
গত ঈদে যে স্বজনরা অপেক্ষা করেছিল তাদের প্রিয়জনের বাড়ি ফেরার, এবার তাদের সেই প্রিয়জন অনেকেই নেই। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ঘটেছে দেশের ইতিহাসে অভূতপূর্ব রাজনৈতিক পটপরিবর্তন। শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে গণঅভ্যুত্থান, ৩০ দিনের রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের পর অবসান হয় শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসন। শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবি আদায়ের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে সরকারের নির্দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠন ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতাকর্মীদের নির্বিচার গুলিতে ঝরে যায় প্রায় দেড় সহস্রাধিক তাজা প্রাণ। আহত হন প্রায় ৩০ হাজার ছাত্র-জনতা।
পুরুষের পাশাপাশি গণঅভ্যুত্থানে নারীর অংশগ্রহণ ছিল ব্যাপক। ১০ জন নারী শহীদকে শনাক্ত করতে পেরেছে দ্য ডেইলি স্টার। তাদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেছি আমরা। তাদের কেউ মা হারিয়েছেন, কেউ বোন, কেউ মেয়ে কেউবা স্ত্রী। জানার চেষ্টা করেছি, স্বজন হারানো পরিবারগুলোর কেমন কাটছে দিন? গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী প্রথম ঈদ কীভাবে হাজির হয়েছে তাদের সামনে?
শাহিনূর বেগমের মেয়ে মোসাম্মত হাফেজা বলেন, 'মায়ের মরনের লগে আমাগো ঈদ শেষ হয়ে গেছে। আমাগো পাঁচ ভাই-বোনের ভেতরটা ফাইট্টা যায়, কাউরে কইতে পারি না কষ্টটা। টাকা পামু (পাব), মারে তো আর পামু না। টাকা দিয়া কী হইবো! আজীবনের লাই মারে আর চোখে দেখমু না। গতবার মার লগে বসি একলগে (একসঙ্গে) ইফতার করছি, এবার মা নাই। এবারগা (এবার) ইফতার মুখে দিলেই মার কথা মনে ওঠছে; আর গলা দিয়ে ইফতারি নামে না।'
'আগে কোনো কিছুর টান পরলে মা কইতো, আমি তোগো মা, তোগো বাপ। তোগোরে কষ্টে রাখমু না। ঈদে যেমনেই হোক মা আমাগো সব ভাই-বোনরে নতুন জামা কিন্না দিতো। এবার মা নাই, বড় বোন হিসেবে আমার কাঁধে তাগো দায়িত্ব। আমি তাগো (ভাই-বোনদের) মুখের দিকে চাইয়্যা থাকি। কিছু কিন্না দেয়ার অবস্থা নাই। মাইনষের ঈদ থাকলেও আমাগো ঈদ নাই। মার লগে ঈদ শেষ। বাপ থাকিও নাই!'
নাঈমা সুলতানার মা আইনুন নাহার বলেন, 'বড় মেয়েটা শান্তশিষ্ট, নাঈমা ছিল চঞ্চল। পুরো বাসা মাতিয়ে রাখতো। এখন মনে হয় বাসায় কোনো মানুষ নেই, কবরস্থান। সারাদিন কাঁদি। কিছু করতে বসলেই মেয়ের কথা মনে হয়, আর কাজ করতে পারি না।'
'গত রমজানে দুই মেয়েকে নিয়ে একসঙ্গে তারাবি পড়তাম। ও বলতো, "আম্মু তুমি আমাকে ছাড়া নামাজ পড়ো না। আমরা একসঙ্গে পড়ব।" আমি ইফতারি বানানোর সময় কিছুক্ষণ পর পর এসে দেখে যেত, কী বানাচ্ছি। আম্মু, আজকে এটা বানাও, কালকে ওইটা। একেকদিন একেক নতুন আইটেম বানাতে বলতো। কিন্তু এবার রান্নাঘরে এসে কেউ বলেনি, আম্মু এটা বানাও, ওইটা বানাও।'
'কয়েক রোজা গেলেই নতুন জামাকাপড় কেনার জন্য অস্থির হয়ে যেত। সবসময় মেয়ের আবদার পূরণ করতে চেষ্টা করতাম। আমরা যৌথ পরিবারে ওর দাদার বাড়িতে একসঙ্গে ঈদ করতাম। গ্রামে সবাই অপেক্ষা করতো, কত রোজায় বাড়ি যাব। এবার সেই আনন্দ নেই।'
'রাতে ঘুম হয় না। ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখি মেয়েকে। ওই রাতে আর ঘুম আসে না। মেয়ের জন্য কাঁদতে কাঁদতে এখন আমি অসুস্থ হয়ে পরছি। মানসিক ডাক্তারের চিকিৎসা নিচ্ছি।'
'পড়ালেখায় ভালো ছিল আমার মেয়েটা, ক্লাসে সবসময় ওর রোল এক ছিল। ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছে ছিল তার। রাত জেগে পড়তো। আমি কিছুক্ষণ পর পর পড়ার টেবিলে গিয়ে নাস্তা বানিয়ে দিতাম। তাকে দিয়ে কোনো কাজ করতে দিতাম না, যাতে পড়ালেখায় কোনো অসুবিধা না হয়। এখন তার পড়ার টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াই থাকি। কেউ বলার নেই, আম্মু কী আনছো!'
