
যেসব কারণে এবার ঘরমুখো মানুষের ঈদযাত্রায় স্বস্তি
সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নানা উদ্যোগ এবং অনিয়ম রোধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কঠোর নজরদারির ফলে বদলে গেছে ঈদযাত্রার চিত্র। এছাড়া দেশের বিভিন্ন মহাসড়কে নতুন লেন বৃদ্ধি, যমুনা সেতুতে ট্রেন লাইন চালু, কিছু নির্মাণাধীন সড়কের কাজ সম্পন্ন হওয়ায় এবার ঈদযাত্রা সহজ ও আরামদায়ক হয়েছে। এতে স্বস্তি প্রকাশ করেছেন ঘরমুখো মানুষ।
ঢাকা-রংপুর, ঢাকা-সিলেটসহ জাতীয় মহাসড়কের সংস্কার কাজ শেষ হওয়ায় বাসগুলোকে যানজটের কবলে পড়তে হচ্ছে না। এছাড়া নারায়ণগঞ্জের কাঞ্চনপুর ব্রিজ সংলগ্ন নির্মাণাধীন সড়ক খুলে দেওয়া হয়েছে, টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা-যমুনা সেতু ও কাওয়াল ব্রিজ চার লেনে চালু হয়েছে। ঢাকার আমিনবাজারে নির্মাণাধীন সড়কটির কাজ সম্পন্ন হওয়ায় এখন আর আগের মতো গাবতলী সড়কেও যানজট নেই। ফলে দূরপাল্লার বাস সহজেই দ্রুত ঢাকা ত্যাগ করছে।
বাস কাউন্টারে টিকিট কাটছেন যাত্রীরা
গত ২৪ মার্চ থেকে শুরু হওয়া ঈদযাত্রায় রাজধানীর বাস টার্মিনাল ও রেলস্টেশনগুলোতে শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। বিশেষ করে, বাস টার্মিনালগুলোতে অনিয়ম ও অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) বিভিন্ন অভিযান চালিয়েছে। বিআরটিএ’র ভ্রাম্যমাণ আদালত নিয়মিত অভিযান চালিয়ে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধে জরিমানা করেছে। বরাবরের মতো সংস্থাটির ভিজিলেন্স টিম ঢাকার প্রতিটি বাস টার্মিনালে উপস্থিত ছিল। বেশিরভাগ বাস নির্ধারিত সময়েই যাত্রী নিয়ে গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা হয়েছে।
এদিকে, সড়কে যানজট কমাতে ট্রাফিক বিভাগ নানা কার্যকর ব্যবস্থা নিয়েছে। রাস্তার গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে অস্থায়ী বিভাজন তৈরি করে বাসচালকদের নিয়ম মেনে চলতে বাধ্য করা হয়েছে। এতে যত্রতত্র বাস থামিয়ে যাত্রী তোলার প্রবণতা কমেছে। নির্দিষ্ট দূরত্বে দাঁড়িয়ে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করছেন। পাশাপাশি, ত্রুটিপূর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ বাস চলাচল বন্ধে বিআরটিএ বিভিন্ন গ্যারেজ ও ওয়ার্কশপে অভিযান চালিয়েছে, যাতে অনুপযুক্ত যানবাহন রাস্তায় নামতে না পারে।
ঢাকা রেলওয়ে স্টেশনেও এবারের ঈদযাত্রায় শৃঙ্খলা ছিল প্রশংসনীয়। আগের মতো স্টেশনে অতিরিক্ত ভিড়ের কোনও চিত্র দেখা যায়নি, যার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ ছিল অনলাইনে শতভাগ টিকিট বিক্রির ব্যবস্থা। টিকিটের জন্য স্টেশনে যাত্রীদের দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ানোর প্রয়োজন পড়েনি। পাশাপাশি, টিকিট কালোবাজারি রোধেও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। একটি এনআইডি দিয়ে একটিমাত্র টিকিট কেনার ব্যবস্থা থাকায় দালালদের দৌরাত্ম্য অনেকটাই কমেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কয়েকটি জায়গায় কালোবাজারিদের আটক করেছেন এবং যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছেন।
