Image description

দীর্ঘদিন পর রাজধানী ঢাকায় ঈদুল ফিতর উপলক্ষে এমন একটি আনন্দ মিছিল আয়োজন করা হয়েছে, যেখানে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল বাংলার সুলতানি-মুঘল আমলের নানা ঐতিহ্যকে।

আনন্দ মিছিলে গাধার পিঠে বসে থাকা লোককথার চরিত্র নাসিরুদ্দিন হোজ্জার একটি পাপেট বা প্রতিকৃতিও স্থান পায়।

সেই প্রতিকৃতিটির ছবি সোমবার ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

ফেসবুকে সেটি শেয়ার করে অনেককে নানা ধরনের মন্তব্য ও হাস্যরস করতেও দেখা গেছে।

কেউ কেউ আবার গাধার পিঠে নাসিরুদ্দিন হোজ্জার বসে থাকার সাথে ঈদের সংস্কৃতির মিল কোথায় তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন।

আর মূলতঃ পাপেটটিতে বিজ্ঞ দার্শনিক নাসিরুদ্দিন হোজ্জাকে উপস্থাপন করা হলেও, ফেসবুক পোস্টে অনেককে মন্তব্য করেছেন 'এটি দেখতে অনেকটা জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমানের মতো'।

যদিও পাপেটের শিল্পী বিবিসিকে বলেছেন, "নাসিরুদ্দিন হোজ্জা ও জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান একই ব্যক্তিত্বের লোক না।"

পাপেট শিল্পী ও আয়োজকরা বলছেন, মূলত বাংলা সাহিত্য ও মুসলিম সংস্কৃতির ইতিহাস- ঐতিহ্যকে তুলে ধরতেই আয়োজনে 'হোজ্জা' চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ওই পাপেটে।

এবং তারা বলছেন, এটি মূলত শিশুদের বিনোদনের উদ্দেশ্যেই বানানো হয়েছে।

তবে, নাসিরুদ্দিন হোজ্জার পাপেটটি সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে - এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

ঈদ আনন্দ মিছিলে নাসিরুদ্দিন হোজ্জার পাপেট

ভিন্ন এক ঈদ আয়োজন

সোমবার সকালে ঢাকার শেরে বাংলা নগরের পুরনো বাণিজ্য মেলার মাঠে ঈদুল ফিতরের প্রধান জামাত অনুষ্ঠিত হয়। জামাত শেষে সেখান থেকেই শুরু হয় বর্ণাঢ্য ঈদ আনন্দ মিছিল।

আগারগাঁওয়ের প্রধান সড়ক দিয়ে খামারবাড়ি মোড় হয়ে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজার সামনে গিয়ে মিছিলটি শেষ হয়।

মিছিলে অংশ নিতে এসে অনেকেই বলেন, এই ধরনের আয়োজন তাদের অনেকেই এর আগে দেখেননি। যে কারণে এই আয়োজনে শামিল হয়ে অনেকেই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতেও দেখা যায়।

ব্যান্ডদলের বাদ্যযন্ত্রের সাথে সাথে অনেকে নেচে-গেয়ে আনন্দ মিছিলে অংশ নেন।

এই মিছিলে 'রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশীর ঈদ'সহ বিভিন্ন ধরনের ইসলামি সঙ্গীতও বাজানো হয়।

সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে দেশের সাংস্কৃতিক যাত্রা ঠিক পথে হওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

তিনি বলেন, "বাংলাদেশের ৫৪ বছরের ইতিহাসে এবারে যে শিল্পকলা একাডেমিতে প্রথমবারের মতো চাঁদরাতের উৎসব হলো, বা ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে এবং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় ঈদ মিছিল হলো, বা বর্ষবরণ উপলক্ষে দুইদিন ব্যাপী সকল জাতিগোষ্ঠীর অংশগ্রহণে যে উৎসব হতে যাচ্ছে- এই সবই অন্তর্ভুক্তিমূলক সাংস্কৃতিক নীতির প্রকাশ। এই দেশটা সবার।"

এই ঈদ আয়োজনকে বর্ণিল করতেই নানা ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল।

ঈদের কোলাকুলি

হোজ্জার পাপেট নিয়ে আলোচনা, হাস্যরস

আনন্দ মিছিলের অগ্রভাগে দুই সারিতে ছিল আটটি সুসজ্জিত ঘোড়া। আরও ছিল ১৫টি ঘোড়ার গাড়ি,আর ছিল মোগল ও সুলতানি আমলের ইতিহাস সংবলিত ১০টি পাপেট শো।

আর এই পাপেট শো আনন্দ মিছিলে আসা মানুষের মধ্যে বাড়তি আনন্দ যোগ করে, বিশেষ করে এ নিয়ে শিশুদের উচ্ছ্বাস ছিল ছিলো সবচেয়ে বেশি।

পাপেট হিসেবে আরব্য রজনীর পরিচিত আর বিখ্যাত চরিত্র কিংবা বাচ্চাদের কাছে জনপ্রিয় এমন চরিত্র ঠাঁই পেয়েছে।

বড় বড় পাপেট হিসেবে দেখা গেছে আলাদীন, আলী বাবা-চল্লিশ চোর,আর নাসিরুদ্দিন হোজ্জার মতো চরিত্র।

নাসিরুদ্দিন হোজ্জা জনপ্রিয় দার্শনিক এবং বিজ্ঞ ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। কেউ কেউ তাকে মোল্লা নাসিরুদ্দিন নামেও চিনতেন।