মোসাম্মত লিজার ভাই মোহাম্মদ রাকিব বলেন, 'আগে ঈদ ঘনিয়ে আসলে আব্বা-আম্মা ফোন দিয়ে বলতো, লিজারে বাড়িতে নিয়ে যাইতে। এবার আর কেউ বলে না। আমারেও বোনকে আনতে ঢাকায় যেতে হচ্ছে না। কোনো কোনো ঈদে লিজা আসতো না, যে বাসায় কাজ করতো। ওই পরিবারটা সন্তানের মতো আদর-যত্নে রাখতো, তাদের সঙ্গে মাঝেমধ্যে ঈদ করতো। যেবার বাড়িতে আসতো, সবার মধ্যে আনন্দ থাকতো। ভাই-বোন সবাই মিলে ঈদে আনন্দ করতাম। এবার আমার বোনটা নেই। সবার ঈদে আনন্দ থাকলেও আমাদের নেই।'
'বোনটা কুরআন শরিফ পড়তো। তখন কুরআনে মুখস্ত (হাফেজা) হওয়ার আর তিন মাসের লাগতো বলছিল। বেঁচে থাকলে এবার ঈদে কুরআন মুখস্থ করে বাড়িতে যেত। কথা ছিল কুরআন পড়া (হাফেজা) হয়ে গেলে ওই বাসা থেকে একবারে বিদায় নিয়ে চলে যাবে বাড়িতে। বিয়েসাদীর কথাও আব্বা-আম্মা চিন্তা করে রাখছিল। সবকিছু আজ স্বপ্ন। গত আট মাসে আব্বা-আম্মা তার কথা ভেবে ভেবে অসুস্থ হয়ে পরছে।'
নাছিমা আক্তারের বোন কহিনূর হোসেন বলেন, 'যখন আমি থাকবো না, এরকম কেরুম (কী রকম) একটা গান আছে না? ওইটা দিয়ে টিকটক বানাইতো। ও ছোটবেলা তুন (থেকে) এইয়ে একরকম (অন্য রকম) ছিল, আমরা বোনরা দুষ্টামি করলে তখন টিকটকে এটা দেখাইতো, তখন আমরা তারে নিয়ে হাইসতাম (হাসতাম)। আর এখন ঠিকই ওইগুলো মনে পড়লে কাঁদি। সত্যিই হয়ে গেল। বিশ্বাস করতে পারি না আমার বোনটা নাই। মনে হয় এ রুম, ওই রুমে ও হাঁটে। আমাদের তো বিয়ে হয়ে গেছে, জামাইয়ের পরিবার নিয়ে ব্যস্ত থাকি। কিন্তু আমার মার কষ্ট বেশি। মাকে ও দেখিশুনি (দেখেশুনে) রাইখতো। মা ওর কথা মনে করে করে কাঁদে।'
'ঈদে চাঁদে ভাই-বোন সবাই একসাথ হইলে কত আনন্দফূর্তি হতো। হাসিঠাট্টা করতাম। বেশিরভাগ হাসিঠাট্টা ওকে নিয়ে হইতো। এবার ও নাই। কারে নিয়ে আমরা হাসিঠাট্টা করমু। বোনের কথা মনে পড়লে খাওন গলা দিয়ে ঢুকে না। ওর বিয়েও ঠিক হইছিল, কদিন পর বিয়ে হইতো। বোনের কথা মনে পড়লে কান্না আসে।'
রিতা আকতারের মা রেহেনা বিবি বলেন, 'অসুখে-বিসুখে কম বয়সে অনেকরে আল্লা নিয়ে যায়। কিন্তু এভাবে মেয়ে মারা যাবে মানতি (মানতে) পারি না। মেয়ে শেষ সময় কত কষ্ট পাইয়ে (পেয়ে) মারা গেছে, আমি মা, কীভাবে ধৈর্য ধরে ছিলাম, সেটা আপনাদের বলার মতো কথা পাচ্ছি না। গুলি লাগার পর তার হাত-পা সব ছাইড়্যা দিছে। শুধু চোখের পাতাটা মেলে তাকাই ছিল। দু-তিন ঘণ্টা কষ্ট পেয়ে মারা গেছে। রক্ত ঝরতে ঝরতে লাশ দাফন পর্যন্ত আর কোনো রক্ত তার শরীরে ছিল না!'