রেলস্টেশনগুলোর নিরাপত্তা বাড়াতে তিন স্তরের চেকিং ব্যবস্থা কার্যকর করা হয়েছে। এতে বিনা টিকিটে কেউ প্ল্যাটফর্মে প্রবেশ করতে পারেনি। যাত্রীদের অতিরিক্ত চাপ সামাল দিতে ট্রেনে মোট আসনের ২৫ শতাংশ স্ট্যান্ডিং টিকিট বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা পূর্বপরিকল্পিত। এই উদ্যোগের ফলে ট্রেনের ছাদে যাত্রী ওঠার চিত্র এবারে দেখা যায়নি। স্টেশন এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করায় প্রবেশপথের অবৈধ চোরা গেট বন্ধ রাখা হয়েছে এবং নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। যাতে কেউ মই বা টুল ব্যবহার করে ট্রেনের ছাদে উঠতে না পারে, সে বিষয়েও সতর্ক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
এছাড়া পদ্মা সেতু চালু হওয়ার ফলে দক্ষিণাঞ্চলগামী বাস যাত্রীদের চাপ নির্দিষ্ট কোনও বাস টার্মিনালে আর পড়ছে না। একইভাবে, লঞ্চঘাটেও আগের তুলনায় যাত্রীর সংখ্যা কম ছিল। ফলে যাত্রীদের তেমন কোনও দুর্ভোগ পোহাতে হয়নি।
বিভিন্ন বাস টার্মিনালের পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এক মাস আগেই বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এবং ঈদের সরকারি ছুটি দীর্ঘ হওয়ায় একবারে বাড়ি যাওয়ার চাপ ছিল না। ফলে অনেকটাই শৃঙ্খলার মধ্যে চলে এসেছে। তাছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ আগের তুলনায় এ বছর বেশ তৎপর ছিল, তাই টার্মিনালগুলোতে বিশৃঙ্খলা কমে এসেছে।
এদিকে যাত্রীরা স্বস্তি প্রকাশ করে জানান, গত কয়েক বছর ধরেই ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে কর্তৃপক্ষ সচেষ্ট থাকলেও সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থাপনার অভাবে তার সুফল পাওয়া যাচ্ছিল না। তবে এ বছর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, ট্রাফিক পুলিশ ও সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের জোর প্রচেষ্টায় পরিবহন সেক্টরকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে।
গাবতলী বাস টার্মিনালে আসা চুয়াডাঙ্গার যাত্রী আশিকুর রহমান বলেন, ‘অনলাইনে টিকিট না কাটলেও বাস স্ট্যান্ড এসে টিকিট পেয়েছি। অতিরিক্ত ভাড়া নেয়নি। এখন পর্যন্ত আশপাশ দেখে মনে হচ্ছে ঈদযাত্রা নিরাপদ করতে সবাই চেষ্টা করছে। বাকিটা বাসায় যাওয়া পথে বোঝা যাবে। রাস্তায় কোনও জ্যাম না থাকলেই হলো।’
খুলনার যাত্রী মারজানা বলেন, ‘টিকিট পাওয়া যাচ্ছে, কোনও ঝামেলা হচ্ছে না। সময়মতো বাস ছাড়বে বলে জানিয়েছে। অপেক্ষায় আছি।’
বাস টার্মিনালের সামনে এখন কোনও ভিড় নেই জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সব নিয়ম মেনেই চলছে মনে হলো। রাস্তা থেকে যাত্রী তুলতে দেখছি না, সব রানিংয়ে আছে।’
ঈদ উপলক্ষে বিআরটিসির বিশেষ বাস সার্ভিস চালু করা হয়েছে
ঈদ উপলক্ষে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট করপোরেশন (বিআরটিসি) বিশেষ বাস সার্ভিস চালু করছে। বাড়ি ফেরা যাত্রীদের নির্বিঘ্ন যাত্রা নিশ্চিত করতে ১ হাজার ২৪৫টি বিআরটিসি বাস প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা থেকে ছেড়ে যাবে ৭৭৫টি বাস এবং ঢাকার বাইরে ৪৭০টি বাস চলবে।
বিআরটিএ’র গাবতলী ডিপো ঘুরে দেখা গেছে, তুলনামূলক সুলভ মূল্য রাখা হচ্ছে যাত্রীদের থেকে। ৬০০ টাকায় রংপুরের টিকিট পাচ্ছেন যাত্রীরা।
টার্মিনালের যাত্রী বিশ্রামাগার নিয়ে অভিযোগ
পরিবহন ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেলেও গাবতলীর যাত্রী বিশ্রামাগার নিয়ে অভিযোগ তুলেছেন যাত্রীরা। আগে কাচের গ্লাস ও এসি থাকলেও এখন আর তা নেই। এছাড়া বসার আসন ও পরিবেশ নোংরা বলে অভিযোগ তাদের।