তার হাস্যরসাত্মক গল্প এবং উক্তিগুলোই তাকে বইয়ের পাতা থেকে মানুষের জীবনে প্রাসঙ্গিক করে স্মরণীয় চরিত্র করে রেখেছে। শত শত বছর ধরে মানুষ গল্পে বা উপদেশ দিতে মোল্লা নাসিরুদ্দিন হোজ্জার উদাহরন দেয়।

গুরুজনদের বলা গল্প আর বাস্তবে টেলিভিশনের পর্দায় হোজ্জার কার্টুন দেখে শিশুদের কাছেও এ চরিত্রটি পরচিত এবং জনপ্রিয়।

ফলে ঈদ আনন্দ মিছিলে হোজ্জার পাপেট দেখে শিশুরা আনন্দিত হয়েছে নিঃসন্দেহে। কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক মানুষদেরও সেটি কম বিনোদন দেয়নি।

ফলে ফেসবুকে এটি নিয়ে নানা রকম আলোচনা এখনও চলছে।

যে ছবি অনুকরণে বানানো হয়েছিল নাসিরুদ্দিন হোজ্জার পাপেটটি

ছবির উৎস,COLLECTED

ছবির ক্যাপশান,যে ছবি অনুকরণে বানানো হয়েছিল নাসিরুদ্দিন হোজ্জার পাপেটটি

জামায়াত আমিরের সাথে তুলনা...

পাপেট নিয়ে যত রকম আলোচনা আছে, তার অন্যতম হচ্ছে অনেকেই এটির সাথে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানের সাদৃশ্য রয়েছে দাবি করেছেন।

কেউ কেউ গোফ-বিহীন নাসিরুদ্দিন হোজ্জা এবং জামায়াত আমিরের চেহারার মিলের কথাও তুলে ধরেছেন।

কিন্তু পাপেটের মূল শিল্পী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়র শিক্ষক অধ্যাপক জাহিদুল হক সে দাবি খারিজ করে দিয়েছেন।

তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, "নাসিরুদ্দিন হোজ্জার পাপেট ক্যারেক্টরটি বানানোর জন্য ছবিটি নেয়া হয়েছিল একটি আরবি বইয়ের প্রচ্ছদ থেকে। প্রচ্ছদের সাথেই নির্মিত ওই পাপেটটির চেহারার অনেক মিল রয়েছে।"

অধ্যাপক হক বলেন, "নাসিরুদ্দিন হোজ্জা ও জামায়াত আমির একই ধরনের ব্যক্তিত্বের লোক না। হয়তো এখানে পোশাকের কারণে এক ধরনের মিল পাওয়া গেছে। এটা এক ধরনের কাকতাল।"

অধ্যাপক হক বিবিসি বাংলাকে আরবি বইয়ের প্রচ্ছদের সেই ছবিটি সরবারহ করেছেন, যার আদলে বানানো হয়েছিল হোজ্জার ওই পাপেটটি।

তিনি বলেন, "গায়ের কালো কোট, লাল জুতা, সাদা পাগড়ি সব ওটার সাথেই যায়। তবে, জামায়াত আমিরের সাথে কিছু মিল পাওয়া গেলেও, সেটি যে ইচ্ছাকৃতভাবে ওনাকে হেয় করার চেষ্টা করা হয়েছে, বিষয়টি একদমই এমন না।"

"একই রকম মনে হলেও বা কাউকে নাসিরুদ্দিন হোজ্জার মতো লাগলেও, সেটি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নেতিবাচক আলোচনার সুযোগ নেই", যোগ করেন তিনি।

উত্তর সিটি করপোরেশনের আয়োজনে ঈদ আনন্দ মিছিল

অধ্যাপক হক বলেন, "আমাদের পরিকল্পনার সময় হাতি ঘোড়াসহ বিভিন্ন কিছু ছিল। কিন্তু আমরা পরে চিন্তা করলাম শিশুদের জন্য কোন কিছু করা যায় কী না। সেই জায়গা থেকে আরব্য রজনী কিংবা বাচ্চাদের প্রিয় কিছু চরিত্র আমরা যুক্ত করতে চেয়েছিলাম"।

সেই চিন্তার জায়গা থেকে আলাদীন, আলী বাবার চল্লিশ চোর, নাসিরুদ্দিন হোজ্জার মতো শিশুদের প্রিয় চরিত্রগুলো ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে বলেও জানান অধ্যাপক হক।

তিনি বলেন, "এটা শুধুই বাচ্চাদের আনন্দ দেয়ার জন্য করা হয়েছে। এখানে বার্তা দেয়ার কোন বিষয় ছিল না"।

তবে অধ্যাক হক বলেছেন, পাপেট তৈরির সার্বিক তত্ত্বাবধানে তিনি থাকলেও প্রতিটি পাপেট তিনি নিজ হাতে বানাননি।

কী বলছে সিটি কর্পোরেশন?

এই আয়োজনটির মূল দায়িত্ব ছিল ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের।

উত্তর সিটির প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ বিবিসি বাংলাকে বলেন, "বাংলা সাহিত্যেও নাসিরুদ্দিন হোজ্জা চরিত্র এসেছে। এটা একটি মেটাফোরিক কারেক্টর। বাচ্চারা এসব পছন্দ করে। যে কারণে এটাকে আমরা তুলে ধরার চেষ্টা করছি"।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় বলছে, এবার ঈদের নানা আয়োজন বাংলাদেশে নতুন এক ইতিহাসের সাক্ষী।

মি. এজাজ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, "পুরো এই আয়োজনটিকে ঢাকাবাসী ইতিবাচকে নিয়েছে। এটাকে ক্রিটিকালি না দেখে ইতিবাচক হিসেবেই নিয়েছে বেশিরভাগ মানুষ।"

তিনি এখানে সমালোচনার সুোগ নেই বলে মন্তব্য করেন।