'ঈদে ছেলে-মেয়ারা আমার কাছে (ঢাকা মিরপুরে) আসতো ঈদ করতি (করতে)। এবার ঈদ-রোযা নাই। মেয়ের লাশের সাথে আমিও একবারে বাড়িতে চলে গেলাম। মেয়ের রক্তাক্ত ছবিগুলোর দিকে তাকাই, বেশিক্ষণ তাকাইতে পারি না। হৃদয়টা ফাইট্যা যায়। মানুষজন আসে, সান্ত্বনা দেয়, "আপনি শহীদের মা। ও আপনার গর্ব, দেশের মানুষের ভালোর জন্য জীবন দিছে।" কিন্তু আমি মা, আমার মনের কষ্ট কারে বলিব! আমি জানি কী হারাইছি।'
'ডাক্তার বানানির (বানানোর) লাগি শহরে পড়ালেহা করাইতে নিয়ে গেছি। অল্প কয় মাসে ফিরছি লাশ নিয়ে। আমি বিয়া দিতে চাইছি। আমারে বলতো, "মা তুমি আমারে বিয়া দিও না। কিচ্ছু লাগবে না, আমারে শুধু দুইবেলা খাওয়াইও, আমি নিজে পড়ালেখা করে ডাক্তার হবো।" মেয়ের জন্য আমি বাঁইচ্যা ছিলাম। ইসলামে আছে মরার জন্য বলা যায় না। আল্লার কাছে বলি, যতদিন বাঁইচ্যা থাকি, বুকে একটু শান্তি দিক। বুকটা ছটফট করে।'
মেহেরুন নেছার মা আসমা আক্তার বলেন, 'আমার মেয়ে পড়ালেখার পাশাপাশি কাজ করতো। ঈদে নিজের টাকায় আমাদের জামা-কাপড় কিনে দিতো। এবার মেয়ে নাই, কোনো আনন্দও নাই আমাদের। ইফতারে ও ঈদে মেয়ের পছন্দের খাবার রান্না করে রাখতাম। এবার খাবার খাওয়ার লোক নাই। ইফতার করতে বসলে মেয়ের কথা মনে হয়, আর গলা দিয়ে খাবার ঢুকে না। ছেলে সান্ত্বনা দেয়, কিন্তু মেয়ের কথা মনে হলে আর আমার দিশ (হুশ) থাকে না। সব ভুলে যাই।'
'কী দোষ ছিল আমার মেয়েটার? সেতো কোনো অন্যায় করে নাই। আমার ভাইয়ের রাজপুত্রের মতো ছেলেকে পেটে গুলি করে মারা হইছে। লাশ আনতে দেয় নাই, তিনদিন আটকায়ে লাশ পচায় (পচিয়ে) ফেলছে। যে পরিবারে দুই সন্তান মারা গেছে, সেখানে ঈদ-রোজা, কিচ্ছু নাই। আমি এ খুনীদের বিচার দেখতে চাই। বাকী জীবন আমি কিভাবে বাঁচব! মেয়ের কথা মনে করে করে আমার ঘুম নাই, খাওয়া নাই। ঈদ আসছে, আমার পরিবারে কোনো আনন্দ নাই। আমার ছেলের ভেতরও কোনো আনন্দ নাই। ওইদিন আমি আল্লার কাছে দোয়া করছিলাম, আল্লা মেয়েটা ঘরে আইস্যা পৌঁছাইছে, ছেলেটাও যেন ঠিকমতো পৌঁছায়। এরপরেই মেয়েটার গায়ে গুলি লাগে।'
