Image description

গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাটকীয় ক্ষমতাচ্যুতির পর দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর নিযুক্ত হন আহসান এইচ মনসুর। দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই হাসিনা সরকারের প্রধান সহযোগী রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক এলিটদের বিদেশে পাচার করা বিপুল পরিমাণ অর্থ উদ্ধারের জন্য এক কঠিন অভিযানে নামেন তিনি। তাঁর অনুমান, পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে পাঁচ বছরের মতো সময় লাগতে পারে।

 

গত এক দশক ধরে দেশের বাইরে বিশেষ করে যুক্তরাজ্য, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুরে পাচার করা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার পাচারের অভিযোগে অভিযুক্ত ১১টি প্রভাবশালী পরিবারের সম্পদ ট্র্যাক করার জন্য ১১টি বিশেষজ্ঞ দল গঠন করেছে।

পাচার করা অর্থের পরিমাণ আকাশছোঁয়া। তদন্তাধীন ১১টি পরিবারের মধ্যে শুধু একটি পরিবারই ১৫ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ বাংলাদেশ থেকে সরিয়ে ফেলেছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। একটি ক্ষেত্রে, এই পরিবার একটি মাত্র ব্যাংকের প্রায় ৯০ শতাংশ আমানত তুলে নেয়, যা ব্যাংকটিকে পতনের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়।

সরকার পতনের পর কয়েক দিনের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নিযুক্ত হওয়া আইএমএফের সাবেক অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর উদ্বিগ্ন যে, অতি দ্রুত খুঁজে না পেলে এই অর্থের বেশির ভাগই গায়েব হয়ে যেতে পারে। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরাকে তিনি বলেন, ‘আমরা জানি সময়ের গুরুত্ব কতটা। সম্পদের ভিত্তি ক্ষয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।’

পাচার হওয়া অর্থ পুনরুদ্ধারে আহসান এইচ মনসুরের প্রথম টার্গেট যুক্তরাজ্য। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া আনুমানিক ২৫ বিলিয়ন ডলারের সন্ধান এবং বাজেয়াপ্ত করার জন্য ব্রিটিশ পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ অফিস এবং লন্ডনের আইনি সংস্থাগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছেন।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘এই পরিবারগুলোর অনেকেরই সম্পদ বিশেষ করে লন্ডনে রয়েছে, তাই আমরা মনে করি এখানে অনেক সম্পদ খুঁজে পাব।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের মূল উদ্দেশ্য অন্তত (এই) সচেতনতা তৈরি করা যে, যুক্তরাজ্য বিশ্বজুড়ে চুরি করা সম্পদের একটি পছন্দের গন্তব্য, এবং বাংলাদেশ সেই দেশগুলোর মধ্যে একটি যেখান থেকে এটি এসেছে।’

এই অনুসন্ধানে আগ্রহের কেন্দ্রে থাকা একজন হলেন সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী। আল-জাজিরার অনুসন্ধানী ইউনিট (আই-ইউনিট) জানতে পেরেছে, তাঁর ৫০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের স্থাবর সম্পত্তি রয়েছে—যার বেশির ভাগই লন্ডন ও দুবাইতে।

গত বছর আই-ইউনিট প্রকাশ করেছিল যে, চৌধুরী পরিবার যুক্তরাজ্যে ৩৬০ টিরও বেশি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছে, যার বেশির ভাগই লন্ডনে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তাঁর প্রায় ৪০টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করেছে এবং তাঁর ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জরুরি ভিত্তিতে তাঁর বিদেশের সম্পত্তিও জব্দ করতে চাইছে, যাতে সেগুলো বিক্রি হওয়া থেকে আটকানো যায়।

সাইফুজ্জামান চৌধুরী দাবি করেছেন, তিনি পূর্ববর্তী সরকারের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ‘উইচ হান্টের’—এর শিকার এবং তাঁর সম্পদ বৈধভাবে অর্জিত হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সম্পদ জব্দ করার দিকে মনোযোগ দিলেও আহসান এই মনসুর যুক্তরাজ্য এবং অন্যান্য দেশের কর্তৃপক্ষের কাছে সেই সব আইনজীবী, ব্যাংকার এবং এস্টেট এজেন্টদের বিরুদ্ধে তদন্ত করার আহ্বান জানিয়েছেন, যারা এই ‘অলিগার্ক’ পরিবারগুলোকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার সরিয়ে নিতে সাহায্য করেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেন, ‘আইন লঙ্ঘন করা হচ্ছে, এজেন্ট বা অপারেটররা তো বটেই অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো অপরাধীদের এই বিচারব্যবস্থায় পুনর্বাসিত করতে কাজ করছে। তবে এটিই একমাত্র উদাহরণ নয়, আরও অনেক আছে। আমি মনে করি, দেশের (ব্রিটিশ) কর্তৃপক্ষের জন্য এই ধরনের জিনিসের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়া একটি নৈতিক বাধ্যবাধকতা।’

আহসান এইচ মনসুরের অনুমান, পাচার করা তহবিলের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে পাঁচ বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে এবং স্বীকার করেছেন, কর্তৃপক্ষের ব্যাপকতা ও জটিলতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে গিয়ে অগ্রগতি ধীর হয়ে গেছে। তবে তিনি বলেছেন, যুক্তরাজ্য সরকার সাহায্য করছে।

এখন তিনি বিদেশে অর্থ পাচারের কাজে সাহায্যকারীদের মূল হোতাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়ার বিনিময়ে তাদের সঙ্গে আপস বা এমনকি হারিয়ে যাওয়া অর্থ বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার জন্য কোনো ধরনের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার কথা বিবেচনা করছেন।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, একাধিক দেশে পাচার হওয়া বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ট্র্যাক করার জটিল কাজটি যুক্তরাষ্ট্রে সরকার পরিবর্তনের পর আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। মার্কিন তদন্তকারীদের একটি দল—যাদের এ বছর বাংলাদেশে কাজ শুরু করার কথা ছিল—প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর নতুন মেয়াদের শুরুতে ইউএস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টের (ইউএসএআইডি) তহবিল স্থগিত করার পর তাদের কার্যক্রম বাতিল করা হয়েছে।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘তাদের পূর্ণ শক্তিতে ঢাকায় আসার কথা ছিল, কিন্তু তা বাতিল করতে হয়েছে...আমাদের বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ...ইউএসএআইডির অর্থায়নে পরিচালিত ছিল, কিন্তু তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এটি আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক, তবে এটাই বাস্তবতা।’