Image description

ঋণের শর্ত হিসেবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি থেকে বেরিয়ে আসতে সরকারকে ধারাবাহিক চাপ দিয়ে যাচ্ছে। পরামর্শ দিয়েছে প্রয়োজনে আবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর। অন্তর্বর্তী সরকার দাম না বাড়িয়ে বিদ্যুতে ভর্তুকি কমানোর চেষ্টা করছে। চলতি অর্থবছরে প্রায় সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করতে চায় তারা। অর্থ বিভাগও এমন পরামর্শ দিয়ে আগামী অর্থবছরের জন্য ভর্তুকি কমিয়ে আনার কথা বলেছে। 

বিদ্যুৎ খাতে সরকারি ভর্তুকির সিংহভাগ যাচ্ছে মূলত ক্যাপাসিটি চার্জে। বিদ্যুৎ না কিনলেও চুক্তি অনুসারে যে অর্থ দিতে হয় উৎপাদন কেন্দ্র মালিককে, তা ক্যাপাসিটি চার্জ নামে পরিচিত। বর্তমানে চাহিদার চেয়ে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৫৪ শতাংশ বেশি। অতিরিক্ত সক্ষমতার কারণে বিদ্যুৎ না কিনেও বিদ্যুৎ বিভাগকে প্রতি বছর কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ করতে হয় ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধে। আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে ১ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীদের পকেটে গেছে। ক্যাপাসিটি চার্জের বোঝা কমাতে বারবার বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের খুচরা মূল্য। আওয়ামী লীগের দেড় দশকেই বিদ্যুতের দাম কয়েক গুণ বেড়েছে। সঙ্গে বেড়েছে ভর্তুকি। 

বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রতি ইউনিটে বিদ্যুতের গড় উৎপাদন খরচ ছিল ৬ টাকা ৬১ পয়সা। চলতি অর্থবছরে যা বেড়ে হয়েছে ১২ টাকা ৩১ পয়সা। এখন প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের পাইকারি মূল্য ৭ টাকা ৪ পয়সা। অর্থাৎ এক ইউনিটে ক্ষতি হচ্ছে ৫ টাকা ২৭ পয়সা। ২০০৯ সালে বিদ্যুতের খুচরা দাম ছিল ইউনিটপ্রতি ৩ টাকা ৭৩ পয়সা। গত ১৫ বছরে প্রতি ইউনিটের খুচরা দাম বেড়ে হয়েছে ৮ টাকা ২৫ পয়সা। দাম বাড়িয়েও লোকসান কমেনি। তাই ভর্তুকির মাধ্যমে এই লোকসান সামাল দেওয়ার চেষ্টা চলে। ২০২০-২১ অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির পরিমাণ ছিল ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। আর চলতি অর্থবছরে ভর্তুকি বেড়ে হয়েছে ৬২ হাজার কোটি টাকা। 

 

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘ভর্তুকি কমানোর ক্ষেত্রে দাম বৃদ্ধিই একমাত্র সমাধান নয়, খরচ কমাতে হবে। অপচয়, অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা এবং দুর্নীতির কারণে যে বাড়তি খরচ হচ্ছে, বেরিয়ে আসতে হবে তা থেকে। গত দেড় দশকে বিদ্যুতে যেসব চুক্তি হয়েছে, এর অধিকাংশই অতিমূল্যায়িত। ভুল নীতির কারণে বসে থেকে অনেক কেন্দ্র ক্যাপাসিটি চার্জ পাচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, শুধু লিস্টকস্ট লোড ম্যানেজমেন্টের (সাশ্রয়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র বেশি চালানো) মাধ্যমে বছরে এক বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করা সম্ভব।’

পিডিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির পরিমাণ ছিল ৭ হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা। ওই অর্থবছরে ভর্তুকির তুলনায় ৪৭ দশমিক ২৫ শতাংশ বেশি অর্থ খরচ হয় ক্যাপাসিটি চার্জে; যার পরিমাণ ১০ হাজার ৯৫৩ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে ভর্তুকি দিতে হয় ৮ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা। সে অর্থবছরে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে  ১৩ হাজার ২১ কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে ভর্তুকি ১২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা আর ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল ১৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ভর্তুকি ছিল ২৯ হাজার ৫১১ কোটি টাকা আর ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল ১৭ হাজার ৭৮৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ ভর্তুকির ৬০ দশমিক ২৮ শতাংশ খরচ হয় ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পিডিবি ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করেছে ২৮ হাজার ৪৮৯ কোটি টাকা আর ভর্তুকি পেয়েছে ৩৯ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ভর্তুকির ৭২ দশমিক ৩০ শতাংশ গেছে ক্যাপাসিটি চার্জে। খাতসংশ্লিষ্টদের মতে, চলতি অর্থবছরও ভর্তুকির সিংহভাগ অংশ ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতেই চলে যাবে।

সাশ্রয়ের ক্ষেত্র
বিদ্যুৎ বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, আমরা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র চিহ্নিত করেছি, যেখানে বছরে ১০ শতাংশ খরচ কমানো যাবে। এতে বছরে প্রায় সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। গ্যাস ও কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়িয়ে তেলভিত্তিক কেন্দ্র কম চালানো হবে। এভাবে সাশ্রয় হবে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা। পিডিবিকে ৩৭০ কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ খরচ কমানোরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ৬৮২ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়েকটি রেন্টাল, কুইক রেন্টাল এবং আইপিপি কেন্দ্রের সঙ্গে সিদ্ধান্ত হয়েছে চুক্তি বাতিলের। 

বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, সরকার ১ শতাংশ ছাড় নিশ্চিত করতে আমদানি করা হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের বিল, ইনভয়েস জমার ৩০ দিনের মধ্যে পরিশোধের পরিকল্পনা করছে, যা থেকে ৬৫ কোটি টাকা সাশ্রয় হতে পারে। বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ফার্নেস অয়েল আমদানি প্রক্রিয়ায় খরচ কমানোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে ফার্নেস অয়েল আমদানি নিরুৎসাহিত করা, যার ফলে আমদানি শুল্ক ৭ শতাংশ সাশ্রয় হবে। এর পরিমাণ ৩৩৫ কোটি টাকা। বড় জাহাজে আমদানি করা হবে ফার্নেস অয়েল, এতে ৩৫৪ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। এ ছাড়া বেসরকারি খাতে ফার্নেস অয়েল আমদানির প্রণোদনা ৯ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে কমিয়ে আনা হয়েছে, এতে সাশ্রয় হবে ৪৭০ কোটি টাকা। আদানি পাওয়ারের ক্রয় চুক্তি পর্যালোচনা করে সরকার বছরে ৩ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করতে চায়।  
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেছেন, সরকার অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা এবং খাতভিত্তিক সংস্কারের মাধ্যমে ভর্তুকি কমাতে চায়। 

অর্থ বিভাগের সুপারিশ
বিদ্যুৎ খাতে বাড়তে থাকা ভর্তুকির চাপ সামলাতে কয়েকটি সুপারিশ করেছে অর্থ বিভাগ। সম্প্রতি বাজেট-সংক্রান্ত এক আলোচনা সভা থেকে এই সুপারিশগুলো উঠে এসেছে। এর মধ্যে রয়েছে– পুরোনো ও অদক্ষ বিদ্যুৎকেন্দ্র পর্যায়ক্রমে বন্ধ করা, আইপিপিগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ কমানো, বিদ্যুৎ উৎপাদনে সস্তা জ্বালানিকে অগ্রাধিকার দেওয়া ইত্যাদি। বেসরকারি ও যৌথ উদ্যোগের বিদ্যুৎকেন্দ্রের শুল্ক নির্ধারণে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা এবং মন্ত্রিসভা বা উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদন নিতে হবে। বিনিয়োগ বাড়াতে হবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে। বিদ্যুতের চাহিদা ও রিজার্ভ মার্জিন (অতিরিক্ত উৎপাদন ক্ষমতা) যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনার সুপারিশও এসেছে।