Image description

পঞ্চম গণবিজ্ঞপ্তিতে রংপুরের একটি বেসরকারি স্কুলে চাকরিতে যোগ দেন আবু রাশেদ নোমান। জানুয়ারিতে মিলেছে ইনডেক্স নম্বর। তবে এখনো পাননি বেতন। নোমান বলেন, কেমন যেন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আছে। চাকরি করি কিন্তু বেতন নাই। নিজের জন্য কিছু কেনার চিন্তাও করি না। বাবা-মা’কে যে কিছু কিনে দেবো সে ক্ষমতাও নাই। উল্টো রোজার সময় কয়েক হাজার টাকা ধার হয়েছে। কীভাবে কী করবো কিছুই বুঝতে পারছি না। 

ডিসেম্বর থেকে বেতন পান না আরেক শিক্ষক সাদিকুল্লাহ আমিন। তিনি বলেন, ঈদের এই সময়টায় রীতিমতো পালিয়ে বেড়াচ্ছি। ঈদটা পার হলেই বাঁচি। আমার দু’টা বাচ্চা আছে ভাগ্য ভালো নানা বাড়ি থেকে তারা নতুন জামা পেয়েছে। না হলে আমার সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চাগুলোরও ঈদ মাটি হয়ে যেতো। তিনি বলেন, ঈদে টালবাহানা করে বলেছি এবার কাজের অনেক চাপ বাড়ি যেতে পারবো না। বাধ্য হয়ে মিথ্যা বলতে হচ্ছে। 

ক’দিন বাদেই পবিত্র ঈদুল ফিতর। এই উৎসব ঘিরে গোটা দেশে আনন্দের ছটা। কিন্তু এর ছোঁয়া লাগেনি প্রায় তিন লাখ এমপিওভুক্ত শিক্ষকের ঘরে। মেলেনি বেতন-ভাতা। ঈদের আগে বেতন পাবেন এই সুযোগও নেই। শিক্ষকদের অভিযোগ, কর্মকর্তাদের সদিচ্ছার অভাবেই এই অবস্থা। তারা চাইলেই ঈদের আগে বেতন-ভাতা দিতে পারতেন।

ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার (ইএফটি)’র মাধ্যমে বেতন-ভাতা দেয়া শুরু হয়েছে শিক্ষকদের। শিক্ষকদের বেতন তোলা নিয়ে ভোগান্তি লাঘবের জন্যই নতুন এই পদ্ধতি। কিন্তু নোমান-আমিনের মতো প্রায় সাড়ে তিন লাখ শিক্ষক চাতক পাখির মতো অপেক্ষায় আছেন বেতনের। বৃহস্পতিবার বেতন-ভাতা ছাড় হলেও তা তুলতে না পারার শঙ্কা রয়েছে শিক্ষকদের মধ্যে। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) বলছে, বৃহস্পতিবারের মধ্যেই শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ব্যাংকে পাঠানোর চেষ্টা চলছে। 

তথ্যমতে, ১লা জানুয়ারি ১ লাখ ৮৯ হাজার শিক্ষক ইএফটি’র মাধ্যমে বেতন-ভাতা পান। দ্বিতীয় ধাপে ৬৭ হাজার, তৃতীয় ধাপে ৮৪ হাজার এবং চতুর্থ ধাপে ৮ হাজার ২০০ এর অধিক শিক্ষক-কর্মচারীকে ডিসেম্বর মাসের বেতন দেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে অধিকাংশ পেয়েছেন জানুয়ারি মাসের বেতন। তবে মার্চ শেষ হতে চললেও ফেব্রুয়ারি মাসের বেতন ও ঈদ উৎসব ভাতা পাননি শিক্ষকরা। শুধু তাই নয়, ডিসেম্বরের বেতন মেলেনি সাড়ে ১২ হাজার শিক্ষক-কর্মচারীর। গত মঙ্গলবার এ ধাপের ৪ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসের বেতনের মেসেজ পেয়েছেন। তবে তুলতে পারেননি সে অর্থ। 

নোয়াখালীতে চাকরি করেন আসাদুল্লাহ মিয়াজী। বাড়ি তার দিনাজপুরে। তিনি বলেন, শিক্ষক মানুষ। না পারি মানুষের কাছে ধার দেনা করতে আবার না পারি ভিন্ন পেশায় যাইতে। ধার করে ঈদে বাড়ি আসছি। এখনও এক মাসের বাসা ভাড়া বাকি। কিস্তি দেয়া লাগে। এরপর আবার ধার করে চলছি।  আমার ওষুধ কেনা লাগে প্রতি মাসে প্রায় দুই হাজার টাকার। ফার্মেসিতেও বাকি পড়ছে। কীভাবে চলছি আল্লাহ্‌ জানে। 

