Image description

পশ্চিমাদের এই সাংঘর্ষিক চিন্তার অবসান না ঘটলে মধ্যপ্রাচ্যকে সামনে দিনগুলোতেও যুদ্ধের নরক যন্ত্রণা ভুগে যেতে হবে।

যুদ্ধবিরতির চুক্তি নিয়ে বিরোধের জেরে মার্চের মাঝামাঝি থেকে ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ উপত্যকা গাজায় হামলা শুরু করেছে ইসরায়েল।

গাজাবাসীর রোজার দিনগুলোকে নরকে পরিণত করেছিল ইসরায়েলের বোমারু বিমানগুলো। গণহত্যার শিকার গাজাবাসীর জন্য ঈদের দিনের হামলা ছিল ‘শেষকৃত্য’।

মাঝে শাসক হামাসের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছে কয়েকশ গাজাবাসী। ২০২৩ সালের অক্টোবরে তাদের সশস্ত্র যোদ্ধারা ইসরায়েলের অভ্যন্তরে হামলা চালিয়ে দুই শতাধিক ইসরায়েলিকে জিম্মি করে।

এর জেরে দেড় বছরের বেশি সময় ধরে চলা ইসরায়েলি আগ্রাসনে এখন পর্যন্ত গাজার ৫০ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হওয়ার তথ্য দিয়েছে মূল ধারার সংবাদমাধ্যমগুলো।

২৬ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ‘প্যালেস্টাইন ক্রনিকল’ এর সম্পাদক র‌্যামজি বরুদ লিখেছেন, এ যুদ্ধ যে প্রচলিত কোনো যুদ্ধ নয়, বরং এটি যে গণহত্যা এবং ঘরের রাজনীতির জন্য পশ্চিমা দেশগুলোর অর্থায়ন ও সমর্থনে ইসরায়েল এই গণহত্যা চালাচ্ছে, সেটা কেউ জোর দিয়ে তুলে ধরছে না।

অন্যদিকে নিশ্চিত ধ্বংস ও নির্মূল হওয়া ঠেকাতে বৈধ কোনো উপায় না থাকায় ফিলিস্তিনিরা প্রতিরোধ করে যাচ্ছে।

 

বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও ডনাল্ড ট্রাম্প-রয়টার্স।

বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও ডনাল্ড ট্রাম্প-রয়টার্স।

 

‘মিডল ইস্ট মনিটর’ এ র‌্যামজি বরুদ লিখেছেন, গণহত্যামূলক এই যুদ্ধ ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও তার জোটের ক্ষমতা রক্ষার লড়াইয়ের সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। আর তার রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য ফিলিস্তিনি জনগণের জীবন দেওয়াকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলোও।

বেদনাদায়ক এই বাস্তবতার সুযোগ নিয়েছেন দুর্বল রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের উগ্র ডানপন্থি ইসরায়েলি জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রী ইতামার বেন-গাভির।

২০২২ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর নেতানিয়াহুর জোট সরকারে যোগ দেন বেন-জিভিয়ার। পরের বছর ৭ অক্টোবর হামাসের হামলা ও জিম্মি করার ঘটনায় গাজায় আগ্রাসন ও গণহত্যা শুরু করে ইসরায়েল। ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি গেলে তিনি সরকার থেকে বেরিয়ে যাবেন, এমন বোঝাপড়া করেই তখন সরকারে থেকে যান বেন-গাভির।

যতদিন গাজার বিভিন্ন শহরে গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চলেছে, ততদিন সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল। অর্থাৎ একটি সভ্য জনগোষ্ঠির ওপর জঘন্য ধ্বংসযজ্ঞ চালানো ছাড়া তার কিংবা নেতানিয়াহুর ‘আশু কোনো পরিকল্পনা’ নেই।

এ বছর ১৯ জানুয়ারি গাজার যুদ্ধবিরতি চুক্তির বিরোধিতা করে বেন গাভির পদত্যাগ করেন। তার সঙ্গে পদত্যাগ করেন আরও দুই মন্ত্রী। যদিও অনেকেই বলছিলেন, এই যুদ্ধবিরতি স্থায়ী হবে না।

১৮ মার্চ আবার যখন ইসরায়েল গাজায় গণহত্যা শুরু করল, বেন-গাভির যথারীতি মন্ত্রিসভায় ফিরে এলেন। টুইট করলেন, “আমাদের সব শক্তি-সামর্থ্য নিয়ে আমরা ফিরে এসেছি।”

গাজায় গণহত্যা চলছে, কারণ ফিলিস্তিনিরা আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকার করেছেন। কিন্তু ইসরায়েলের সামরিক পরিকল্পনাকারীরাও জানেন তারা এই যুদ্ধে সাফল্য পাবেন না। ক্রমবর্ধমান যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে ১৫ মার্চ এক সাক্ষাৎকারে ইসরায়েলের সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোশে ইয়ালুন বলেছেন, “প্রতিশোধ কোনো যুদ্ধ নয়।”

নেতানিয়াহুর যুদ্ধবিরোধী চুক্তি লঙ্ঘনকে সমর্থন করা যুক্তরাষ্ট্রও ভালো করে জানে ইসরায়েলের জোট সরকারে বেন-গাভির ও অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচকে রাখার পরিকল্পনায় রাজনৈতিক লড়াইয়ের জন্যই এ যুদ্ধ।

 

গাজার খান ইউনিসে একটি ইউরোপীয় হাসপাতালে লাশের সারি- রয়টার্স।

গাজার খান ইউনিসে একটি ইউরোপীয় হাসপাতালে লাশের সারি- রয়টার্স।

 

