Image description

‘ঈদের নামাজ পড়ে বাসায় এসে ছেলেটা প্রথম পা ছুঁয়ে সালাম করত। নতুন পাঞ্জাবি পরত। এর পর ঈদের সেমাই তুলে দিতাম তার মুখে। এবার ছেলে নেই। কার মুখে সেমাই তুলে দেব?’— এভাবেই কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন জুলাই অভ্যুত্থানে শহিদ ফয়সাল আহমেদ শান্ত’র মা কোহিনুর বেগম।

একমাত্র ছেলে ছাড়াই এবার ঈদ পালন করতে হচ্ছে কোহিনুর বেগমকে। বুকের ধনকে হারিয়ে তার কাছে ঈদের আনন্দটা যেন এখনো বিষাদের ছায়া।

গত বছরের ১৬ জুলাই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে চট্টগ্রাম নগরীর মুরাদপুরে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগ-যুবলীগের সন্ত্রাসীদের গুলিতে ফয়সাল আহমেদ শান্ত (২০) গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। তিনি নগরীর ওমরগণি এমইএস কলেজের স্নাতক প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন।

শহিদ ফয়সাল আহমেদ শান্তর মা কোহিনুর বেগম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার ছেলে তার নামের মতোই শান্ত ছিল। গত সাত মাস ধরে আমাদের ঘরে কেউ ভালো করে হাসতে পারি না। আমার মেয়ে এখনো তার ভাইয়ের কথা মনে করে কান্না করে। এরকম ঈদ আসবে সেটা আমরা কখনোই ভাবিনি। আমার ছেলে খুব ধার্মিক ছিল। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ত। কারও সঙ্গে কখনো উচ্চবাচ্য করেনি। ঈদের দিন তার বন্ধুরা আমাদের ঘরে আসত। সে বন্ধুদের বাসায় যেত।’

কান্নাজড়িত কণ্ঠে কোহিনুর বলেন, ‘এবার ঈদ নিয়ে আমাদের কোনো আনন্দ নেই। কেউ নতুন পোশাক কিনবে সে ইচ্ছাশক্তিও কারও ছিল না। শান্তর বন্ধুরা আমাদের জন্যে শপিং করে বাসায় দিয়ে গেছে। তাকে ছাড়া আমরা কীভাবে নতুন পোশাক পরে ঈদ পালন করব?’- এই বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

তিনি বলেন, ‘তার বন্ধুরা আসবে সবাই। সবাই সেমাই খাবে। শুধু আমার ছেলে থাকবে না। আমার ছেলে তার মায়ের হাতের রান্না করা সেমাই খেতে পারবে না। রমজান মাসে তাকে ছাড়া সেহেরি খেতে গিয়ে ভালো করে খেতে পারিনি। ইফতার খেতে পারিনি। যতবারই খেতে বসেছি শুধু তার কথা মনে পড়েছে। প্রতিবার ছেলেমেয়েসহ একসঙ্গে ইফতার-সেহেরি করেছি। নতুন পোশাক পড়ে ঈদ পালন করেছি। তার বাবা বাড়ি থেকে আসতেন। একসঙ্গে শপিং করতাম। এখন তাকে ছাড়া কিছুই করতে ইচ্ছে করে না।’

নগরীর বন্দর থানার ইপিজেড এলাকায় ভাড়া বাসায় পরিবারসহ থাকতেন শান্ত। কোহিনুর বেগমের এক ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে শান্ত ছিল বড়। মেয়ে বৃষ্টি পড়েন নবম শ্রেণিতে। শান্তর বাবা জাকির হোসেন। তাদের বাড়ি বরিশালে। তিনি ফার্নিচারের কাজ করেন। কোহিনুর বেগম নগরীর দামপাড়ায় সিএমপি স্কুল অ্যান্ড কলেজে শিক্ষকতা করেন। এর আগে তিনি একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। তৎকালীন সিএমপি কমিশনার সাইফুল ইসলাম পরে তাকে সিএমপি স্কুল অ্যান্ড কলেজে শিক্ষকতার সুযোগ করে দেন।

কোহিনুর বেগম বলেন, ‘শহরে আমাদের বাড়ি ছিল, পতেঙ্গা এলাকায়। শান্তর বাবা গার্মেন্টসে চাকরি করতেন। জমানো টাকা দিয়ে জমি কিনে বাড়ি করেছিলেন। সরকার সেখান থেকে আমাদের উচ্ছেদ করে দেয়। এরপর অনেক অর্থকষ্টের মধ্যে দিয়ে আমাদের যেতে হয়েছে। একটি ছোট এক রুমের বাসা ভাড়া নিয়ে আমরা থাকতাম। এত কষ্টের পরও তারা দুই ভাইবোন পড়ালেখা ছাড়েনি। শান্ত পড়ালেখায় ভালো ছিল।’

তিনি বলেন, ‘আমি একটি প্রাইভেট স্কুলে শিক্ষকতা করতাম। ১১ আগস্ট শান্ত মারা যাওয়ার পর পুলিশ ও জেলা প্রশাসকসহ অনেকেই আমাদের বাসায় এসেছিলেন। পরে রাসেল ও রাফি পুলিশ কমিশনার স্যারকে বলে আমাকে সিএমপি স্কুলে চাকরির সুযোগ দিতে। পরে তিনি আমাকে আমাকে সে সুযোগ করে দেন।’