
দেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ে বিএনপির সঙ্গে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দূরত্ব তৈরি হয়েছে। গণ-অভ্যুত্থানের পরপরই যাঁদের নিয়ে নতুন এই দলটি গঠিত হয়েছে তাঁদের সঙ্গে বিএনপির মতপার্থক্য এবং বোঝাপড়ায় এক ধরনের ছেদ পড়ে।
মাসখানেকের ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সংসদ নির্বাচন, সংবিধান বাতিল, রাষ্ট্র সংস্কার, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ, একাত্তর ও চব্বিশ, সেকেন্ড রিপাবলিক ও গণভোট—মোটা দাগে এই কয়টি বিষয়ে দল দুটির মধ্যে যথেষ্ট মতপার্থক্য দেখা যাচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, মূলত ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি ও রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এক ধরনের লড়াই দেখা যাচ্ছে।বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে রাজপথে বিএনপির শক্ত অবস্থান আছে। নির্বাচন হলে তারা ক্ষমতায় যাবে বলে সবার ধারণা। ফলে স্বাভাবিকভাবে বিএনপি দ্রুত নির্বাচন দাবি করছে। গণ-অভ্যুথানের পর নাগরিক পার্টির নেতাদের যে প্রভাব তৈরি হয়েছে তা তারা সুসংহত করতে চায়।সে জন্য তাঁদের মধ্যে নির্বাচন পিছিয়ে দিয়ে ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এ কারণে নতুন দলটি সংস্কার প্রক্রিয়া দীর্ঘ করার চেষ্টা করছে।
রাজনৈতিক নেতারাও মনে করছেন, বিএনপির সঙ্গে এনসিপির এই দূরত্ব বড় ধরনের সংকট তৈরি করতে পারে। গুরুত্বপূর্ণ কিছু ক্ষেত্রে ঐকমত্য না হলে নির্বাচন এ বছরের মধ্যে হয় কি না তা নিয়ে সংশয় থেকে যাচ্ছে।
যে কারণে বাড়ছে মতভেদ
জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে হবে, তা এখনো স্পষ্ট করেনি অন্তর্বর্তী সরকার। ২৬ মার্চ জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ২০২৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২৬ সালের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। প্রধান উপদেষ্টার এই বক্তব্যের সমালোচনা করে গত বুধবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, এটি অস্পষ্ট বক্তব্য। তিনি দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপ দাবি করেন।
অন্যদিকে এনসিপি বরাবরই ব্যাপকভিত্তিক সংস্কারের পর নির্বাচনের কথা বলছে। দলটির নেতাদের বক্তব্যে নির্বাচন নিয়ে এক ধরনের অনীহাও দেখা যাচ্ছে। আর ঈদের পর সভা-সমাবেশের মাধ্যমে বিএনপি নির্বাচনের দাবিতে আরো জোরালো অবস্থান তুলে ধরবে। তবে নাগরিক পার্টি দ্রুত নির্বাচনের বিপক্ষে এক ধরনের শক্ত অবস্থান তৈরি করতে চাচ্ছে।
অবশ্য নাগরিক পার্টির নেতারা ঈদ উপলক্ষে তাঁদের নির্বাচনী এলাকায় শোডাউনও করছেন। দুই নেতা সারজিস আলম ও আবদুল হান্নান মাসউদের শোডাউন নিয়ে হচ্ছে নানা আলোচনা। নির্বাচনী এলাকাগুলোতে বিএনপির সঙ্গে তাঁদের এক ধরনের বিরোধ তৈরি হয়েছে। মূলত রাজপথে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এ বিরোধ তৈরি হচ্ছে বলে মনে করছে বিভিন্ন মহল।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বর্তমানে দেশে অস্থিতিশীল অবস্থা চলছে। সংসদ নির্বাচন না হলে এ সংকট বাড়তে থাকবে। বর্তমান বাস্তবতায় দেশ-বিদেশের সবাই এখন নির্বাচনের কথা বলছে। তাই সরকারের দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা উচিত।’
অন্যদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা আমাদের রাজনৈতিক আদর্শে কঠোর থাকছি। আমরা মনে করছি, আমাদের এখন দলীয় এজেন্ডা নয়, জাতীয় এজেন্ডায় অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। সেটা দিতে গিয়ে যখন বিএনপির পক্ষ থেকে বিরোধিতা আসছে তখন তো একটা দূরত্ব তৈরি হচ্ছেই। এটা অস্বীকার করার কিছু নেই।’
তিনি আরো বলেন, ‘তবে আমরা মনে করি, দেশের সার্বভৌমত্ব ও অর্থনৈতিক প্রশ্নে আমরা এখনো ঐক্যবদ্ধ আছি। মূলত সংস্কার ও নির্বাচন প্রশ্নে মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে। এটা ঠিক করতে হলে বিএনপিকে আন্তরিক হতে হবে। বিএনপিকেই উদ্যোগ নিতে হবে কিভাবে এ দূরত্ব দূর করা যায়।’
বিদ্যমান সংবিধান বাতিল, গণপরিষদ নির্বাচন ও সেকেন্ড রিপাবলিক নিয়ে এনসিপির সঙ্গে বিএনপির বিরোধ রয়েছে। এনসিপি সংবিধান পুনর্লিখনের দাবি তুললেও বিএনপি বাহাত্তরের সংবিধান সংশোধনের পক্ষে। তবে তা নির্বাচিত সরকার আসার পর সংসদের মধ্যে করতে হবে বলে মত দিয়েছে দলটি। সে জন্য এনসিপির পক্ষ থেকে গণপরিষদ নির্বাচনের যে কথা বলা হচ্ছে তার কোনো ভিত্তি নেই বলে মনে করছে বিএনপি।