নাফিসা হোসেন মারওয়ার বাবা আবুল হোসেন বলেন, 'মেয়ে আমার কাছে থেকে পড়ালেখা করতো তাকে নিয়ে চিন্তায় থাকতাম, এখন মেয়ে নাই আমার কষ্ট বেড়ে গেছে। দোকানে বসি, মনে হয় মেয়ের কথা। পুলিশ প্রথমে মামলা নিতে চায় নাই। পরে মামলা নিছে। যাদের নামে মামলা দিছি তারা এখনও হুমকি-ধামকি দেয়। সন্তানহারা কোনো বাবা-মার ঈদে আনন্দ-খুশি নাই। খুনিদের বিচার হলে, সেদিন আমরা শান্তি পাব। মেয়ে আন্দোলন যাইতো আমি জানতাম না, একদিন জানার পর অনেক বকলাম। চুপচাপ ছিল, আমারে কিছু বলে নাই। কিন্তু তারপরও তাকে আন্দোলনে যাওয়া থেকে আটকাইতে পারি নাই।'
সুমাইয়া আক্তারের মা আসমা বেগম বলেন, 'বাচ্চারা মায়ের কত যত্নে বড় হয়! আর আমার ছোট্ট নাতিটা মায়ের বুকের দুধও পেল না। অল্প বয়সে মেয়ে মারা গেছে, আড়াই মাস বয়স নাতিটার। এ বাচ্চাকে আমি কীভাবে বড় করব! এতিম নাতি আমার। আমি মা (বাচ্চার নানী) কয়দিন থাকমু, আমার শরীরের অবস্থাও ভালা (ভালো) না। সকালবেলা নাতিটা ঘুম থেকে ওঠলে সবার মুখের দিকে চাইয়্যা তাকায়। মা-বাপ খুঁজে। তখন আমার বুকটা ফেটে যায়! আমি কত চেষ্টা করি এ নাতিরে কিছু খাইয়াইতে, পারি না। ঠিকরকম (ঠিকমতে) ঘুমায় না নাতিটা, কান্নাকাটি করে। আমার রোজা, ইফতার, ঈদ কিছুই নাই। সব শেষ।'
'ওদের (সুমাইয়া আক্তারের) বাপ মারা যাওয়ার পর আমি কত কষ্ট করে ছেলে-মেয়েগুলোরে নিয়ে আছি। এখন এই ছোট্ট নাতির ভারও আমার কাঁধে। মা-ছাড়া এতিম বাচ্চাটা কীভাবে বড় হবে! মেয়ের মৃত্যুর পর স্বামী কোনো খোঁজ-খবর নিচ্ছে না। বাচ্চাটারও কোনো খবর নেয় না৷ আমি চাই সরকার আমার এই এতিম নাতির দায়িত্ব নিক।'
মায়া ইসলামের স্বামী মাহবুব ইসলাম বলেন, 'নাতিকে ভালো চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর নেওয়া হয়েছে। ছেলে ওইখানে। উনিও (মায়া ইসলাম) চলে গেলেন। আমার পরিবারটা শেষ হয়ে গেল। বলেন, আমাদের ঈদ থাকতে পারে?'
'আমরা প্রথমে জানতে পারি নাই উনার (মায়া ইসলাম) গায়ে যে গুলি লাগছে। জানতাম নাতির গায়ে গুলি লাগছে। হয়তো নাতিকে হসপিটাল নিয়ে গেছে। ৫-৬ ঘণ্টা পর খবর পেয়ে আমরা মেডিকেলে ছুটে গিয়ে দেখি এ অবস্থা। ডাক্তার চিকিৎসা করাইছে। বলল, সুস্থ হয়ে যাবে, আপনারা বাড়িতে নিয়ে যান। এর পরদিনই অবস্থা খারাপ হতে থাকলে ঢাকা মেডিকেল নিয়ে যাই। সেখানেই মারা যান।'
'পরিবার উনি দেখেশুনে রাখতেন। এখন বাসাটা খা খা। ছেলের ইলেকট্রনিক্স দোকানে সময় দেই। ছেলে তো নাতির কাছে সিঙ্গাপুরে। এভাবে দিনপতি কাটছে। একটা রোযার মাস গেল, ইফতার-সেহেরি খাইতে বসি, ঠিকমতো কিছু খাইতে পারি নাই। কীভাবে খাই, সংসার তছনছ হয়ে গেল। আমার কেমন থাকতে পারি?'