
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে চট্টগ্রামে প্রথম শহিদ ছাত্রদল নেতা ওয়াসিম আকরাম। যুবলীগ ও বর্তমানে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের আক্রমণে নির্মমভাবে প্রাণ হারান টগবগে এই তরুণ।
ছেলেকে হারিয়ে সেই যে অসুস্থ হয়ে শয্যা নিয়েছেন মমতাময়ী মা, এখনো স্থির হতে পারেননি। বাবার দিন কাটে সন্তানের জন্য আর্তনাদে। এর মাঝেই এসেছে আনন্দের ঈদ, কিন্তু ওয়াসিমের পরিবারে তো কাটেনি বিষাদের ছায়া। সন্তান হারানোর যন্ত্রণা নিয়েই ঈদের দিনটি পার করছেন ওয়াসিমের বাবা-মাসহ পরিবারের সদস্যরা।
ওয়াসিম আকরাম চট্টগ্রাম কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। ছাত্রদল নেতা ওয়াসিম গত বছরের ১৬ জুলাই বিকেলে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিতে গিয়ে নগরীর মুরাদপুরে ছাত্রলীগ-যুবলীগের সন্ত্রাসীদের হামলায় নিহত হন। তিনি চট্টগ্রাম কলেজ শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন। এছাড়া তার বাড়ি পেকুয়া উপজেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ছিলেন।
তাদের বাড়ি কক্সবাজার জেলার পেকুয়া উপজেলার সদর ইউনিয়নের দক্ষিণ মেহেরনামা গ্রামে। বাবা শফি আলম ছিলেন প্রবাসী। ছেলের মৃত্যুর খবর পেয়ে এক মাস ১৭ দিন পর দেশে ফিরে আসেন। সন্তানের বিয়োগব্যাথায় কাতর শফি আর ফিরতে পারেননি বিদেশের কর্মস্থলে। ওয়াসিমের আরও এক ভাই এবং তিন বোন আছেন।
শফি আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘একটি গাড়ির চারটি চাকা থাকে। একটি চাকা নষ্ট হয়ে গেলে গাড়ি অচল। আমারও পাঁচ সন্তানের মধ্যে একটি সন্তান চলে গেছে। আমিও অচল হয়ে গেছি। কীভাবে আর বিদেশে যাব ! আমার স্ত্রী অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী। বিছানা ছেড়ে উঠতে পারে না। ভাই হারানোর যন্ত্রণা আমার অন্য সন্তানদের মধ্যে। কেউ আমাকে ছাড়তে চায় না। বাকি জীবনটা তাদের বুকে আগলে রেখেই কাটিয়ে দিতে চাই।’
ঈদের দিনে নামাজ আদায়ের পর ছেলের কবর জেয়ারত করেছেন শফি। ছেলে ওয়াসিমের জন্য আল্লাহর দরবারে দু’হাত তুলে দোয়া করেছেন। ওয়াসিমের পাশেই তার দাদা-দাদির কবর। কান্নাজড়িত কণ্ঠে শফি আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ যে কত ভারী, সেটা যে সন্তান হারিয়েছে শুধু সে-ই বুঝবে। মা হারিয়েছি, দুই মাস পর ছেলেকেও হারিয়েছি। আমার ভালো থাকার সুযোগ নেই। আমার আনন্দ করারও সুযোগ নেই।’
তিনি জানান, পড়ালেখার জন্য চট্টগ্রাম শহরে থাকলেও ঈদুল ফিতর-ঈদুল আযহায় আগেভাগেই বাড়িতে চলে যেতেন ওয়াসিম। নিজের সাধ্যে যতটুকু কুলোয়, নিজের ভাইবোন, চাচাতো-ফুপাতো ভাইবোনদের সবাইকে পছন্দের পোশাক কিনে দিতেন। তাদের কাছে ওয়াসিম ছিলেন প্রিয় ‘মেঝ ভাই’। সেই মেঝ ভাইকে হারিয়ে তাদের কাছেও ঈদের আনন্দ ফিকে হয়ে গেছে।
‘আমার নিজের ভাই, চাচাতো ভাইয়েরা মিলে আমাদের অনেক বড় পরিবার। ওয়াসিম ছিল ভাইবোনদের কাছে অনেক আদরের। প্রতি ঈদে ওয়াসিম তাদের জামা-জুতা কিনে দিত, কাউকে আবার খরচের টাকা দিত। সে তো আর বেশি ইনকাম করতো না, যতটুকু সাধ্য ছিল ততটুকু দিত। শুধু আমাদের ফ্যামিলি না, গ্রামের লোকজনের কাছেও অনেক আদরের ছিল। সবাই তার জন্য দুঃখ করছে,’ – বলেন শফি আলম।
উল্লেখ্য, অভ্যুত্থানে নিহত ওয়াসিম আকরামের নামে চট্টগ্রাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নামকরণ করেছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)।
সারাবাংলা