Image description

খুলনার কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের পলাতক চেয়ারম্যান আছের আলী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। সুন্দরবন নিয়ন্ত্রণ থেকে উপজেলার রাজনীতি সবকিছু সামলেছেন সমানতালে। এক সময়ের বনদস্যু আছের আলীর এই উত্থানের পেছনে রয়েছে লোমহর্ষক নানা কাহিনী। মাথার ওপর পুলিশ হত্যার মামলা নিয়েও চেয়ারম্যান পদে ছিলেন বহালতবিয়তে। লুটেছেন উন্নয়ন প্রকল্পের কোটি কোটি টাকা। 

বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের ওপর চালাতেন নির্যাতনের স্টিমরোলার। নারী নির্যাতন থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগ আমলে নানা অপকর্মের হোতা এই চেয়ারম্যান এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। ২০২১ সালে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর রাতারাতি কোটিপতি বনে যান তিনি।

উত্থান যেভাবে : স্কুলের গণ্ডি পার করতে না পারা আছের আলী কৈশোর থেকেই ছিলেন বনজীবী। সেখান থেকে যোগ দেন বনদস্যুদের দলে। একটি লম্বা সময় তিনি দস্যুতায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। সুন্দরবনে গড়ে তোলেন স্বতন্ত্র বাহিনী। এরপর পুলিশি তৎপরতা বাড়লে ছেড়ে দেন দস্যুতা। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে যেন আলাদিনের চেরাগ হাতে পেয়ে যান তিনি। তখন জেলেদের কাছে দস্যুদের কার্ড বিক্রি করতেন। সেখান থেকে কমিশন বাণিজ্য শুরু করেন আছের আলী। আওয়ামী লীগের প্রথম দুই মেয়াদে তিনি সংগঠনের স্থানীয় নেতাদের কাছে আসার চেষ্টা করেন। একই সঙ্গে চালাতেন সুন্দরবনে হরিণ শিকারের ব্যবসা। সেই মাংস উপঢৌকন হিসাবে পাঠাতেন আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়ি। ওই সময়ে কয়রা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মহসিন রেজার আস্থাভাজন হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। 

খুলনা-৬ আসনের সংসদ-সদস্য নুরুল হকের মাধ্যমে দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের সভাপতির পদ বাগিয়ে নেন। এরপর থেকে আওয়ামী লীগের ব্যানারে শুরু করেন সব অপকর্ম। গড়ে তোলেন নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী। যার নেতৃত্বে ছিলেন তার বড় ভাইয়ের ছেলে মনিরুল। সুন্দরবনের কোন অংশে কোন জেলে মাছ-কাঁকড়া ধরবে তা নির্ধারণ করে দিতেন তিনি। কোন খালে কারা বিষ দিয়ে মাছ শিকার করবে তাও চলত তার ইশারায়। 

এলাকায় মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ছিল আছের আলীর হাতে। সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে সুন্দরবন হয়ে মদ, গাঁজা ও ফেনসিডিলের চালান নিয়ে আসত তার বাহিনী। এসবের মাধ্যমে ৪-৫ বছরের মধ্যেই বিপুল পরিমাণ কাঁচা টাকা চলে আসে তার হাতে। এরই মধ্যে নির্বাচন করার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন তিনি। ২০১৭ সালের ইউপি নির্বাচনে ২নং ওয়ার্ড থেকে সদস্য নির্বাচিত হন। ইউপি সদস্যপদের সূত্র ধরে উপজেলা পর্যায়ের বিভিন্ন দপ্তরে সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পের সঙ্গেও পরিচিতি হয় আছের আলীর। স্বপ্ন দেখেন চেয়ারম্যান হওয়ার। সে লক্ষ্যে তার অবৈধ ব্যবসাগুলোকে আরও সম্প্রসারিত করতে শুরু করেন। 

এক পর্যায়ে ২০২১ সালের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এ সময় দলের নেতাদের নিজের দিকে টানতে ব্যাপক টাকা ছড়ান। জনশ্রুতি রয়েছে, দলীয় প্রতীক পেতে খরচ করেন কোটি টাকা। এর পরও দলীয় মনোনয়ন পাননি। এসময় তিনি ইউনিয়ন ও উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা এবং স্থানীয় সংসদ-সদস্য আক্তারুজ্জামান বাবু ও পুলিশ প্রশাসনকে টাকা দিয়ে কিনে ফেলেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে বিজয়ী হন। চেয়ারম্যান নির্বাচনের পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ লুটপাট আর অবৈধ আয়ে গড়েছেন বিপুল পরিমাণ সম্পদ।

