Image description

বাংলাদেশে আমলা, পুলিশ ও বিচারকদের অনেকের বিরুদ্ধে ওঠা অনিয়ম, দুর্নীতির অভিযোগের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছে অন্তর্বর্তী সরকার। তবে অভিযোগ উঠেছে এমন কর্মকর্তা ও বিচারকদের কেউ কেউ অবসর চেয়ে আবেদন করেছেন।

দুর্নীতি বা অনিয়মের অভিযোগ ওঠার পর কাউকে অবসরে পাঠানো হলে তাতে অপরাধ জিইয়ে রাখা হয় বলে মনে করেন বিশ্লেষকদের অনেকে।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর প্রশাসন ও পুলিশে ব্যাপক রদবদল করা হয়েছে। সেই অভ্যুত্থানের পর পরই বিচার বিভাগ থেকে সরে যেতে হয়েছে সাবেক প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের বিচারকদের। হাইকোর্ট বিভাগের কয়েকজন বিচারপতিও পদত্যাগ করেছেন।

এরই মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার দুর্নীতির সাথে সম্পৃক্ত সরকারি কর্মকর্তা - কর্মচারীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়ে একটি চিঠি জারি করেছে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জারি করা চিঠিটি সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দপ্তরের মহাপরিচালক, নির্বাহী পরিচালক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও চেয়ারম্যান এবং বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক ও ম্যাজিস্ট্রেটদের কাছে পাঠানো হয়েছে গত রোববার (২৩শে মার্চ) ।

চিঠিতে বলা হয়েছে, "মন্ত্রণালয়-বিভাগ এবং আওতাধীন দপ্তরে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে যাদের বিষয়ে জনমনে দুর্নীতিবাজ হিসেবে ব্যাপক ধারণা রয়েছে। গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।"

প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীর কর্মকর্তাদের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো, ঐচ্ছিক অবসর নেওয়া এবং ওএসডি করে রাখার মতো বিভাগীয় পদক্ষেপের নজির উল্লেখযোগ্য।

এর থেকে বাদ যায়নি বিচার বিভাগও।

নানা অভিযোগের মুখে আপিল বিভাগ ছাড়াও হাইকোর্টের বেশ কয়েকজন বিচারপতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে কর্তৃপক্ষ বলছে।

এছাড়া সর্বশেষ আইন মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন শাখার সাবেক যুগ্ম সচিব বিকাশ কুমার সাহা, ঢাকার সাবেক মুখ্য মহানগর হাকিম এবং অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিমকে আর্থিক দুর্নীতি, অসদাচরণ এবং অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে।

এরই মধ্যে ওই নোটিশ পাওয়ার পরপরই চাকরি থেকে ঐচ্ছিক অবসর গ্রহণের আবেদন করেছেন বিকাশ কুমার সাহা।

একই ঘটনা ঘটেছিলো জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য মতিউর রহমানের ক্ষেত্রেও।

ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ ওঠার পর স্বেচ্ছা অবসরের আবেদন করলে তা গ্রহণ করে এনবিআর।

আইন অনুযায়ী সরকারি কর্মকর্তারা অবসরের আবেদন করলেও অভিযোগ ওঠার পরে এ ধরনের আবেদন নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে।

সরকারি কর্মকর্তা - কর্মচারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে সেগুলোর বিষয়ে তদন্ত না করে অবসরে পাঠানো, বদলী করা বা ওএসডি করা হলে অপরাধকেই জিইয়ে রাখা হয় বলে প্রশ্ন উঠেছে।

অভিযুক্ত ব্যক্তিরা কারণ দর্শানোর নোটিশের জবাব দিয়েছেন কী না এবং তাদের বিষয়ে পদক্ষেপ জানতে চাইলে আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব শেখ আবু তাহের বিবিসি বাংলাকে বলেন, " তাদের বিষয়ে বিভাগীয় কার্যক্রম চলমান রয়েছে।"