তিনি বলেন, আমার জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গে সনদপত্রের নামের মিল নেই। এখন ত্বরিত নামটাও সংশোধন করতে পারছি না। এই কারণে সার্ভারে এন্ট্রি দিতে পারিনি। বেতন ছাড়া অনেক কষ্টে জীবন চলছে। এখন এসেছি সমাধানের জন্য।
বাংলাদেশ শিক্ষক ফোরামের সিনিয়র সহ-সভাপতি প্রভাষক মো. শান্ত আলী বলেন, শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন বোনাস প্রদানে মাউশি ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অবেহলা আমাদেরকে চরমভাবে ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ করেছে। এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বিভিন্ন বিষয়ে সবসময় মাউশি গা-ছাড়া ভাব দেখিয়ে এসেছে। শিক্ষকরা যদি সরকারের আওতাভুক্ত হয়ে থাকে তাহলে সরকারের ঘোষণা সত্ত্বেও ২৩ তারিখের মধ্যে বেতন বোনাস দেয়া হলো না কেন? 

তিনি বলেন, কয়েক লাখ শিক্ষকের ঈদ আনন্দ ইতিমধ্যে ম্লান হয়ে গেছে। সমাজ ও পরিবারের কাছে লজ্জায় মুখ দেখাতে পারছে না। এভাবে আসলে আর চলতে দেয়া যায় না। এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের অভিভাবকের প্রশ্নে নতুন করে ভাববার সময় এসেছে। তরুণ শিক্ষকরা এই বৈষম্য ও অবহেলা সহ্য করবে না। 
শান্ত বলেন, আমি সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি বিনীত অনুরোধ করবো অতি দ্রুত শিক্ষকদের বেতন-বোনাস প্রদানের যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। 

ওদিকে মাউশি বলছে, নতুন একটি প্রক্রিয়া। তাই কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে। মাউশি’র এডুকেশন ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (ইএমআইএস) সেল জানায়, প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে নাম। অনেকেই নাম সনদপত্রে একই নাম নেই। আগে সমস্যা হয়নি কিন্তু সার্ভারে ভিন্ন নামের কারণে আটকে গেছেন। আবার অনেক নারী বিবাহের পর পরিবর্তন করেছেন নামের। আবার অনেকেরই ডট, কমা, হাইফেন ইত্যাদিতে রয়েছে ভিন্নতা। তবে ইএফটি সেল ডট, কমা, হাইফেন এসবে ছাড় দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেভাবেই সংশোধন করা হবে সার্ভার। তবে যাদের সনদ ও জাতীয় পরিচয়পত্রে নামের ভিন্নতা বেশি (৫০ শতাংশের বেশি অমিল) ও জন্মতারিখ সঠিক নয় তাদের সংশোধন করেই ইএফটিতে যুক্ত হতে হবে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ইএমআইএস সেলের সিনিয়র সিস্টেম এনালিস্ট খন্দকার আজিজুর রহমান বলেন, সার্বিক বিষয়ের কাজটি খুবই জটিল। এখানে প্রতিটি শিক্ষকের তথ্য পরীক্ষা-নীরিক্ষা করতে হচ্ছে। আমরা ছাড় দেয়ার প্রবণতা দেখাচ্ছি কিন্তু ভুল করতে চাই না।

মাউশি’র মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আজাদ খান বলেন, প্রায় চার লাখ শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন অনলাইনে দেয়া খুব সহজ বিষয় না। অনেকের তথ্যগত ভুল রয়েছে। তবুও মানবিক বিবেচনায় তাদের বেতন দেয়া হচ্ছে। আমরা আমাদের কাজ শেষ করেছি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় অনুমোদনও দিয়েছে। বাকি কাজ অর্থ মন্ত্রণালয় এবং ব্যাংকের। তিনি আরও বলেন, মন্ত্রণালয়, আইবাস ও ইএমআইএস সেলের সঙ্গে দফায় দফায় কথা বলা হয়েছে। তারা সমাধানের চেষ্টা করছেন।