গত রবিবার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে জমা দেওয়া মতামতেও বিএনপি সাংবিধানিক সংস্কার সংসদের মাধ্যমে করার পক্ষে জোরালো মত দিয়েছে। দলটি বলছে, এ ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই।
আর সেকেন্ড রিপাবলিক বলতে কী বুঝাতে চেয়েছে এনসিপি সে বিষয়ে দলটির কাছে জানতে চেয়েছে বিএনপি। বিএনপি নেতাদের মতে, দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলে কিছু নেই। গত বুধবার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, ‘স্বাধীনতা দিবস প্রমাণ করে, দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলতে বাংলাদেশে কিছু নেই। যারা দ্বিতীয় স্বাধীনতার কথা বলে তারা আজকের দিনকে খাটো করে দেখতে চায়।’
অবশ্য স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানানোর পর এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘আমরা মনে করি যে, একাত্তর ও চব্বিশ আলাদা কিছু নয়, বরং চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়েই একাত্তরের স্পিরিট পুনরুর্জীবিত হয়েছে। একাত্তরে আমরা যেটি চেয়েছিলাম, সেটি ৫৪ বছরে অর্জিত হতে পারেনি। একটি ফ্যাসিবাদ ১৫ বছর ধরে বাংলাদেশে চেপে বসেছিল। তাই আরেকটি গণ-অভ্যুত্থানের প্রয়োজন হয়েছিল। একাত্তরে যে সাম্যের কথা বলা হয়েছিল, চব্বিশেও কিন্তু সেই বৈষম্যহীন সমাজের কথাই আমরা বলছি। ফলে যারা একে পরস্পরবিরোধী বা মুখোমুখি দাঁড় করাতে চাচ্ছেন, তাঁদের উদ্দেশ্য অসৎ এবং আমরা মনে করি, তারা চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানকে, ছাত্র-জনতার বিজয়কে প্রকৃতভাবে উপলব্ধি করতে পারেননি।’
এর আগে গত বছর নভেম্বরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবি তুললেও তাঁদের বিরোধিতা করে বিএনপি। এই দাবিতে তখন বৈষম্যবিরোধীরা রাষ্ট্রপতি ভবন ঘেরাও করলে তা নিয়ে বেশ উত্তেজনা তৈরি হয়। তবে বিএনপি স্পষ্ট বলেছে, সাংবিধানিক সংকট তৈরি হয়, এমন কোনো বিষয়ে দলটি সমর্থন জানাবে না। ফলে রাষ্ট্রপতির অপসারণ বিষয়টি আর এগোয়নি। বিএনপির সন্দেহ, রাষ্ট্রপতির অপসারণ ও সংবিধান বাতিলের মধ্যে রয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার কৌশল।
রাষ্ট্র সংস্কারে সরকারের ব্যাপক উদ্যোগের বিষয়েও বিএনপির কিছুটা আপত্তি আছে। বিএনপি মনে করে, একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করতে যতটুকু দরকার, ততটুকু সংস্কার হওয়া উচিত। নির্বাচিত সরকারই পুরো রাষ্ট্র সংস্কারের দায়িত্ব নেবে। তবে জাতীয় নাগরিক পার্টি ব্যাপকভিত্তিক সংস্কার চায়।
গত বুধবার স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানানোর পর নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘কেবল কোনো একটি দলকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য যদি নির্বাচন চাপিয়ে দেওয়া হয় সংস্কার ও বিচার ছাড়া, তাহলে তা অবশ্যই মেনে নেওয়া হবে না।’
এ ছাড়া আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের বিষয়েও এক ধরনের বিতর্ক তৈরি হয়েছে। বিএনপি এ বিষয়ে কৌশলী অবস্থান তুলে ধরেছে। একদিকে তারা রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের বিরোধিতা করলেও অন্যদিকে বলছে, পরাজিত ফ্যাসিবাদের পুনর্বাসন করা যাবে না। তবে এ বিষয়ে সেনাবাহিনীকে নিয়ে নাগরিক পার্টির নেতারা যে বিতর্ক তৈরি করেছেন, তার কঠোর বিরোধিতা করেছে বিএনপি।
গত সপ্তাহে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার পরিকল্পনা সরকারের নেই। তাঁর এই বক্তব্য ঘিরে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এই বক্তব্যের পক্ষে-বিপক্ষে বিভিন্ন দল ও রাজনৈতিক অঙ্গনে তোলপাড় শুরু হয়।
এই বক্তব্যের পর ওই দিন রাতেই নাগরিক পার্টির নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের চেষ্টা হচ্ছে—এমন অভিযোগ তুলে সেনাবাহিনীকে জড়িয়ে বক্তব্য দিলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। বিএনপিসহ বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল হাসনাত আবদুল্লাহ ও জাতীয় নাগরিক পার্টির এ সম্পর্কিত বক্তব্যের কড়া জবাব দেয়।