সম্পদের পাহাড় আছের আলীর : মাত্র তিন বছর চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন আছের আলী। এর মধ্যে পুলিশ হত্যা মামলায় ছয় মাস জেলও খেটেছেন তিনি। তবুও এত অল্প সময়ের মধ্যে তার সম্পদের হিসাব শুনলে যে কারও হুঁশ উড়ে যাওয়ার জোগার। দক্ষিণ বেদকাশী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে জাল সনদ দিয়ে সভাপতি হন। সেখানে নিয়োগ দিয়ে ১৫ লাখ টাকা ঘুস নেন আছের আলী। সেই ঘটনায় মামলাও হয়। অংশীদারত্বের ভিত্তিতে বর্তমানে তিনটি ভাটার মালিক আছের আলী। 

রাজবাড়ী জেলার বসন্তপুর স্টেশন বাজারের পাশে অবস্থিত এসব ভাটায় কোটি টাকা লগ্নি করেছেন তিনি। বর্তমানে ওই ভাটাতেই অবস্থান তার। খুলনার আড়ংঘাটা থানার মোস্তর মোড় এলাকায় তিন একর জমি কিনেছেন। যার বর্তমান বাজার মূল্য ২০ কোটি টাকা। নগরীর মোহাম্মদ নগর এলাকায় ৪ কাঠা জমির ওপর বহুতল ভবন নির্মাণ করেছেন। রূপসা উপজেলার সেনহাটি ইউনিয়নে ১০ কাঠা জমিতে বাড়ি নির্মাণ করেছেন। 

সেখান থেকে নিয়মিত ভাড়ার টাকা পান তিনি। নিজ গ্রাম ঘড়িলাল বাজারে একসময়কার গোলপাতার ঘরের জায়গায় দুইতলা বাড়ি নির্মাণ করেছেন। মোটকথা আয়েশী জীবন যাপনে সম্পদের যথাযথ ব্যবহার করেছেন আছের আলী। তার এসব আয়ের পূর্ণ হিসাব সংরক্ষণ করেন তারই জামাতা তরিকুল ইসলাম। বর্তমানে তিনি এলাকায় থেকে এসব ব্যবসা বাণিজ্য পরিচালনা করছেন।

পুলিশ হত্যা মামলা ছিল বিষফোঁড়া : ২০১৩ সালের ৯ মার্চ আসামি ধরতে গিয়ে ওই ইউনিয়নের আংটিহারা পুলিশ ফাঁড়ির কনস্টেবল মফিজুল ইসলাম গুলিতে নিহত হন। এই গুলি ছোড়ে আছের আলী ও তার সন্ত্রাসী বাহিনী। এ ঘটনায় ওই ফাঁড়ির ইনচার্জ উপপরিদর্শক (এসআই) মমিনুর রহমান কয়রা থানায় মামলা করেন। সেই মামলা আছের আলী কয়েকবার অর্থের বিনিময়ে দফারফা করতে চাইলেও ব্যর্থ হন। তার বিরুদ্ধে পিবিআই অভিযোগপত্র জমা দেয় আদালতে। 

সেসময় তিনি চেয়ারম্যানের পদ থেকে বহিষ্কৃত হন এবং ৬ মাস জেলও খাটেন। এ নিয়ে বেকায়দায় পড়েন তিনি। পরে আওয়ামী লীগ নেতাদের মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের অর্থে সমঝোতা করে চেয়ারম্যান পদ ফিরে পান। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে বন্যপ্রাণী হত্যা ও পাচারের অভিযোগে মামলা রয়েছে। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরেও দুবার এলাকায় যান আছের আলী। চেয়ারম্যান পদ ফিরে পেতে বিএনপি-জামায়াত নেতাদের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা চালান। তবে স্থানীয় লোকজনের বাধার মুখে পালিয়ে যান তিনি।

এত অভিযোগ থাকার পরও তাকে গ্রেফতার করতে না পারার বিষয়ে কয়রা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইমদাদুল হক বলেন, আমরা আছের আলীর অবস্থান শনাক্ত করার চেষ্টা করছি। অবস্থান নিশ্চিত করতে পারলেই অভিযান পরিচালনা করব।