Image description
 

মেগাসিটি ঢাকার দুই কোটি জনসংখ্যার চলাচলের বাহন ২১ লাখেরও বেশি গাড়ি। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক মোটরসাইকেল। রয়েছে বিশ্বের প্রায় সব নামি-দামি ব্র্যান্ডের প্রাইভেটকার থেকে শুরু করে পাবলিক বাস, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, মালামাল পরিবহনের গাড়ি।

সবই চলাচল করে যে যার মতো করে। সড়কে সর্বশেষ উৎপাত হিসেবে দেখা দিয়েছে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। বিশেষ করে গত ৫ আগস্টের পর রাজধানীর সড়কে যোগ হওয়া কয়েক লাখ অটোরিকশা এখন রাজধানীবাসীর গলার কাঁটা।

এত বিপুলসংখ্যক যানবাহন নিয়ন্ত্রণের জন্য ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগের মাঠপর্যায়ে রয়েছে তিন হাজারেরও কম জনবল। রোদ, বৃষ্টি, শীত সব মৌসুমে ধুলোবালিপূর্ণ উচ্চশব্দের ঢাকার সড়কগুলোতে দায়িত্ব পালন করা এসব ট্রাফিক সদস্য নানা সমস্যায় জর্জরিত। শ্রবণ সমস্যা থেকে শুরু করে, ফুসফুসের ব্যাধি, মানসিক সমস্যা সবই তাদের নিত্যসঙ্গী। কিছু ক্ষেত্রে পারিবারিক সমস্যা থেকে শুরু করে ডায়াবেটিস ও ক্যানসারের মত রোগ বাসা বাঁধছে।

৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর রীতিমতো একটানা ঠায় দাঁড়িয়ে দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে তাদের। ব্যস্ততা বিচেনায় রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টাই দায়িত্ব পালন করতে হয়। হত্যার হুমকি থেকে শুরু করে গায়ে হাত তোলা, নারী সদস্যদের শ্লীলতাহানি ঘটে প্রকাশ্য রাজপথে। গালিগালাজ, অশোভন আচরণ নিত্যদিনের ব্যাপার। সারাদিনের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর বাসস্থানের পরিবেশ নিয়েও দীর্ঘদিনের প্রশ্ন এখনো অমীমাংসিত রয়ে গেছে।

জানা গেছে, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগে কনস্টেবল থেকে অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) পর্যন্ত জনবল রয়েছে কম-বেশি ৪ হাজার ২০০ জন। মাঠ পর্যায়ে কাজ করেন সাধারণ ট্রাফিক সদস্য, সার্জেন্ট ও ইন্সপেক্টররা। এর মধ্যে প্রায় ৩ হাজার সাধারণ ট্রাফিক সদস্য রয়েছেন। রাজধানীর ৬০০টির বেশি ট্রাফিক সিগন্যাল পয়েন্টে যানবাহন ব্যবস্থাপনার কাজ করেন তারা। বিশেষ করে ট্রাফিক সদস্য ও সার্জেন্টরা শিফট অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করেন।

মাঠ পর্যায়ে সরাসরি মনিটরিংয়ের দায়িত্বে থাকা ইন্সপেক্টরদের কর্মঘণ্টা ২৪ ঘণ্টা। প্রতিটি সিগন্যাল পয়েন্টে সর্বনিম্ন ৩ থেকে ৮ জন পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। এর মধ্যে অস্থায়ী পয়েন্ট হিসেবে কোথাও কোথাও একজন ট্রাফিক সদস্য কাজ করেন। প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৬টা থেকে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত ৮ ঘণ্টা প্রথম শিফট এবং দ্বিতীয় শিফটে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত ৮ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার কাজ করেন তারা। ৩৮টি পয়েন্টে রাত সাড়ে ১০টা থেকে ২টা পর্যন্ত যানজট নিরসনে কাজ করতে হয়। এ ছাড়া ব্যস্ততম ৯টি পয়েন্টে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা শিফটিং করে যানবাহন নিয়ন্ত্রণের কাজ করেন ট্রাফিক সদস্যরা।