তবে বিস্তারিত কোন কিছু বলতে অস্বীকৃতি জানান এই সরকারি আমলা।

অভিযুক্ত ব্যক্তিদের অবস্থান জানতে চেয়ে দুই জনকে বিবিসি বাংলার পক্ষ থেকে ফোন করা হলে রিসিভ করেননি তারা।

নাম ও পরিচয় উল্লেখ করে খুদে বার্তা পাঠানো হলেও তার কোনো জবাব দেননি তারা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রশাসন, পুলিশ ও বিচার বিভাগের দুর্নীতি, অপশাসনের যে অভিযোগ উঠেছে, সেটার অন্যতম কারণ দলীয় রাজনীতির প্রভাব।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বিবিসি বাংলাকে বলেন, " শুধু গত ১৫ বছরে দলীয় রাজনৈতিক প্রভাব হয়েছে তা নয়, বরং এটি দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। তাই বিচার বিভাগের সহজে এই অবস্থা থেকে উত্তরণ করা সম্ভব নয়। তবে যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, সেটিকে আরও ত্বরান্বিত করতে হবে।"

সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে সেগুলোর তদন্ত করা উচিত উল্লেখ করে মি. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, " একটি সুনির্দিষ্ট ঘটনার ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তি আবেদন করেছেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের যথাযথ তদন্ত সাপেক্ষে বিচার নিশ্চিত হওয়ার আগে পর্যন্ত এই অবসরের আবেদন বিবেচনাযোগ্য নয় বলে আমি মনে করি। "

দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তির প্রতীকী ছবি

ছবির উৎস,Getty Images

ছবির ক্যাপশান,ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে দুর্নীতির যেসব জরিপ করেছে, তাতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হারই বেশি।

বিচার বিভাগ সংস্কারের প্রেক্ষাপট

শেখ হাসিনার পতনের পরে তার আমলে নিয়োগ পাওয়া হাইকোর্টের আরও অন্তত ৩০ জন বিচারপতির পদত্যাগ দাবি করে প্রধান বিচারপতির কাছে তাদের নাম ও অভিযোগ সংবলিত তালিকা জমা দেয় আন্দোলনকারী আইনজীবীরা।

আন্দোলনকারী আইনজীবীদের নেতা সুপ্রিম কোর্ট সংবিধান সংরক্ষণ কমিটির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মামুন মাহবুব সে সময় বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, " সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল সময়ের ব্যাপার, ফলে এতো সময় দিলে বিচার বিভাগের সংস্কারের কাজ থেমে যাবে।"

এসব বিচারপতিদের বিরুদ্ধে 'ফ্যাসিস্ট সরকারের ফরমায়েশে ফরমায়েশি রায় দেওয়া', 'সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী বিচার কার্য পরিচালনা করা' এবং 'দুর্নীতির' অভিযোগ করেছেন আইনজীবীরা।

আন্দোলনে সম্পৃক্ত আইনজীবীদের বিচার বিভাগে সংস্কারের আগে এই বিচারপতিদের পদত্যাগ দাবি করেছিলেন।

আইনজীবীদের আন্দোলনের এক পর্যায়ে গত বছরের ২০শে অক্টোবর থেকে হাইকোর্ট বিভাগের বার জন বিচারপতিকে বিচার কাজ থেকে বিরত রাখা হয়।

এরই মধ্যে ওই ১২ জনের মধ্যে দুইজন অবসরে গেছেন, একজন পদত্যাগ করেছেন এবং একজনকে অপসারণ করা হয়েছে। আরও দুইজনের মেয়াদ শেষ হওয়ায় বিদায় নিয়েছেন।

বাকি ছয় জনের মধ্যে বিচারপতি মো. আখতারুজ্জামানের বিষয়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে তদন্তের নির্দেশনা দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি।

বিচারপতিদের অপসারণ সংক্রান্ত ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় বহালের পর গত বছরের সাতই নভেম্বর সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন।

উচ্চ আদালতের কোন বিচারকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তদন্ত বা যাচাই - বাছাই করবে এই কাউন্সিল।

অভিযোগের ব্যাখ্যা তলবের মুখে অবসরের আবেদন?

