Image description

বাংলাদেশ ভূমিকম্পের ভয়াবহ ঝুঁকিতে আছে। যে কোনো সময় মারাত্মক ভূমিকম্প হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন বাংলাদেশে ৮ দশমিক ২ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে। তবে এর আংশিকও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে প্রথমবারে ৭ থেকে সাড়ে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে। পরে এর মাত্রা বাড়তে পারে। যেহেতু এ এলাকায় ৮০০ থেকে ১ হাজার বছর ধরে মাটির নিচে থাকা শক্তি বের হয়নি সে ক্ষেত্রে ৭ দশমিক ৫ থেকে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি।

বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ভূমিকম্পে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ঢাকা। যদিও ঢাকা থেকে ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থান দেড় শ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। কিন্তু ঢাকা অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিত নগরী হওয়ায় ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা বেশি। এখানে ভবনগুলো ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশে নির্মিত। রাজউকের তথ্য, ঢাকার ৯৫ শতাংশ ভবনই বিল্ডিং কোড মেনে নির্মাণ করা হয়নি। এগুলো ঝুঁকির মধ্যে আছে। হিসাব বলছে, ভূমিকম্প হলে তাৎক্ষণিক ২ লাখ মানুষ প্রাণ হারাবে। ৫ থেকে ৮ লাখ মানুষ যারা উঁচু ভবনে থাকে তাদের বের হওয়ার রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে। এরা ভবনের ভিতর আটকা পড়বে। ভবনগুলোর বিদ্যুৎ, গ্যাসের লাইন থেকে অগ্নিকাে র মতো দুর্ঘটনা ঘটবে। পানীয় ও স্যুয়ারেজ লাইন এক হয়ে খাবার পানির অভাব হবে। উদ্ধারকারী স্বেচ্ছাসেবক পেতে দেরি হবে। অনেকেই ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর দিকে যাবে। সব মিলিয়ে ঢাকা মৃত্যুপুরীতে পরিণত হবে। সরকার সে অবস্থায় ঢাকাকে পরিত্যক্ত নগরী হিসেবে ঘোষণা করতে বাধ্য হবে। এজন্য ভূমিকম্পের ঝুঁকি কমাতে ঢাকাকে বিকেন্দ্রীকরণ করার পরামর্শ দেয় বিশেষজ্ঞ মহল। দেশের পশ্চিমাঞ্চলে যেখানে ভূমিকম্পের ঝুঁকি কম সেখানে কিছু স্থাপনা সরিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দেয়। স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা হিসেবে ভূমিকম্প নিয়ে নগরবাসীর সচেতনতা বাড়াতে হবে। এজন্য ন্যাচারাল হ্যাজার্ড গেম তৈরি করতে হবে। এতে ভূমিকম্পের করণীয় বিষয়ে তরুণ প্রজন্মের জন্য নির্দেশনা থাকবে। ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক হুমায়ুন আখতার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে গতকাল বলেন, বাংলাদেশে ভূমিকম্পের দুটি বড় উৎসস্থান রয়েছে। একটি ইন্দো-বার্মা সাবডাকশন জোন। এটি সিলেট থেকে টেকনাফের পাহাড়ি অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত। এটি ভূমিকম্পের বড় উৎস। অন্যটি ডাউকি চ্যুতি। যেটি মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। শেরপুর থেকে শুরু করে সিলেটের জকিগঞ্জ পর্যন্ত বিস্তৃত। এখানে অতীতে বড় বড় ভূমিকম্প হয়েছে। আরেকটি উৎস হচ্ছে ফ্রন্টার হিমালয়ানস থ্রাস্ট বেল্ট। এর মধ্যে ইন্দো-বার্মা সাবডাকশন জোন হচ্ছে সবচেয়ে ভয়ংকর। এ জোনকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। একটি হচ্ছে লক জোন; যা বাংলাদেশ অংশের ভিতরে। আরেকটি স্লো স্লিপ জোন। এখানে পাঁচ থেকে ১০ বছর পরপর ভূমিকম্প হয়। এ জোনে ৩ দশমিক ৫ থেকে ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। এখানে বেশি শক্তি ধরে রাখা যায় না। আর আমাদের লক জোনে গত ৮০০ থেকে হাজার বছর শক্তি ধরে রেখেছে। এ শক্তি পরিমাপ করে দেখা যায়, ৮ দশমিক ২ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার শক্তি সেখানে আছে। এ ভূমিকম্প যে কোনো সময় সংঘটিত হতে পারে। এটি একবারেও বের হতে পারে। আবার আংশিক শক্তিও বের হতে পারে। এ ধরনের সাবডাকশন জোনে ৬৫ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত শক্তি একবারে বের হতে পারে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি)-এর সভাপতি এবং নগর পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মদ খান গতকাল বলেন, কয়েক বছর ধরেই দেশে ছোট থেকে মাঝারি ধরনের ভূমিকম্প হচ্ছে। এর কিছু কিছুর উৎপত্তিস্থল ঢাকার কাছাকাছি ছিল; যা থেকে এটি স্পষ্ট যে আমাদের ভূমিকম্পের ঝুঁকি বেশি। এবার মিয়ানমারে যে ভূমিকম্প হয়েছে তা আমাদের থেকে বেশি দূরে না। আমাদের নগরগুলোতে যে ভবন তৈরি করা হচ্ছে তার ৭ মাত্রার ভূমিকম্প মোকাবিলা করার প্রস্তুতি নেই। নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির জন্য যে ভবন তৈরি করা হচ্ছে তার নির্মাণকাজ খুব দুর্বল। এগুলো তদারকি করার জন্য রাষ্ট্রের যে সংস্থাগুলো আছে তাদের কোনো ধরনের প্রস্তুতি নেই। তারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্ল্যানিং পারমিটের জন্য দলিল তৈরি করে। ঢাকার বাইরে যে নগর সম্প্রসারণ হচ্ছে সেখানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে জলাভূমির ওপর ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। দুর্বল মাটির ওপর ভবন নির্মাণ হলে যত ভালোভাবেই তা তৈরি হোক না কেন ভূমিকম্পে সে ভবন ধসে যাবে। নিম্ন আয়ের মানুষ যেখানে থাকে সেখানকার অবস্থাও খুব বেশি ভালো না। আমাদের সরু ভবনগুলোর পাশে অনেক বড় ভবন তৈরি হচ্ছে। এগুলো ধসে পড়লে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের পক্ষে সেখানে যাওয়া সম্ভব হবে না। আবার বিদ্যুৎ-গ্যাস সেবাগুলো নিয়মিত তদারকি না থাকায় ভূমিকম্পে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি বাড়বে।

