Image description

সাম্প্রতিক দিনগুলোয় অনেকের মনেই এ ধারণা জন্মেছে যে ট্রাম্প প্রশাসন বাধাহীন জয়ের ধারায় ছুটে চলেছে, তাদের লাগাম মনে হয় আর টেনে ধরা যাবে না। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও তাঁর সহযোগীরা (বিশেষ করে ইলন মাস্ক) হাজার হাজার ফেডারেল কর্মীকে গণহারে ছাঁটাই করা থেকে শুরু করে সরকারি নথিপত্রে ‘লিঙ্গ’, ‘ঝুঁকিতে’ ও ‘মেক্সিকো উপসাগর’-এর মতো শব্দ নিষিদ্ধ করা পর্যন্ত একের পর এক ক্ষোভ সৃষ্টিকারী এবং অযৌক্তিক নীতির স্রোত বইয়ে দিয়েছেন।

আরও খারাপ বিষয় হলো, দৃশ্যত এসব নিয়ে কংগ্রেসের রিপাবলিকান সদস্যদের তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া নেই, আগ্রহের সঙ্গেই নির্বাহী শাখার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করছেন তাঁরা। নির্বাচিত ডেমোক্র্যাট সদস্যরাও খুব বেশি কিছু করতে পারছেন না এবং অনেক করপোরেট নেতা ট্রাম্পের কাছে মাথা নোয়াচ্ছেন।

ট্রাম্প প্রশাসনের লাগাম টেনে ধরা যাবে না—এ ধারণা পুরোপুরি ঠিক নয়। ইতিমধ্যে ট্রাম্পের নীতি আদালতে বড় ধরনের বাধার মুখে পড়েছে। দেশজুড়ে ফেডারেল বিচারকেরা তাঁর প্রশাসনের বিতর্কিত কার্যক্রমের কোনো কোনোটির বাস্তবায়ন হয় ব্যর্থ করে দিচ্ছেন, নয়তো অন্তত বিলম্বিত করছেন। কিছুটা আশ্চর্যজনক হলেও এসব কার্যক্রম নিয়ে দায়ের করা মামলার অনেকগুলোই যেখানে বিচারাধীন, সেই সুপ্রিম কোর্টও প্রেসিডেন্টের সব চাওয়া পূরণ করছেন না।

ছাঁটাইয়ের বিরুদ্ধে দুই বিচারকের আদেশে সাময়িক স্বস্তিতে আছেন ফেডারেল কর্মীরা। কেননা কোনো বিচারক এ বিষয়ে চূড়ান্ত রায় দেননি। কর্মীদের যেভাবে চাকরিতে ফেরানো হচ্ছে, সে প্রক্রিয়াও বিশৃঙ্খলাপূর্ণ। ফেডারেল সংস্থাগুলো এখনো ব্যাপকভাবে তাদের কর্মীদের ছাঁটাই করতে পারবে, সে ক্ষেত্রে শুধু আইন অনুসরণ করতে হবে।

এ অবস্থায় কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে ট্রাম্প আদালতের আদেশ অমান্য করতে পারেন, সেই আশঙ্কা বাড়ছে (যদিও তাঁর দাবি, এমন কিছু করবেন না)। অবশ্য এখন পর্যন্ত আদালত ট্রাম্প সরকারের নির্বাহী শাখার যা ইচ্ছা, তা করার বিরুদ্ধে ঢাল হিসেবে কাজ করে চলেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব নেওয়ার পর ট্রাম্প প্রশাসন তার কর্মসূচি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আদালতের কাছে যেসব বড় ধাক্কা খেয়েছে, তার কয়েকটি তুলে ধরা হলো:

ফেডারেল কর্মীদের চাকরিতে ফেরত

ট্রাম্প হোয়াইট হাউসের দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই ‘দ্য অফিস অব পার্সোনেল ম্যানেজমেন্ট’ মার্কিন ফেডারেল সংস্থাগুলো থেকে হাজার হাজার প্রবেশনারি কর্মীকে চাকরিচ্যুত করার নির্দেশ দেন।

পরে ১৩ মার্চ দুজন ফেডারেল বিচারক কৃষি, প্রতিরক্ষা, জ্বালানি, স্বরাষ্ট্র, অর্থ মন্ত্রণালয়সহ ১৯টি সরকারি সংস্থাকে ‘অবিলম্বে’ বরখাস্ত ওই কর্মীদের চাকরিতে ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দেন। সরকারের নির্বাহী শাখার তথ্য অনুযায়ী, আদালতের নির্দেশের পর প্রায় ২৪ হাজার ফেডারেল কর্মীকে চাকরিতে পুনর্বহাল করা হচ্ছে।

সরকার ভালো কর্মীদের বরখাস্ত করবে আর বলবে, এটা তাঁদের অদক্ষতার কারণে করা হয়েছে—এটা শোনা দুঃখজনক। কেননা, তাঁরা ভালো করেই জানেন, এটা মিথ্যা।
উইলিয়াম অ্যালসুপ, ক্যালিফোর্নিয়ার বিচারক

এ দুজনের একজন নর্দান ডিস্ট্রিক্ট অব ক্যালিফোর্নিয়ার বিচারক উইলিয়াম অ্যালসুপ। কর্মচারী ইউনিয়নগুলোর দায়ের করা মামলার পক্ষ নেন তিনি। বলেন, দুর্বল কর্মদক্ষতার কথা বলে প্রবেশনারি কর্মীদের গণহারে ছাঁটাই করা বেআইনি।

বিচারক অ্যালসুপ বলেন, ‘সরকার ভালো কর্মীদের বরখাস্ত করবে আর বলবে, এটা তাঁদের অদক্ষতার কারণে করা হয়েছে—এটা শোনা দুঃখজনক। কেননা তাঁরা ভালো করেই জানেন, এটা মিথ্যা।’

একই দিন ডিস্ট্রিক্ট অব মেরিল্যান্ডের বিচারক জেমস ব্রেডার একই রকমের আদেশ দেন। ১৯ অঙ্গরাজ্যের অ্যাটর্নি জেনারেলদের করা একটি মামলায় তিনি এ আদেশ দেন।

দুই বিচারকের এ আদেশে সাময়িকভাবে স্বস্তিতে আছেন ফেডারেল কর্মীরা। কেননা কোনো বিচারকই চূড়ান্ত রায় দেননি। কর্মীদের যেভাবে চাকরিতে ফেরানো হচ্ছে, সেই প্রক্রিয়াও বিশৃঙ্খলাপূর্ণ। ফেডারেল সংস্থাগুলো এখনো ব্যাপকভাবে তাদের কর্মীদের ছাঁটাই করতে পারবে, সে ক্ষেত্রে শুধু আইন অনুসরণ করতে হবে।

জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব বাতিলের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা

প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের শুরুর প্রথম দিনই ট্রাম্প জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব নিয়ে এক নির্বাহী আদেশ জারি করেন। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী অভিবাসী মা-বাবার সে দেশে জন্মগ্রহণ করা সন্তানের স্বয়ংক্রিয়ভাবে মার্কিন নাগরিকত্ব পাওয়ার সুযোগ বাতিল করা হয়। তবে শর্তে বলা হয়, এমন সন্তানের জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব পেতে তার অভিভাবকদের অন্তত একজনকে হয় স্থায়ী মার্কিন নাগরিক, নয় বৈধ স্থায়ী বাসিন্দা হতে হবে।

ট্রাম্পের এ আদেশ এখনো কার্যকর হয়নি। ফেডারেল আদালতে একাধিকবার এটি প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে মেরিল্যান্ডের একজন ফেডারেল বিচারক এ আদেশের ওপর প্রাথমিক স্থগিতাদেশ দেন। তিনি বলেন, ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশ সংবিধানের ১৪তম সংশোধনীর লঙ্ঘন। পরে ওয়াশিংটন, ম্যাসাচুসেটস ও নিউ হ্যাম্পশায়ারের বিচারকেরাও একই ধরনের পদক্ষেপ নেন।

জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব বাতিলে ট্রাম্পের আদেশ এখনো কার্যকর হয়নি। ফেডারেল আদালতে একাধিকবার এটি প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে মেরিল্যান্ডের একজন ফেডারেল বিচারক এ আদেশের ওপর প্রাথমিক স্থগিতাদেশ দেন। তিনি বলেন, ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশ সংবিধানের ১৪তম সংশোধনীর লঙ্ঘন। পরে ওয়াশিংটন, ম্যাসাচুসেটস ও নিউ হ্যাম্পশায়ারের বিচারকেরাও একই ধরনের পদক্ষেপ নেন।

আদালতের এসব আদেশের বিরুদ্ধে কয়েক দফায় ব্যর্থ আপিল চেষ্টার পর ১৩ মার্চ ট্রাম্প প্রশাসন জরুরি ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপ কামনা করেছে। ট্রাম্পের শিবির এতে সফল হলে জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের ওপর তাঁর নিষেধাজ্ঞা দ্রুতই কার্যকর হতে পারে। তবে ট্রাম্পের ওই নীতি নিয়ে বিচারপতিরা স্বেচ্ছায় আদেশ দিচ্ছেন না। পলিটিকো বলছে, ট্রাম্প প্রশাসনের চাহিদামাফিক সুপ্রিম কোর্ট কোনো আদেশ দিলে তা এ প্রশাসনের সব নীতি আটকে দেওয়ার ক্ষেত্রে আদালতগুলোর কর্তৃত্ব খর্ব করতে পারে।

অনেকে ধারণা করেন, জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব বাতিলের আদেশের বৈধতা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ জানানো হলে ট্রাম্প প্রশাসন হারবে। কেননা তাঁর এ আদেশ পুরোপুরি অসাংবিধানিক।

ফেডারেল সরকারের অর্থায়ন বন্ধের পদক্ষেপ স্থগিত

গত জানুয়ারিতে ‘অফিস অব ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড বাজেট’ একটি চিঠিতে বিশ্বজুড়ে মার্কিন কেন্দ্রীয় সরকারের সব অনুদান ও ঋণ সাময়িকভাবে স্থগিত করে। বলা হয়, এসব সহায়তা নিয়ে পর্যালোচনার কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তা স্থগিত থাকবে। এতে দেশজুড়ে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। কয়েক দিনের মধ্যে চিঠিটি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। যদিও হোয়াইট হাউস দাবি করেছে, এটি এখনো কার্যকর আছে।

ফেব্রুয়ারি মাসে ডিস্ট্রিক্ট অব কলাম্বিয়ার ফেডারেল ডিস্ট্রিক্ট আদালতের বিচারক লরেন আলিখান এ সহায়তা বন্ধের আদেশ আটকে দেন। ট্রাম্পের এ-সংক্রান্ত উদ্যোগ কার্যকর হওয়ার অল্প সময় আগে আদালত এ স্থগিতাদেশ দেন। বিভিন্ন সংগঠনের জোটের পক্ষ থেকে একটি চ্যালেঞ্জ দাখিলের প্রেক্ষাপটে এ স্থগিতাদেশ দেন আদালত।

আশ্রয়প্রার্থীদের যুক্তরাষ্ট্রে আসার প্রক্রিয়া (কারিগরি) পুনর্বহাল

ক্ষমতায় আসার পর ট্রাম্প ‘ইউএস রিফিউজি অ্যাডমিশন প্রোগ্রাম’ স্থগিত করা এবং এই কর্মসূচি সংশ্লিষ্ট অর্থায়ন বন্ধে এক নির্বাহী আদেশ জারি করেছিলেন।
এ আদেশের ওপর ওয়াশিংটনের ডিস্ট্রিক্ট জজ জামাল হোয়াইটহেড ২৫ ফেব্রুয়ারি একটি প্রাথমিক স্থগিতাদেশ জারি করেন। এতে সরকারকে রিফিউজি অ্যাডমিশন আবার শুরু করা ও আশ্রয়প্রার্থীদের সহায়তায় নিয়োজিত সংগঠনগুলোকে অর্থায়ন চালু রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়।

বিচারক হোয়াইটহেড বলেন, কয়েক দশক ধরে চলা এ কর্মসূচি একতরফা বন্ধ করে দেওয়ার কর্তৃত্ব দৃশ্যত ট্রাম্প প্রশাসনের নেই।

আটকে গেল ফিলিস্তিনি কর্মী মাহমুদ খলিলের প্রত্যর্পণ

যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিলিস্তিনি কর্মী মাহমুদ খলিলকে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করছে ট্রাম্প প্রশাসন। তিনি দেশটির বৈধ স্থায়ী বাসিন্দা। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই স্নাতক শিক্ষার্থী গত বছর এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ আয়োজনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন।

৮ মার্চ খলিলকে গ্রেপ্তার করেছে ফেডারেল ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ। ট্রাম্প বলেছেন, ‘তাঁকে দিয়ে প্রথম শুরু করা হলো, সামনে আরও অনেককে গ্রেপ্তার করা হবে।’ খলিল ও ফিলিস্তিনপন্থী অন্য বিক্ষোভকারীদের ‘সন্ত্রাসের সমর্থক, ইহুদিবিরোধী ও মার্কিনবিরোধী তৎপরতায়’ যুক্ত বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

আটকের এ সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন খলিল। তাঁর আবেদনের ওপর আদালত কর্তৃক পরবর্তী পদক্ষেপ না আসা পর্যন্ত তাঁকে প্রত্যর্পণ সাময়িকভাবে আটকে দেন ম্যানহাটন ডিস্ট্রিক্ট আদালতের বিচারক জেসি ফারম্যান। ১৯ মার্চ খলিলের মামলাটি নিউ জার্সির আদালতে পাঠিয়ে দিয়েছেন বিচারক। নতুন রায় না আসা পর্যন্ত এই ফিলিস্তিনি লুইজিয়ানায় থাকবেন।

ইউএসএআইডির বিল পরিশোধের নির্দেশ

হোয়াইট হাউসের দায়িত্ব নেওয়ার অল্প পরেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিদেশে যুক্তরাষ্ট্রের সব মানবিক ও উন্নয়নকাজে তহবিলের জোগান দেওয়া বন্ধ করে দেন। পরে তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও ধনকুবের ইলন মাস্কের ‘ডিপার্টমেন্ট অব গভর্নমেন্ট ইফিসিয়েন্সি (ডিওজিই)’ ইউএসএআইডিকে ভেতর থেকে ভেঙে দেওয়া শুরু করে। উন্নয়ন সংস্থাটির জন্য আর্থিক সহায়তা বন্ধ ছাড়াও প্রযুক্তিগতভাবে কর্মীদের অফিস থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। এতে কর্মীরা ওয়াশিংটনে সংস্থাটির কেন্দ্রীয় দপ্তর থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।

ফেব্রুয়ারিতে ট্রাম্প ইউএসএআইডিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওর হাতে ন্যস্ত করেন। পরে সংস্থার ৮৩ শতাংশ কর্মসূচি বন্ধ করার ঘোষণা দেন রুবিও। বাকি কর্মসূচি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পরিচালনা করবে বলে জানান তিনি।

এ পদক্ষেপের ওপর ১০ মার্চ প্রাথমিক নিষেধাজ্ঞা দেন ডিস্ট্রিক্ট অব কলাম্বিয়ার ফেডারেল আদালতের বিচারক আমির আলী। তিনি রায় দেন, কংগ্রেস অনুমোদিত বিদেশি সহায়তা তহবিলের জন্য বরাদ্দ করা প্রায় ৬০ বিলিয়ন ডলারের ওপর প্রশাসন হস্তক্ষেপ করতে পারে না। ওই সংস্থার ১৩ ফেব্রুয়ারির আগে সম্পন্ন হওয়া কাজের জন্য সরকারকে অর্থ দিতে হবে।

সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট এ বিষয়ে ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছেন। এতে বিচারক আমির আলীর দেওয়া আদেশ বহাল রইল। এ ছাড়া ১৮ মার্চ আরেকজন ফেডারেল বিচারক থিওডর চুয়াং রায় দেন যে ডিওজিইর ইউএসএআইডি ভেঙে দেওয়ার পদক্ষেপ নানাভাবে সংবিধান লঙ্ঘন করে থাকতে পারে।