ঘুষ হিসেবে অগ্রিম ৪০ লাখ টাকা গ্রহণের অভিযোগে বর্তমানে ওএসডি কর্মকর্তা (সিনিয়র জেলা জজ) বিকাশ কুমার সাহার কাছে লিখিত ব্যাখ্যা তলব করেছে আইন মন্ত্রণালয়।

১৫ দিনের মধ্যে এই ব্যাখ্যা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এ নোটিশে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পর্কে বলা হয়েছে, আইন ও বিচার বিভাগে যুগ্ম সচিব (প্রশাসন ১) হিসেবে কর্মরত থাকাকালে অভিযোগকারী মো. জাফর আহমেদসহ কয়েকজনকে চট্টগ্রাম জেলা জজ আদালত ও জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থায় শূন্য পদে চাকরির আশ্বাস দিয়ে অগ্রিম ৪০ লাখ টাকা নিয়েছেন।

কিন্তু পরে ওই চাকরি প্রার্থীদের চাকরি না দিয়ে ওই টাকা আত্মসাৎ করেন বিকাশ কুমার সাহা।

একইসাথে যারা টাকা দিয়েছেন, তারা ওই টাকা ফেরত চাইলে পদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে তাদের মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেওয়ার ভয় দেখানো হয় বলে ওই নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে।

এ ধরনের কাজ অনাকাঙ্ক্ষিত, অবিচারকসুলভ বলে উল্লেখ করা হয়েছে চিঠিতে।

এতে বলা হয়েছে, একজন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তার জন্য এ কাজ অপ্রত্যাশিত ও দুর্নীতিমূলক কাজ হিসেবে গণ্য হয়।

একইসাথে এটি বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস (শৃঙ্খলা) বিধিমালা ২০১৭ অনুযায়ী অসদাচরণ ও দুর্নীতিমূলক কাজের অন্তর্ভূক্ত ও অপরাধ হিসেবে বিবেচিত।

ওই চিঠি পাওয়ার পরই গত ১০ই মার্চ আইন মন্ত্রণালয়ে ঐচ্ছিক অবসরের আবেদন করেন মি. সাহা।

কিন্তু আবেদনটি ই-মেইলে পাঠান তিনি।

এই আবেদনে মি. সাহা লিখেছেন, ১৯৯৪ সালের ২৫শে এপ্রিল সহকারী জজ পদে যোগদান করে নিয়মিত পদোন্নতি প্রাপ্ত হয়ে বর্তমানে আইন মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগে সংযুক্ত কর্মকর্তা (সিনিয়র জেলা জজ) হিসেবে কর্মরত আছেন তিনি।

বর্তমানে চাকরির সময় ২৫ বছরের বেশি হয়েছে উল্লেখ করে ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে মি. সাহা আগামী ১০ই এপ্রিল চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের আবেদন করেছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আইন মন্ত্রণালয়ের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বিবিসি বাংলাকে বলেন, "সরকারি চাকরিতে ই-মেইলে এভাবে অবসরের চিঠি দেওয়াটা একটা বিরল ঘটনা। এটাতো একটা সন্দেহের বিষয় যে ওই স্বাক্ষর আসলেই তার করা কিনা।"

এ বিষয়ে কথা বলতে মি. সাহার মোবাইলে ফোন করলেও রিসিভ করেননি তিনি।

টাকা

ছবির উৎস,Getty Images

আদালতে সজীব ওয়াজেদ জয়কে বরণ

ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়কে হত্যাচেষ্টা মামলায় সাক্ষ্য দিতে তিনি যখন ঢাকার বিচারিক আদালতের তৎকালীন অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে যান, সে সময় তাকে অভ্যর্থনা জানান সাবেক মুখ্য মহানগর হাকিম রেজাউল করিম চৌধুরী এবং সাবেক অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান নুর।

অফিস সময়ে বিচারিক দায়িত্ব পালনে অবহেলার অভিযোগ আনা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।