একদা প্রুসিয়ান জেনারেল কার্ল ফন ক্লজবিচ বলেছিলেন, যুদ্ধ হলো রাজনীতির ধারাবাহিকতা। কিন্তু ইসরায়েলের ক্ষেত্রে এটি রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলের যুদ্ধ নয়। বরং তা নেতানিয়াহুর রাজনৈতিকভাবে টিকে থাকার লড়াই। ক্ষমতায় থাকার জন্য নেতানিয়াহু ফিলিস্তিনি শিশুদের কোরবানী দিচ্ছেন, তার মন্ত্রিসভার কট্টরপন্থি সদস্যরাও তাই করছে যেন ডানপন্থি, উগ্র জাতীয়তাবাদী ও ধর্মীয় গোষ্ঠির সমর্থন ও ভোট বাড়ে।

একই যুক্তি খাটে অন্য ‘রাজনৈতিক খেলোয়াড়দের’ ক্ষেত্রেও- ইসলায়েলের গাজা যুদ্ধ প্রতিফলিত করে দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, আদর্শের লড়াই ও শ্রেণি দ্বন্দ্বকে।

ডনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন তার নির্বাচনে আর্থিক অনুদানের প্রতিদান দিতে নেতানিয়াহুকে সমর্থন দিয়েছে। ওয়েস্টমিনিস্টারে রাজনৈতিক পালাবদল ঘটলেও তেল-আবিবের পক্ষেই অবিচল লন্ডন। জনগণের মতামতকে উপেক্ষা করে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েলের স্বার্থকেই সমর্থন দিচ্ছে যুক্তরাজ্য। অন্যদিকে জার্মানি বলছে, তারা অতীতের কৃতকর্মের জন্য অপরাধবোধ করে। আর অন্য পশ্চিমা দেশগুলো মানবাধিকারের বয়ানের সঙ্গে ঠোঁট মিলিয়ে যাচ্ছে, যা তাদের বিদেশ নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

এমন চিত্র জর্জ অরওয়েলের বিভীষিকাময় সেই কাল্পনিক বিশ্বের কথাই মনে করিয়ে দেয় যেখানে ‘যুদ্ধই চিরস্থায়ী’, যেখানে ‘যুদ্ধই শান্তি’, ‘স্বাধীনতাই দাসত্ব’ আর ‘মুর্খতাই শক্তি’।

যদিও ইসরায়েল ‘যুদ্ধকে নিরাপত্তার বিকল্প’ করে নিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রকে আধিপত্যকে ‘স্থিতিশীলতা’ হিসেবে তুলে ধরতে অনুপ্রাণিত, আর ইউরোপ ‘গণতন্ত্রের’ বুলি আওড়েই যাচ্ছে।

বিপরীতে ফিলিস্তিনিরা নিছকই ‘দাবার গুটি’ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তাদের মুত্যু, তাদের প্রতি স্থায়ী অবিচারকে প্রতিহত করার বৈধ কোনো পথ না পেয়ে, একমাত্র বিকল্প হিসেবে তারা প্রতিরোধ করে যাচ্ছে।

অরওয়েলের ব্যাঙ্গাত্মক সেই ‘চিরস্থায়ী যুদ্ধ’ নেতানিয়াহুর পক্ষে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কারণ এমন একটি যুদ্ধ চালিয়ের যাওয়ার মত অফুরন্ত সম্পদ দরকার, যুক্তরাষ্ট্রের উদারতা সত্বেও যা ইসরায়েলের সামর্থ্যে কুলাবে না। এছাড়া যুদ্ধ চালিয়ে নিতে লাগবে অন্তহীন সেনা সরবরাহ করে যাওয়া, কিন্তু ইতোমধ্যে কিছু প্রতিবেদনে ইঙ্গিত মিলছে যে ইসরায়েলি রিজার্ভ বাহিনীর অর্ধেক আর সেনাবাহিনীতে ফিরতে চায় না।

নেতানিয়াহু গাজায় কেবল গণহত্যা চালিয়ে যেতে চান না তিনি সেটাকে ছড়িয়ে দিতে চান। তবে তিনি কিংবা তার মিত্ররা পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারছেন না এই গণহত্যা সম্প্রসারিত হলে তা আঞ্চলিক ও বৈশ্বিকভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

এ বিষয়টি বুঝতে পেরেই আরব নেতারা গাজায় ফিলিস্তিনিদের জাতিগত নিধনের নেতানিয়াহু ও ট্রাম্পের পরিকল্পনা বিকল্প হাজির করতে ৪ মার্চ মিশরের কায়রোতে শীর্ষ সম্মেলনে মিলিত হন। কিন্তু আন্তর্জাতিক ও মানবাধিকার আইন লঙ্ঘন করে গাজায় গণহত্যা চালিয়ে যেতে থাকলেও আরব নেতারা ইসরায়েলকে জবাবদিহির আওতায় আনতে অর্থবহ কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেননি।

যদিও তারা তেমন কোনো পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হন তাহলে মধ্যপ্রাচ্য আরও যুদ্ধ-যন্ত্রণার মুখোমুখি হতে পারে।

পশ্চিমাদের সমস্যা তাদের সাংঘর্ষিক নৈতিকতা। একইসঙ্গে দুই ধরনের ভাবনা দ্বারা তাড়িত তারা। একদিকে মানবাধিকারের কথাও বলছে তারা। অন্যদিকে গণহত্যাকেও সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। পশ্চিমাদের এই সাংঘর্ষিক চিন্তার অবসান না ঘটলে মধ্যপ্রাচ্যকে সামনে দিনগুলোতেও যুদ্ধের নরক যন্ত্রণা ভুগে যেতে হবে।