
বাংলাদেশ ও আশপাশের দেশগুলোয় ভূমিকম্পের প্রবণতা বেড়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে বাংলাদেশ ও আশপাশের দেশগুলোয় অন্তত ২১টি ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়েছে। ভূমিকম্পবিষয়ক গবেষকরাও বলছেন, সাম্প্রতিককালে ঘন ঘন এসব ভূমিকম্প বড় ভূমিকম্পের ইঙ্গিত বহন করছে। এতে বাংলাদেশে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটতে পারে।
এদিকে গতকাল শুক্রবার রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। দুপুর ১২টা ২১ মিনিটে ভূমিকম্পটি অনুভূত হয়। রিখটার স্কেলে এই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৭.৩। তীব্র ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ঢাকা থেকে ৫৯৭ কিলোমিটার দূরে মায়ানমারের মান্দালয় অঞ্চলে। ভূমিকম্পের প্রভাবে মায়ানমার ও থাইল্যান্ডে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলেও বাংলাদেশে তাত্ক্ষণিকভাবে কোনো ক্ষয়ক্ষতির তথ্য পাওয়া যায়নি।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএস বলেছে, ভূমিকম্পটি ছিল ৭.৭ মাত্রার। মায়ানমারের সাগাইং থেকে ১৬ কিলোমিটার উত্তর-উত্তরপশ্চিমে হওয়া ভূমিকম্পটির গভীরতা ছিল ১০ কিলোমিটার।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণাকেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রুবাইয়াৎ কবীর গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, “মায়ানমারের এই ভূমিকম্পটি প্রত্যাশিত ছিল।
বাংলাদেশ ও আশপাশের দেশে ভূমিকম্প বাড়ছে
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, ২০২১ সালে বাংলাদেশ ও আশপাশের দেশে ২৭টি ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়েছে। পরের বছর ২০২২ সালে এই সংখ্যা কিছুটা কমে ১৯-এ নেমে আসে। তবে দুই বছর ধরে এই সংখ্যা ঊর্ধ্বমুখী। ২০২৩ সালে বাংলাদেশ ও আশপাশের দেশে ৩৫টি ভূমিকম্প হয়। আর ২০২৪ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৪টি।
অন্যদিকে চলতি বছর প্রথম দুই মাসে ২১টি ভূমিকম্প হয়েছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্র। অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী গত ৩ মার্চ আরেকটি ভূমিকম্প হয়েছে।
ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এ বছর আমাদের আশপাশের দেশগুলোয় ভূমিকম্পের সংখ্যা আসলেই বেড়েছে। গত দুই মাসে এর সংখ্যা অনেক বেশি। আমাদের এখন থেকে সাবধান হতে হবে এবং সেভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে।’
বাংলাদেশের বাইরের শক্তিশালী ভূমিকম্পে দেশের বড় ক্ষতি হতে পারে
দেশের সীমানার ২৫০ থেকে ৩০০ কিলোমিটারের মধ্যে শক্তিশালী ভূমিকম্প হলে বাংলাদেশেও বড় ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি হতে পারে বলে আশঙ্কা করেছেন ভূমিকম্পবিষয়ক গবেষকরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও ভূমিকম্পবিষয়ক গবেষক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাংলাদেশের ২৫০ থেকে ৩০০ কিলোমিটারের মধ্যে বড় ভূমিকম্প হলে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে। মায়ানমার থেকে এক হাজার কিলোমিটার দূরে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককের স্কাইক্র্যাপার (আকাশচুম্বী ভবন) ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। সুতরাং মায়ানমারে বড় ভূমিকম্প হলে আমাদের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হবে না এটা ভেবে যদি আমরা প্রস্তুতি না নিই তাহলে ভুল হবে।’
হুমায়ুন আখতার বলেন, বাংলাদেশে ভূমিকম্পের উৎস দুটি। একটি হচ্ছে—ইন্দো-বার্মা সাবডাকশন জোন, আরেকটি সিলেট থেকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার-টেকনাফ পর্যন্ত পাহাড়ি অঞ্চল। এর মধ্যে বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের সেভেন সিস্টার্স, মায়ানমারও আছে।
এর মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের সাবডাকশন জোনে ৮.২ থেকে ৯ মাত্রার বড় ভূমিকম্পের শক্তি জমা হয়েছে। এটা যেকোনো সময় হতে পারে। এখানে ৮০০ থেকে এক হাজার বছর আগে একটি বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়েছে, যা মেঘনার গতিপথ পরিবর্তন করে দিয়েছিল। এ অঞ্চলে ভূমিকম্প হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে ঢাকার। কারণ ঢাকা জনবহুল এবং অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণে দুষ্ট।
ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী গতকাল কালের কণ্ঠকে মায়ানমারের ভূমিকম্প সম্পর্কে বলেন, ‘আমাদের সীমান্তের ২০০ থেকে ২৫০ কিলোমিটারের মধ্যে ভূমিকম্প হলেও চট্টগ্রামে তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। সে তুলনায় থাইল্যান্ডে অনেক ক্ষতি হয়েছে, সুউচ্চ ভবন ধসে পড়েছে। কারণ চট্টগ্রাম বেল্টের পাহাড়ি এলাকার মাটি অনেক শক্ত। অন্যদিকে থাইল্যান্ড নরম মাটির জন্য বিখ্যাত। নরম মাটিতে উঁচু ভবনগুলোয় কম্পন অনেক বেশি হয়।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে বড় ভূমিকম্পের পর এরই মধ্যে ১৫০ বছর পার হয়ে গেছে। ১৮৬৯ সালে ‘কাছাড় ভূমিকম্প’ নামে ভূমিকম্পটি সিলেটের বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে হয়েছিল। ফলে একটি শক্তিশালী ভূমিকম্প যেকোনো সময় এখানে হতে পারে। ঢাকা থেকে ১৫০ বা ২০০ কিলোমিটারের মধ্যে ৭ মাত্রা বা এর বেশি শক্তিসম্পন্ন ভূমিকম্প হলে ঢাকার নরম মাটির এলাকাগুলোয় বড় বিপর্যয় হতে পারে।
মায়ানমারের ভূমিকম্প চোখ খুলে দেওয়ার মতো ঘটনা, প্রয়োজন প্রস্তুতি
মায়ানমারের ভূমিকম্পটি বাংলাদেশের জন্য চোখ খুলে দেওয়ার মতো ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করে বুয়েটের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, ‘আমরা এখনই প্রস্তুতি শুরু করতে পারি। আজকের (গতকালের) মায়ানমারের ভূমিকম্পটি ৬০০ কিলোমিটার না হয়ে ৩০০ কিলোমিটার দূরে এবং ৫০ কিলোমিটার গভীরে হলে আমাদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হতে পারত।’
অন্যদিকে বাংলাদেশের প্রস্তুতির ঘাটতির বিষয়টি তুলে ধরে ভূমিকম্পবিষয়ক গবেষক ও অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, ‘আমাদের প্রস্তুতি নেই। জনগণের মধ্যে ভূমিকম্পবিষয়ক শিক্ষা ও সচেতনতার অভাব—সব মিলিয়ে ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে ঢাকা শীর্ষ কয়েকটি নগরীর মধ্যে রয়েছে।’