এই অভিযোগে বলা হয়েছে, সে সময় মামলায় অভিযোগের সাক্ষী হিসেবে মি. জয় আদালতের এলাকায় পৌঁছার সাথে সাথে তৎকালীন সিএমএম রেজাউল করিম চৌধুরী এবং অতিরিক্ত সিএমএম মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান নুর তাকে এগিয়ে আনতে খাসকামড়া থেকে বের হয়ে তার গাড়ির কাছে যান।

মি. জয়কে অভ্যর্থনা জানান ওই দুই বিচারক এবং তার সাক্ষ্য দেওয়া শেষে যাওয়ার সময়ও তাকে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে আসেন তারা।

আইন মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে ওই দুই বিচারকের কাছে লিখিত ব্যাখ্যা তলব করেছে।

মন্ত্রণালয়ের নোটিশে বলা হয়েছে, " অফিস সময়ে দাপ্তরিক তথা বিচারিক দায়িত্ব পালনে অবহেলা করে মামলার সাক্ষীর প্রতিএই বিচারকদ্বয়ের এমন কাজ অনভিপ্রেত, অনাকাঙ্ক্ষিত, অবিবেচনাপ্রসূত ও অবিচারকসুলভ মনোভাব তথা আনবিকামিং অব জুডিশিয়াল অফিসার হিসেবে বিবেচনার যোগ্য।"

এটি বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস (শৃঙ্খলা) বিধিমালা ২০১৭ অনুযায়ী অসদাচরণের পর্যায়ভুক্ত অপরাধ উল্লেখ করে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা আবশ্যক বলে ওই চিঠিতে বলা হয়েছে।

দুই বিচারকের মধ্যে মি. নূর বর্তমানে দেশের বাইরে একটি স্কলারশিপে অধ্যয়নরত আছেন বলে আইন মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানিয়েছে।

দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তির প্রতীকি ছবি

ছবির উৎস,Getty Images

'জব্দ করা গাড়ী ব্যবহার ও অবৈধ সম্পদ অর্জন'

মি. জয়কে অভ্যর্থনার অভিযোগ ছাড়াও ঢাকার সাবেক মুখ্য মহানগর হাকিম রেজাউল করিম চৌধুরীর বিরুদ্ধে রয়েছে অসদাচরণ, অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ।

এসব অভিযোগে তার কাছে লিখিত ব্যাখ্যা চেয়েছে আইন মন্ত্রণালয়।

অভিযোগগুলোর মধ্যে একটি হলো ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) হিসেবে কর্মরত থাকাকালে ডিবি হেফাজতে থাকা মামলার জব্দ-কৃত আলামত একটি ল্যান্ড ক্রুইজার গাড়িসহ অন্য আরেকটি গাড়ি নিজ হেফাজতে নিয়ে অবৈধভাবে ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করেন মি. করিম।

এছাড়া আইন মন্ত্রণালয়ের নোটিশে অভিযোগে বলা হয়েছে, আইন ও বিচার বিভাগকে না জানিয়ে ঢাকার সিএমএম হিসেবে অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে পূর্বাচলে সাত কাঠার প্লট বরাদ্দ নেন তিনি।

বাংলাদেশের একটি ব্যবসায়িক গ্রুপ আশিয়ান গ্রুপের এক মামলায় বেআইনি প্রভাব খাটিয়ে পাঁচ কাঠার প্লট নেয়ার অভিযোগ তুলে সে ব্যাপারেও ব্যাখ্যা চেয়েছে আইন মন্ত্রণালয়।

নোটিশে আরও অভিযোগের মধ্যে রয়েছে, অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ দিয়ে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে তিন তলা একটি বাড়ি তৈরি এবং ওই শহরেরই জাকির হোসেন রোডের ইয়াকুব সেন্টারে একটি ফ্ল্যাট কেনেন তিনি।