ফায়ার সার্ভিসের ৯ সতর্কতা : মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের মতো বাংলাদেশেও শক্তিশালী ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও ময়মনসিংহ শক্তিশালী ভূমিকম্পের উচ্চঝুঁকিতে আছে। গতকাল ফায়ার সার্ভিসের সদর দপ্তরের মিডিয়া সেল থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। এরই মধ্যে ভূমিকম্প মোকাবিলার জন্য সকল পর্যায়ে পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ ও সচেতনতা তৈরির জন্য ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর বেশ কিছু ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে। এগুলো হচ্ছে-বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড ২০২০ অনুযায়ী ভূমিকম্প প্রতিরোধী ভবন নির্মাণ করা। ঝুঁকিপূর্ণ ও পুরোনো ভবনগুলোর সংস্কার ও শক্তিশালী করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা। সব বহুতল ও বাণিজ্যিক ভবনে অগ্নিপ্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদার করা। ইউটিলিটি সার্ভিসসমূহ যেমন গ্যাস, পানি ও বিদ্যুতের লাইন ঠিক আছে কি না নিশ্চিত করা। ভূমিকম্প চলাকালে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি পর্যায়ে বিভিন্ন করণীয় সম্পর্কে নিয়মিত মহড়া অনুশীলন ও প্রচারের ব্যবস্থা করা। জরুরি টেলিফোন নম্বর যেমন ফায়ার সার্ভিস, অ্যাম্বুলেন্স, পুলিশ, হাসপাতাল, অন্যান্য জরুরি নম্বরসমূহ ব্যক্তিগত পর্যায়ের পাশাপাশি সব ভবন বা স্থাপনায় সংরক্ষণ করা এবং তা দৃশ্যমান স্থানে লিখে রাখা। ভলান্টিয়ার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে দুর্যোগের সময় কার্যকর ভূমিকা রাখা। প্রয়োজনীয় ব্যবহার্য সরঞ্জামাদি যেমন টর্চলাইট, রেডিও (অতিরিক্ত ব্যাটারিসহ) বাঁশি, হ্যামার, হেলমেট/কুশন, শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানি, প্রয়োজনীয় ওষুধসামগ্রী, ফার্স্ট এইড বক্স, শিশু যত্নের সামগ্রী ইত্যাদি বাসাবাড়িতে নির্ধারিত স্থানে সংরক্ষণ করা যাতে ভূমিকম্প-পরবর্তীতে আটকা পড়লে তা ব্যবহার করে বেঁচে থাকার চেষ্টা করা যায়। সকল পর্যায়ে তদারকি সংস্থার কার্যক্রমে সহযোগিতা করা।