বলেন, ‘প্রকৃতির ছবি আঁকাতেই বুঁদ হয়েছিলাম একটা সময়। জাপান থেকে সরকারি খরচে স্কলারশিপের সুযোগ পেয়েছিলাম। কিন্তু পরিবারের কথা ভেবে যাইনি। সেই আমিই আজ প্রবীণ নিবাসে। এখন মনে হয় শয়তানে ভর করেছিল। না গিয়েই বরং ভুল করেছি।’
রাজধানীর লালমাটিয়ায় একটি ইংলিশ মিডিয়াম কলেজে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছেন শেখ মুজিবুল হক। শিক্ষকতার পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি মন টেনেছে আঁকাআঁকিতে। এখনো সুযোগ ও ধৈর্যে কুলালে ছবি আঁকেন এ প্রবীণ।
তিনি বলেন, আজকে ঈদের দিন এটাই ভুলে গিয়েছিলাম। সেমাই দেখে সাত্তারকে (নিবাস সহ-ম্যানেজার) বললাম কি ব্যাপার। বলে স্যার আজ ঈদ। শুনে চোখ ছল ছল করে ওঠে আমার।
তিনি আরও বলেন, ‘স্বার্থপরতার চেয়ে একাকীত্বই এখন ভালো লাগে। খারাপ লাগলে গান গাই, ভালো লাগলে ছবি আঁকি। এভাবেই যাচ্ছে কেটে দিন। বারান্দা বড় ভালো লাগে। দক্ষিণা হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে মন চায়।
বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘের তত্ত্বাবধায়ক (হোম ম্যানেজার) মুহাম্মদ গোলাম রব্বনী মিয়াও এখানকার একজন বাসিন্দা। তিনি চাকরি করতেন আণবিক পরমাণু কমিশনে। অবসরের পরই স্ত্রী মারা যান। তারও দুই কন্যা। দুই কন্যাকে বিয়ে দিয়ে তিনি উঠে পড়েন এই প্রবীণ নিবাসে।
তিনি বলেন, এখানে বিশেষ কোনো সমস্যা নেই। সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও সমাজসেবা অধিদপ্তরের অনুদানে চলা এই প্রতিষ্ঠানের বাসিন্দা এখন ২৯ জন। তাদের মধ্যে নারী ১৩ পুরুষ ১৬।
প্রবীণ নিবাসেই এখন থাকতে ভালো লাগে উল্লেখ করে গোলাম রব্বানী বলেন, আমি মেয়েদের ওপরে ডিপেন্ড হতে চাইনি। তাই এখানে চলে এসেছি। আমি চাইলেই ওদের কাছে যেতে পারি। ওরাও আসে। মন চাইলে কক্সবাজারে ঘুরতে যাই। মসজিদে নামাজ পড়ি। রমজানে দশদিন ইতিকাফে ছিলাম। সব মিলে ভালো আছি।