ট্রাফিক সদস্যদের বসবাসের জন্য ঢাকার রাজারবাগ ও মিরপুর পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্টে (পিওএম) দুটি ব্যারাক রয়েছে। সেগুলোতে এক হাজার ১৫০ জন বসবাস করেন। তবে সেগুলোর মান নিয়েও যথেষ্ট প্রশ্ন আছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, প্রতিটি রুমে অনেকটা গাদাগাদি করে থাকছেন ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা। জায়গা সংকুলান না হওয়ায় বারান্দায়ও বিছানা পেতে থাকছেন কেউ কেউ। সম্প্রতি কেরানীগঞ্জের বসিলা ও গুলশান এলাকায় ২০০ সদস্যের বাসস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ ছাড়া রাজধানীর কয়েকটি থানার ব্যারাকে স্বল্পসংখ্যক সদস্যের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে।

ওয়াশরুশ সংকট

রাজধানীর সড়কের ২১০টি স্থানে ট্রাফিক পুলিশ বক্স এবং ট্রাফিক সদস্যদের ছাউনির ব্যবস্থা রয়েছে। এর মধ্যে ৩২টিতে একটি করে ওয়াশরুম রয়েছে। বাকিগুলোয় ওয়াশরুম দূরে থাক, কয়েকটি স্থানে পুলিশ বক্সের নামে যে ছাউনি রয়েছে, সেখানে বৃষ্টিতে ঠিকমতো দাঁড়ানোও যায় না। অনেকগুলোতে ছাদের ফুটো দিয়ে পানি পড়ে। প্রায় ৮০টি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ঘটনায়। সেগুলো যথাযথ বরাদ্দের অভাবে মেরামত করা যাচ্ছে না। জানা যাচ্ছে, বিভিন্ন স্থানে ফ্লাইওভার থাকায় সেগুলোকেও ট্রাফিক পুলিশ বক্স হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে।

যেসব পুলিশ বক্সে ওয়াশরুম নেই, সেগুলোতে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার জন্য ব্যাপক বিড়ম্বনায় পড়তে হয় দায়িত্বরত ট্রাফিক সদস্যদের। এক্ষেত্রে আশপাশের মার্কেট, হাসপাতালসহ সুবিধাজনক স্থানে যেতে হয়। এতে করে সবচেয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হয় নারী সদস্যদের। তাছাড়া যে ৩২টি স্থানে পুলিশ বক্সে ওয়াশরুম রয়েছে, সেগুলোর পরিবেশও মোটেই স্বাস্থ্যকর নয়।

গত এক সপ্তাহে রাজধানীর গুলশান, ফার্মগেট, মগবাজার, কারওয়ান বাজার, বিজয় সরণি, শাহবাগ, সাতরাস্তা, গুলিস্তান, পুরানা পল্টনসহ বেশ কয়েকটি পয়েন্টে সরেজমিনে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের এমন হালচাল পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে।

ধনী-গরিব সবার আইন না মানার প্রবণতা

যানজট নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে রাজধানীর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় উন্নতি না হওয়ার পেছনে সবচেয়ে প্রধান কারণ হচ্ছে জনগণের আইন না মানার প্রবণতা। দামি গাড়ি থেকে শুরু করে রিকশা, সাইকেল কোনো গাড়ির আরোহীও নিয়ম মানতে চান না। ক্ষমতা দেখানোও একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে ৫ আগস্টের পর পুলিশকে রীতিমতো তুচ্ছজ্ঞান করছেন অনেকেই।

শারীরিক লাঞ্ছনা ও শ্লীলতাহানি

ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে কখনো কখনো শারীরিকভাবে লাঞ্ছনার শিকার হতে হয় ট্রাফিক পুলিশের নারী সদস্যদের। সম্প্রতি এমন এক ঘটনা দেখা গেছে রাজধানীর রামপুরায়। মাহে রমজান শুরুর প্রথমদিকে রামপুরা ব্রিজের ওপরে মোটরসাইকেলের দুই আরোহী সেখানে কর্তব্যরত নারী ট্রাফিক সার্জেন্টকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার পাশাপাশি শ্লীলতাহানিও করেন। পরে সেখানে স্থানীয় জনতা ওই দুই ব্যক্তিকে আটক করে রামপুরা থানায় সোপর্দ করে।