এছাড়াও সিএমএম হিসেবে অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে বেসরকারি ইউনাইটেড হাসপাতালে প্রয়োজনে – অপ্রয়োজনে একাধিকবার পাঁচ বা সাত লাখ টাকার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে মি. করিমের বিল পরিশোধ না করার অভিযোগের ব্যাখ্যাও চেয়েছে মন্ত্রণালয়।

"একজন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তার জন্য এসব কাজ অপ্রত্যাশিত ও দুর্নীতিমূলক" উল্লেখ করা হয়েছে তাকে দেওয়া নোটিশ বা চিঠিতে।

ঢাকার সাবেক সিএমএম মি. চৌধুরী বর্তমানে কুমিল্লার একটি আদালতে কর্মরত রয়েছেন।

অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে ফোন করলেও রিসিভ করেননি তিনি।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক মো. ইফতেখারুজ্জামান
ছবির ক্যাপশান,বিভাগীয় পদক্ষেপের নামে বদলি করা বা অবসরে পাঠানোর চর্চা অপরাধকে জিইয়ে রাখার একটা সংস্কৃতি বলে মনে করেন মো. ইফতেখারুজ্জামান।

'বিভাগীয় পদক্ষেপের নামে অপরাধকে জিইয়ে রাখা হয়'

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে দুর্নীতির যেসব জরিপ করেছে, তাতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হারই বেশি।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, পাসপোর্ট অধিদপ্তর এমন সেবা খাতে দুর্নীতির হার বেশি।

এ ক্ষেত্রে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদের দেশের বিভিন্ন স্থানে অবৈধ সম্পদের নজিরও প্রমাণ দেয়।

যদিও অভিযোগের মুখেই দেশ থেকে বেরিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন পুলিশের সাবেক এই কর্মকর্তা।

অন্যদিকে, দুদকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত শতাধিক দুর্নীতির মামলায় প্রায় ৩৭৪ জনকে আসামী করা হয়েছে, যাদের অর্ধেকই সরকারি চাকরিজীবী।

আসামীদের মধ্যে ৯৬ শতাংশই মধ্যম ও নিম্ন সারির কমকর্তা - কর্মচারী। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা রয়েছেন মাত্র চার শতাংশের মতো।

এছাড়া উচ্চপদস্থ যে ক' জনকে আসামী করা হয়েছে, শেষ পর্যন্ত অভিযোগ প্রমাণ করতে না পারায় তাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশই ছাড়া পেয়ে গেছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে বিভাগীয় পদক্ষেপের নামে আসলে অপরাধকেই জিইয়ে রাখা হয়।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক মো. ইফতেখারুজ্জামান বিবিসি বাংলাকে বলেন, " আমাদের দেশে যার বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকে, তাকে অবসরে পাঠানোর সংস্কৃতি আছে। এটা সরকারের দিক থেকেও হয়।"

" আবার অনেক সময় অভিযোগের কারণে বিভাগীয় পদক্ষেপের নামে বদলি করা হয়, সাময়িক ক্লোজ করা হয়, ওএসডি করা হয়, অবসরে পাঠানো হয়- এটার একটা চর্চা আছে। এটা আসলে অপরাধকে জিইয়ে রাখার একটা সংস্কৃতি " বলেন তিনি।

এর উদাহরণ হিসেবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য মতিউর রহমানের আবেদনের পরই তাকে অবসরে পাঠানো সাম্প্রতিক 'ন্যক্কারজনক' দৃষ্টান্ত বলে উল্লেখ করেন মি. ইফতেখারুজ্জামান।

এটি অত্যন্ত প্রশ্নবিদ্ধ উল্লেখ করে তিনি বলেন, " এ ধরনের দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয় বলেই অপরাধীরা সুযোগ নেয়। সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও এ ধরনের সুযোগ দেয়। এতে দায় রয়েছে উভয় পক্ষেরই।"

এদিকে, বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস এসোসিয়েশনের নেতারা বলছেন, বিচার বিভাগের কোন ব্যক্তির দুর্নীতিমূলক কার্যক্রমকে উৎসাহিত করার সুযোগ নেই।

