
‘ওয়াশরুমে গিয়ে শাওয়ার ছেড়ে কখনো কখনো কান্না করতাম। আবার কখনো মুখে গামছা গুঁজে কান্না করতাম,’ ভরাট কণ্ঠে এমনটা বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আশিকুর রহমান রাফি। তিনি হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলে থাকেন।
ঈদে যখন চারদিকে মানুষ উদযাপনের ক্ষেত্র খুঁজে নিচ্ছে, তখন রাফির জীবনের মোড় নেয় ভিন্ন দিকে। যখন ক্যাম্পাসের সহপাঠীরা হন্তদন্ত হয়ে ব্যাগ গোছাচ্ছে, তখন রাফির বাড়ি ফেরার নেই কোনো তাড়া। তাকে থাকতে হয় স্বাভাবিক। কারণ কোথায় যাবেন? কার কাছে যাবেন? বাড়িতে সবচেয়ে প্রিয় যিনি থাকেন, রাফির পরিবারে তিনি-ই নেই।
রাফি ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছেন। বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে নতুন সংসারে আবদ্ধ হয়েছেন। তাই প্রায় সাত বছর ধরে একাকী থেকেই কেটে যাচ্ছে তার ঈদ।
রাফি বলছেন, একটা বিষয় লক্ষণীয়, ঈদকেন্দিক বাড়ির ফেরার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে নাড়ির প্রতি একটা টান থাকে। আমার এই নাড়ির টান ছিন্ন হয়ে গেছে ২০১৪ সালের দিকে। যখন আমি ক্লাস ফাইভ শেষ করেছি। আমি যখন বাড়ি যাব, তখন আমি দেখব আমার মা নেই। আমার আব্বা আমার সঙ্গে ঈদ করছেন না। উনি আমার বর্তমান মা যেখানে থাকেন সেখানে ঈদ করছেন। তখন আসলে ওই জায়গাটা ফাঁকাই থাকবে, একাই লাগবে।
রাফির বড় দুই ভাই রয়েছেন। তারাও তেমন একটা যোগাযোগ রাখেন না তার সঙ্গে। বড় ভাইদের বিষয়ে রাফি বলেন, সাইড রোল বলতে বড় ভাইয়েরা তাদের পরিবার নিয়ে তাদের মতো করে ঈদ উদযাপন করবে। আমার চাচা-চাচিরা তাদের সন্তানদে প্রায়োরিটি দেবে, এটাই স্বাভাবিক। এসবের মাঝে আমি একাকী ফিল করব। তো ওখানে ঈদ করা আর ঢাকাতে ঈদ করা একই রকম মনে হয়। তাই আমি ঢাকাতেই ঈদ করি।
তিনি বলেন, আমার ভাইদের সঙ্গে কথাবার্তা খুব কম হয়। আমার মেজ ভাইয়ের সঙ্গে সর্বশেষ দুই বছর আগে কথা হয়েছে। আমার বড় ভাইয়ের সঙ্গে সর্বশেষ কবে কথা হয়েছে আমার মনে নেই। তাদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ একদম নেই বললেই চলে তবে তারা আমার শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে আছেন।
ক্যাম্পাসে সহপাঠীদের পারিবারিক বন্ধন দেখে রাফি আবেগপ্রবণ হয়ে যেতেন। কিন্তু কাউকে বুঝতে দিতেন না যে তিনিও কোন কষ্টে পুড়ছেন। তিনি নিজেই নিজের খরচ বহন করছেন।
রাফি বলেন, আমার সহপাঠী বন্ধুদের মায়েরা ফোন করতেন তাদের কাছে। তারা জিজ্ঞেস করতেন কী দিয়ে খাওয়া-দাওয়া করেছে, কীভাবে চলছে। এসব ছোট ছোট বিষয় আমাকে ইমোশনাল করে ফেলত। কিন্তু আমি তাদের কাছে আমার ইমোশন দেখাতে চাইতাম না। তবে কখনো কখনো ওয়াশরুমে গিয়ে শাওয়ার ছেড়ে কান্না করতাম অথবা মুখে গামছা গুঁজে কান্না করতাম।
কবে ঈদ উদযাপন করেছেন, সেই স্মৃতি হাতড়ে রাফি বলেন, আমার বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে এটা হচ্ছে তৃতীয় ঈদ। আমি প্রথম বর্ষের দুটি ঈদ হলে করেছি। এবারও তৃতীয় ঈদ হলেই করতে হচ্ছে। আমি নিজেই করছি।
প্রেরণা পাচ্ছেন কীভাবে, জানতে চাইলে রাফি বলেন, আমার মা সব সময় বলতেন, তুমি আর যা-ই করো, পড়াশোনাটা ছাইড়ো না। ওই জায়গাটা আমাকে অনেক বেশি মোটিভেট করে। যেদিন আমার মা মারা যান, সেদিনও আমার ফাইনাল পরীক্ষা ছিল। আমি আমার মায়ের লাশ রেখে পরীক্ষা দিতে গিয়েছি। ওই কথা ও স্মৃতিগুলো আমাকে মোটিভেটেড করে।
অন্যদের প্রতি রাফির বার্তা, আমি আমার লাইফে অনেক প্রতিকূলতা দেখেছি। কিন্তু আমি কখনো পড়াশোনা থেকে পিছপা হইনি। রাফি অন্যদের তেমন পরিস্থিতি সামাল দেওয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন।