Image description

জুলাই আন্দোলনে একটি গুলি ১৪ বছর বয়সি মিরাজ হোসেনের পেটের ডান পাশ দিয়ে ঢুকে বাম পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। অপারেশনের সময় পেটে সেলাই লেগেছে ২৯টি। এখন সুস্থ হলেও সে স্বাভাবিকভাবে কোনো কাজ করতে পারে না। একটু হাঁটাচলা করলেই হাঁপিয়ে ওঠে। এ অবস্থায় তার ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় মা ও একমাত্র বোন।

মিরাজের পরিবার সূত্রে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে গত বছরের ২০ জুলাই গুলিতে গুরুতর আহত হয় মিরাজ। জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে তাকে দেওয়া হয়েছিল এক লাখ টাকা, যা ইতোমধ্যে চিকিৎসায় খরচ হয়ে গেছে। চলমান চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে এবং তার কর্মসংস্থানের জন্য এখন প্রয়োজন সাহায্য।

মিরাজের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের মতলব উত্তর থানাধীন উত্তর নাউরী গ্রামে। তার বয়স যখন দেড় বছর, তখন বাবা আক্কাছ আলী মারা যান। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়ার পর আর্থিক অনটনের কারণে তার আর পড়ালেখা হয়নি। ২০১৬ সালে মা মীনা বেগম, একমাত্র বড় বোন পারভীন আক্তারের হাত ধরে সে পাড়ি জমায় নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে হীরাঝিল এলাকায়। শুরু করে জীবিকা নির্বাহের সংগ্রাম। পরিবারের ব্যয় মেটাতে ইলেকট্রিকের কাজ শিখতে শুরু করে। বোন পারভীন আক্তার স্থানীয় একটি গার্মেন্টসে চাকরি নেন।

বোন ও মিরাজের আয় দিয়ে কোনোমতে ভালোই চলছিল তাদের। কিন্তু বিধিবাম। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে কাজ শেষে বাসায় ফেরার পথে সিদ্ধিরগঞ্জের চাষাঢ়া-আদমজী-চিটাগাং রোড সড়কে ভূমিপল্লির সামনে গুলিবিদ্ধ হয় মিরাজ। তাকে লোকজন দ্রুত বাসায় নিয়ে যায়। এরপর বোন পারভিন তাকে অ্যাম্বুলেন্সযোগে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসে।

পারভিন বলেন, আমি তখন সাড়ে সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা। বাসায় আমি আর মা ছাড়া কেউ ছিল না। টাকা-পয়সাও ছিল না। আমাদের সঙ্গে মেডিকেল যেতে প্রতিবেশী কেউ ভয়ে রাজি হচ্ছিল না। মেডিকেলের উদ্দেশে রওনা হলে যাত্রাবাড়ী কাজলা এলাকায় পুলিশ-র‌্যাব আমাদের অ্যাম্বুলেন্স থামায়। মিরাজকে রক্তাক্ত দেখে আমাকে ধমক দিয়ে অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক সদস্য এ সময় মিরাজের উদ্দেশ্যে গালি দিয়ে বলেÑ ‘ওরে আরেকটা গুলি কইরা মাইরালা’। মিরাজ যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল। তাদের আমি বলি, ‘আমার বাবা নাই। কাজ কইরা আমার মা-ভাইকে খাওয়াই। কাজ থেকে বাসায় ফেরার পথে আমার ভাই গুলি খাইছে। আরো অনেক কথা বলার পর তারা আমার ভাই ও অ্যাম্বুলেন্সের ছবি তুলে গালমন্দ করে আমাদের যেতে দেয়। মিরাজের পেটের এক পাশ দিয়ে গুলি ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। সেই অংশের ভুড়ি কেঁটে ফেলতে হয়েছে। টানা উনিশ দিন ঢাকা মেডিকেলে চিকাৎসাধীন ছিল আমার ভাই।

পারভিন আরো বলেন, আমার ভাইয়ের চিকিৎসার জন্য সাড়ে তিন লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এখনো ওষুধ চলছে। পাঁচদিন পরপর এক হাজার টাকার ওষুধ লাগে। চিকিৎসার জন্য জুলাই ফাউন্ডেশন এক লাখ ৭০০ টাকা দিয়েছে। এ ছাড়া অনেকেই বিকাশ নম্বর নিয়েছে সাহায্য দেওয়ার কথা বলে। কিন্তু কেউ কোনো সহযোগিতা করেনি। চিকিৎসার বাকি টাকা গ্রামের বাড়িতে গিয়ে ব্র্যাক থেকে ৭০ হাজার টাকা কিস্তি উঠিয়েছি। ৫০ হাজার টাকায় স্বর্ণ বন্ধক রেখেছি। বাকি টাকা আমার পরিচিতজনদের কাছ থেকে ধার নিয়ে ভাইয়ের চিকিৎসা করিয়েছি।

মিরাজ বলেন, আমি সেদিন ইলেকট্রিক কাজ করে বাসায় ফেরার পথে ভূমিপল্লির সামনে দাঁড়িয়ে আন্দোলন দেখছিলাম। বিকাল সাড়ে ৫টায় আমার পেটে গুলি লাগে। আমার সঙ্গে থাকা ওস্তাদসহ আরো দু’জন লোক আমাকে ধরাধরি করে ফার্মেসিতে নিয়ে যায়। পরে আমাকে আমার মা-বোনের কাছে নিয়ে এলে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। এখনো মাঝেমধ্যে পেটে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। সিঁড়ি বেয়ে ওঠানামা করলে হাঁপিয়ে ওঠি।

ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মা মীনা বেগম বলেন, ‘আমি একবারেই মরতাম। এহন আমি তিলে তিলে মরতাছি। সেদিন ছেলের রক্তমাখা শরীর দেইখা আমার অন্তঃসত্ত্বা মাইয়া অজ্ঞান হইয়া যায়। আমার মনে ভয় ঢুইকা যায়, আমার এক সন্তানের জন্য দুই সন্তান হারাইতে বসছি কি না? মিরাজ ভারী জিনিস তুলতে পারে না। স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতেও সমস্যা হয়। ইলেকট্রিক কাজ শিখে ভালো ও দক্ষ একজন মিস্ত্রি হয়ে নিজে একটি দোকান দিয়ে ব্যবসা করার ইচ্ছে ছিল। তা আর হলো না। ওর ভবিষ্যৎ নিয়েই আমরা এখন চিন্তায় আছি। সরকারিভাবে যেন ওর দায়িত্ব নেওয়া হয়, সরকারের কাছে আমাদের এতটুকুই চাওয়া।