সংগঠনটির মহাসচিব মুহাম্মদ মাজহারুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেন, "বিচার বিভাগে কারও বিরুদ্ধে এ ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ থাকলে তাদের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষ যথাযথ যেটা মনে করেন, সেই ব্যবস্থা নেবেন।"

" এসোসিয়েশন কোন ধরনের দুর্নীতি বা বিচার বিভাগে কোন রকম রাজনৈতিকীকরণ সমর্থন করে না।" দাবি করেন মি. ইসলাম।

সারাদেশের বিচারিক আদালতের বিচারকদের সংগঠনের এই নেতা মনে করেন, "একজন বিচারকের দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় কোনো সাক্ষী বা গুরুত্বপূর্ণ যে ব্যক্তিই আসুক না কেন, তাকে আলাদা করে আতিথেয়তা দেখানোর সুযোগ নেই। কারণ এতে মামলা প্রভাবিত হওয়ার শঙ্কা থেকে যায়। "

দুদক কার্যালয়
ছবির ক্যাপশান,বাংলাদেশে আইনের নানা ফাঁক - ফোকর গলে দুর্নীতিবাজ অপরাধীরা পার পেয়ে যান বলে মন্তব্য করেন সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খান।

'আইনের ফাঁক-ফোকরে পার পেয়ে যান বেশিরভাগ দুর্নীতিবাজ'

সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খান বলছেন, সরকারি কর্মকর্তা - কর্মচারির বিরুদ্ধে অভিযোগ আনার আগে স্বেচ্ছা অবসরে যেতে চাইলে যেতে পারবেন।

কিন্তু কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়ার পর তাকে স্বেচ্ছা অবসরে যেতে দেওয়া যৌক্তিক নয়।

মি. খান বিবিসি বাংলাকে বলেন, " যদি কাউকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়, তবে এই প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে। যে আইনানুগ প্রক্রিয়া রয়েছে সেটা শেষ না করে কাউকে স্বেচ্ছা অবসরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া সঙ্গত হবে না। যৌক্তিক নয়।"

এর কারণ ব্যাখ্যা করে সাবেক এই আমলা জানান, সরকার অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে যে প্রক্রিয়া শুরু করেছে, তার প্রাথমিক সমাধান হওয়া জরুরী।

অথবা ক্ষমতা অনুযায়ী সরকার যদি অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেয়, তবে অভিযুক্ত ব্যক্তির স্বেচ্ছা অবসরের আবেদন গ্রহণ করতে পারে সরকার।

অভিযুক্ত ব্যক্তিরও বক্তব্য বিবেচনায় নিতে হয়। সরকারি কর্মকর্তা - কর্মচারীদের এ বিষয়গুলো একেকটি ঘটনা একেক রকম হয় বলে জানান মি. খান।

মি. খান বলছেন," বাংলাদেশে রাজনৈতিক কারণে অনেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। অনেকে দুর্নীতি করলেও অভিযোগ উত্থাপিত হয় না। কিন্তু যখনই দলীয় পরিচয় থাকে তখনই তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করা হয়।"

এ রকম অনেক অভিযোগও রয়েছে। আবার যখন তারাই ক্ষমতায় থাকে, তখন তাদের বিরুদ্ধে সব মামলা খারিজ হয়ে যাওয়ার নজির অহরহ রয়েছে বলে উল্লেখ করেন মি. খান।

বাংলাদেশে আইনের নানা ফাঁক - ফোকর গলে দুর্নীতিবাজ অপরাধীরা পার পেয়ে যান বলেও মন্তব্য করেন মি. খান।

সাবেক এই আমলা আবু আলম শহীদ খান বলেন, "আমাদের যে আইন আছে বা যে পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করা হয়, সেগুলোতে ফাঁক - ফোকর আছে। আইনগুলোতে স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। এতে অনেক ক্ষেত্রেই পার পেয়ে যান দুর্নীতিবাজরা।"

এছাড়াও তিনি উল্লেখ করেন, দুর্নীতির অপরাধ প্রমাণ করা বেশ কঠিন। শাস্তির মাত্রাও খুবই কম।