গবেষণা ও জরিপের ফল

বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রসহ (ক্যাপস) একাধিক প্রতিষ্ঠানের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকায় ট্রাফিক বিভাগে কর্মরতদের ৫৬ দশমিক ৪ শতাংশ পুলিশ কানে কম শোনেন। এর মধ্যে শ্রবণশক্তি স্থায়ীভাবে হারানোর পথে ১১ শতাংশ। প্রায় ৮ শতাংশ কয়েক ঘণ্টা দায়িত্ব পালনের পর উচ্চরক্তচাপ, মেজাজ খিটখিটে, মানসিক চাপ, স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়াসহ ক্লান্তিতে ভোগেন। শব্দদূষণে কানের সমস্যার পাশাপাশি উচ্চরক্তচাপ, স্ট্রোক, হার্টের রক্তনালি ব্লক, ডায়াবেটিস ও কোলেস্টেরল বাড়াতেও ভূমিকা রাখে। শ্রবণশক্তি হ্রাসের ফলে বিরক্তি, নেতিবাচকতা, রাগ, ক্লান্তি, চাপা উত্তেজনা, মানসিক চাপ, বিষণ্ণতা, ব্যক্তিগত ঝুঁকি বাড়ায় এবং স্মৃতিশক্তি হ্রাস পায়।

বিশেষজ্ঞের বক্তব্য ও পরামর্শ

ক্যাপসের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক অধ্যাপক ড. কামরুজ্জামান মজুমদার আমার দেশকে বলেন, শব্দদূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েন ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা। রাস্তায় উচ্চশব্দের মধ্যে দাঁড়িয়ে ৮-১০ ঘণ্টা দায়িত্ব পালনের কারণে তাদের শ্রবণশক্তির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় ভুগতে হয়। গাড়ির উচ্চশব্দের হর্ন ১০০ ডেসিবেলের বেশি হওয়ায় ট্রাফিক সদস্যদের শ্রবণ সমস্যা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। সাধারণত মানুষের কানে সর্বোচ্চ ৬০ ডেসিবল শব্দ সহ্য করার ক্ষমতা থাকে। এর বেশি হলে সেটা স্থায়ীভাবে শ্রবণসমস্যা তৈরি করে।

জরিপে দেখা গেছে, ট্রাফিক কন্ট্রোলে দায়িত্বরতদের মধ্যে ২০ ভাগেরও বেশি স্বাভাবিকভাবে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন না। পরিবারে স্বাভাবিকভাবে যে মাত্রায় কথা বলতে হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি জোরে কথা না বললে শোনেন না ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা। এ কারণে পরিবারের সদস্যরা তাদের সঙ্গে কথা বলতে নিরুৎসাহিত হন। অনেক ক্ষেত্রে এড়িয়ে চলেন।

এসব সমস্যা সমাধানের বিষয়ে অধ্যাপক কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, উচ্চ ও সহনীয় মাত্রার শব্দদূষণের স্থানে সমন্বয় করে দায়িত্ব দিতে হবে। একটানা উচ্চশব্দের স্থানগুলোতে দায়িত্ব দেওয়া যাবে না। পাশাপাশি ক্ষতিপূরণ হিসেবে ভাতা বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। কর্মঘণ্টা কমিয়ে আনারও সুপারিশ করেন এই বিশেষজ্ঞ।

তিনি বলেন, বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে আমরা বলেছি, সিনথেটিক কাপড় পরিবর্তন করে সুতি কাপড় দেওয়ার ব্যবস্থা করা এবং কর্মঘণ্টার মাঝখানে দুই ঘণ্টা পরপর কিছু সময়ের জন্য বিশ্রামেরও ব্যবস্থা রাখা দরকার।

গবেষণায় দেখা গেছে, সারা দিন দায়িত্ব পালন শেষে ব্যারাক কিংবা বাসায় ফিরে পরবর্তী দুই ঘণ্টা কানে অনেক কম শুনতে পান ট্রাফিক সদস্য থেকে পরিদর্শক পর্যন্ত পুলিশের এ বিভাগের দায়িত্ব পালন করা ব্যক্তিরা।

‘ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের ৮ ঘণ্টায় প্রায় এক হাজার গাড়ির হর্ন মোকাবিলা করতে হয় জানিয়ে বিষয়টিকে দ্রুত বিবেচনায় নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান ড. কামরুজ্জামান মজুমদার। তিনি আরো বলেন, উচ্চ ডেসিবল শব্দ সৃষ্টিকারী হর্ন আমদানি বন্ধ করা এবং পর্যায়ক্রমে বিদ্যমান হর্ন নষ্ট করতে হবে।